বিশ্ব জলাভূমি দিবস ও বাংলাদেশের পরিস্থিতি

বিশ্ব জলাভূমি দিবসের প্রতিপাদ্য ‘জলাভূমি ও জীববৈচিত্র্য’। ছবি: সংগৃহীত
বিশ্ব জলাভূমি দিবসের প্রতিপাদ্য ‘জলাভূমি ও জীববৈচিত্র্য’। ছবি: সংগৃহীত

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যের সবচেয়ে সমৃদ্ধ উদাহরণ হলো জলাভূমি। ২ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব জলাভূমি দিবসের এ বছরের প্রতিপাদ্য বিষয় ‘জলাভূমি ও জীববৈচিত্র্য’। জলাভূমির অপরিসীম গুরুত্ব অনুধাবন করে ১৯৭১ সালের এই দিনে ইরানের রামসার শহরে পরিবেশবাদী সম্মেলনে জলাভূমির টেকসই ব্যবহার ও সংরক্ষণের জন্য একটি আন্তর্জাতিক চুক্তি সই হয়। এটি রামসার কনভেনশন চুক্তি বলে পরিচিত।

১৯৭৫ সালে রামসার কনভেনশন চুক্তি কার্যকর হয়। ১৯৯২ সালে বাংলাদেশ এ চুক্তিতে সই করে। এখন পর্যন্ত ১৭১ দেশ চুক্তি অনুমোদন করেছে। ১৯৯৭ সাল থেকে ২ ফেব্রুয়ারি আইইউসিএন, ইউনেসকোসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক, সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার মাধ্যমে ১০০টিরও বেশি দেশের পরিবেশসচেতন নাগরিক বিশ্ব জলাভূমি দিবস পালন করছেন। ইউনেসকো রামসার কনভেনশনের সমন্বয়কের দায়িত্ব পালন করে আসছে।

বাংলাদেশ নদীমাতৃক দেশ। নদীনালা, বিল, হাওর, বাঁওড়ের মতো বহু জলাভূমি এ দেশকে ঘিরে রেখেছে। বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, এ দেশের ৭ থেকে ৮ লাখ হেক্টর ভূমি কোনো না কোনোভাবে জলাভূমির অন্তর্ভুক্ত, যা আমাদের মোট আয়তনের প্রায় ৫০ ভাগ।

পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা, জীববৈচিত্র্য, কৃষি, মৎস্য, পর্যটনসহ নানা ক্ষেত্রে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হলো জলাভূমি। এ দেশের প্রাকৃতিক স্বাদু পানির মাছের প্রধান উৎস হলো হাওরের বেসিন অঞ্চল। জীববৈচিত্র্যের ক্ষেত্রে এ দেশের সবচেয়ে সমৃদ্ধ উদাহরণ হলো হাওর অঞ্চল ও সুন্দরবন। এ ছাড়া আড়িয়ল বিল ও চলনবিল এ দেশের গুরুত্বপূর্ণ জলাভূমি।

পৃথিবী বিখ্যাত সুন্দরবন সম্পর্কে নতুন করে কিছু বলার নেই। শুধু সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যই নয়, প্রাকৃতিক দুর্যোগ বিশেষত সাইক্লোনের হাত থেকে এ দেশ বাঁচানো এক অতন্দ্রপ্রহরী হলো সুন্দরবন। সম্প্রতি সরকার দেশের ক্রমবর্ধমান বিদ্যুতের চাহিদা মেটাতে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করতে যাচ্ছে। সুপার ক্রিটিক্যাল টেকনোলজি ব্যবহারের কথা বলা হলেও এটি যাতে কোনোভাবেই সুন্দরবনের ক্ষতি করতে না পারে, সেদিকে নজর রাখতে হবে। ১৯৯২ সালে সুন্দরবনকে রামসার সাইট (রামসার কনভেনশন কর্তৃক আন্তর্জাতিক ভাবে স্বীকৃত জলাভূমি) হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

অপরূপ প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্যের আরেক নিদর্শন হলো টাঙ্গুয়ার হাওর। সুনামগঞ্জের অবস্থিত টাঙ্গুয়ার হাওরে ২০৮ প্রজাতির পাখি, ১৫০ প্রজাতির জলজ উদ্ভিদ, ১৫০ প্রজাতির মাছ, ৩৪ প্রজাতির সরীসৃপ ও ১১ প্রজাতির উভচর প্রাণী রয়েছে। প্রতিবছর শীতকালে প্রায় ২০০ প্রজাতির অতিথি পাখির আগমন ঘটে এখানে। ২০০০ সালে টাঙ্গুয়ার হাওরকে সুন্দরবনের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় ‘রামসার সাইট’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়। সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনায় ৩৭৩টি হাওর রয়েছে।

১৯৯৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ১০০টিরও বেশি দেশের পরিবেশসচেতন নাগরিক পালন করে আসছেন বিশ্ব জলাভূমি দিবস।
১৯৯৭ সালের ২ ফেব্রুয়ারি ১০০টিরও বেশি দেশের পরিবেশসচেতন নাগরিক পালন করে আসছেন বিশ্ব জলাভূমি দিবস।

জীববৈচিত্র্যসহ খাদ্যনিরাপত্তার জন্য এ জলাভূমির ভূমিকা অনস্বীকার্য। হাওর ও জলাভূমি উন্নয়ন বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, হাওরাঞ্চলে প্রতিবছর প্রায় ৫ লাখ ২৫ মিলিয়ন টন ধান উৎপাদিত হয়।

বাংলাদেশের প্রাণ এই জলাভূমি, তথা নদী, নালা, হাওরের পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কোনো বিকল্প নেই। সাংবিধানিকভাবেও এর গুরুত্ব স্বীকৃত। বাংলাদেশের সংবিধানের ১৮-ক-এর অনুচ্ছেদ এ পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণের কথা বলা হয়েছে, ‘রাষ্ট্র বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নাগরিকদের জন্য পরিবেশ সংরক্ষণ ও উন্নয়ন করিবেন এবং প্রাকৃতিক সম্পদ, জীববৈচিত্র্য, জলাভূমি, বন ও বন্য প্রাণীর সংরক্ষণ ও নিরাপত্তা বিধান করিবেন, যা সরকারের পরিবেশবান্ধব নীতির প্রতিফলন হিসেবে বিবেচনা করা যায়।’

কিন্তু সম্পদের অতিরিক্ত আহরণ, পরিবেশদূষণ, জনসংখ্যার চাপসহ নানা কারণে এ দেশের জলাভূমিগুলোর প্রায় প্রতিটিই কমবেশি বিপদের সম্মুখীন। হারিয়ে গেছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছসহ নানা উদ্ভিদ ও প্রাণী। বহু জীব বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কায় রয়েছে। অনেকের আবাসস্থল সংকুচিত হয়ে গেছে।

পরিবেশ অধিদপ্তর থেকে এখন পর্যন্ত ১২টি এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা বলে ঘোষণা করা হয়েছে, যার প্রায় সব কটিই জলাভূমি। এর মধ্যে ১৯৯৯ সালে সুন্দরবন, টাঙ্গুয়ার হাওর, হাকালুকি হাওর, মারজাত বাঁওড় এবং পরে বুড়িগঙ্গা, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ, বালু এবং গুলশান লেককে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। পরিবেশ সংরক্ষণ আইন ১৯৯৫ অনুযায়ী এসব অঞ্চলে ক্ষতিকর কারখানা স্থাপন, মাটি, পানি ও বায়ু দূষণকারী কার্যক্রম, মাছসহ জলজ প্রাণীর জন্য ক্ষতিকর কার্যকলাপ এবং যেকোনো ধরনের পরিবেশদূষণ নিষিদ্ধ; যদিও বাস্তবতা অনেকটাই ভিন্ন।

জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণসহ হাওরাঞ্চলের উন্নয়নে সরকারের ২০১২ থেকে ২০৩২ সাল পর্যন্ত ২০ বছর মেয়াদি মাস্টারপ্ল্যান রয়েছে। অন্যান্য জলাভূমি সংরক্ষণের জন্যও পরিকল্পনা রয়েছে। আয়তনে ছোট হলে বাংলাদেশের রয়েছে অত্যন্ত সমৃদ্ধ জীববৈচিত্র্য। শুধু জীববৈচিত্র্যই নয়, কৃষি, মৎস্য ও পর্যটনের জন্য টেকসই জলাভূমি ব্যবস্থাপনার কোনো বিকল্প নেই।

২০২০ সালে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকী পালিত হচ্ছে। এ মাহেন্দ্রক্ষণের আগে বিশ্ব জলাভূমি দিবসে পরিবেশসচেতন নাগরিকেরা বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কথা ভেবে জলাভূমি ও জীববৈচিত্র্য সংরক্ষণে নতুন করে অনুপ্রাণিত হবেন—এটাই প্রত্যাশা।

লেখক: ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মৃত্তিকা, পানি ও পরিবেশ বিভাগের প্রাক্তন শিক্ষার্থী, ব্যাংক কর্মকর্তা