কোচিং-বাণিজ্য গ্রাস করছে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা

শিক্ষাব্যবস্থায় দিন দিন বাড়ছে কোচিং–বাণিজ্যর দৌরাত্ম্য। ছবি: সংগৃহীত
শিক্ষাব্যবস্থায় দিন দিন বাড়ছে কোচিং–বাণিজ্যর দৌরাত্ম্য। ছবি: সংগৃহীত

অনেকেই বলেন, বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় দিন দিন বাড়ছে কোচিং–বাণিজ্যর দৌরাত্ম্য। তার আগে আরেকটি বিষয় চোখ বুলাতে চাই।

আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর পরিবেশ এবং শিক্ষার মান নিয়ে অনেকেই প্রশ্ন তোলেন এবং আন্তর্জাতিক পরিসংখ্যানে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো কেন পরিসংখ্যান তালিকার হাজারের পরে, তা নিয়েও উদ্বিগ্ন। এসব নিয়ে প্রশ্ন করার আগে ভেবে দেখা উচিত, বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় গবেষণা হয় কতটুকু। শিক্ষার্থীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে লেখাপড়া করে কী করছেন, গতানুগতিক চাকরির পেছনে ছুটছেন, নাকি গবেষণা করছেন। হ্যাঁ, এ চাকরি আমাদের প্রয়োজন, আমাদের সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের শতকরা ৮০ ভাগ শিক্ষার্থীরা নিম্ন–মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা। মোটামুটি একটা চাকরি হলেই, ব্যস।

আমাদের যথেষ্ট মেধাশক্তি আছে। তবে কেন আমাদের তেমন বেশি বিজ্ঞানী নেই? কেন উদ্ভাবক নেই? কেন গবেষক নেই? এর সিংহভাগ দায় সরকারকে দিতে চাই। যেহেতু একজন শিক্ষার্থীকে কেবল মাস্টার্স পর্যন্ত পড়াশোনার জন্য কয়েক লাখ টাকা খরচ করতে হয়, তারপর কীভাবে তিনি গবেষণা করবেন? মা–বাবা হয়তো কেবল পড়াশোনার জন্য জায়গাজমি বিক্রি করতে পারেন, গবেষণা বা উদ্ভাবনের জন্য তো তাঁরা বিনিয়োগ করতে চান না। তাঁরা ভাবেন, এতে তাঁদের কোনো লাভ নেই। ছেলেমেয়ে মোটামুটি লেখাপড়া করেন, একটা চাকরি নিয়ে বিয়েশাদি করলেই বাবা-মায়েরা বেজায় খুশি থাকেন।

মানবজীবন তো কেবল নিজে বা নিজের পরিবার আত্মীয়স্বজন নিয়ে নয়; একজন প্রতিশ্রুতিশীল শিক্ষার্থীর কাছে সব নাগরিকের অধিকার রয়েছে। একজন শিক্ষার্থী যেহেতু সরকারি সার্টিফিকেট গ্রহণ করেন, সেহেতু তিনি বাংলাদেশের সব নাগরিকের দেওয়া ট্যাক্সের টাকায় পড়েন। সব নাগরিক তাঁর কাছ থেকে কিছু চায়। এ চাওয়াটা প্রত্যক্ষ নয়, পরোক্ষ। আমাদের দেশের শিক্ষিত সন্তানেরা বিশ্ব জয় করুক, অনেক কিছু আবিষ্কার করুক, উদ্ভাবন করুক, গবেষণা করুক—এটাই সম্মিলিত নাগরিকের চাওয়া।

কোচিং নিয়ে নানা নেতিবাচক ধারণা আছে। ছবি: সংগৃহীত
কোচিং নিয়ে নানা নেতিবাচক ধারণা আছে। ছবি: সংগৃহীত

আমার আলাপের বিষয়টি ছিল শিক্ষায় কোচিংয়ের দৌরাত্ম্য। আমি, আপনি, সবাই নিজেরা, নিজেদের সন্তানদের মোটামুটি কোনো স্কুলে ভর্তি করেই দৌড় দিই কোচিংয়ের শিক্ষকের কাছে। জিপিএ–৫ বা প্রথম স্থান অধিকার করার ব্যাপারটা কোচিংয়ের শিক্ষকর ওপরে ছেড়ে দিই। শিক্ষায় এই কোচিং বিষয়টা এমনভাবে জড়িয়েছে যে একটা উদাহরণ দিলে ব্যাপারটা পরিষ্কার হয়ে যাবে। আমরা জানি, বর্তমানে চাকরির বাজারে অর্থের লেনদেনে চাকরি পাওয়ার খবর মেলে। ধরুন, কোনো ব্যক্তি লাখ দশেক টাকা বা তার চেয়ে বেশি ঘুষ দিয়ে পুলিশের চাকরি নিলেন। ওই ব্যক্তির বেতন মাসে ১০ হাজার টাকা। অনেক পরিবার এক সঙ্গে ১০ লাখ টাকা দেওয়ার ক্ষমতা রাখে না। তাহলে কী করবেন। ধার করে বা লোন নিয়ে চাকরি নেন। সেই চাকরিপ্রার্থী টাকাটা দুই-এক বছরের মধ্যে তোলার পণ করেন। তাঁর দোষ না, কিছু কিছু ক্ষেত্রে এটাই সিস্টেম হয়ে গেছে। এই যে ঘুষ গ্রহণটা যেমন সিস্টেম হয়ে গেছে, ঠিক এভাবেই শিক্ষায় কোচিং সিস্টেম বা অপরিহার্য হয়ে গেছে।

শিক্ষা অর্জনের ব্যাপারটা আমাদের কাছে এমন যে অমুকের ছেলে জিপিএ–৫ পেয়েছে, আমার ছেলেকেও পেতে হবে, সেটা যেকোনো উপায়ে হোক। এই আশা থেকে আমাদের অভিভাবকেরা ছেলেমেয়েদের কোচিংয়ের ওপর ছেড়ে দিচ্ছেন।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, এই কোচিং কারা করান? অর্থাৎ এই কোচিংয়ের শিক্ষক কারা? এর উত্তর সহজ। বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা ক্লাস শেষে বিকেল এবং রাতে ছাত্রদের বিশেষ ক্লাস করান, তাঁরাই কোচিংয়ের শিক্ষক। কিছু কিছু শিক্ষকের কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষকতার অভিজ্ঞতা না থাকলেও তাঁরা কোচিংয়ে পড়ান।

আমরা সন্তানদের কোনো স্কুলে ভর্তি করেই দৌড় দিই কোচিংয়ের শিক্ষকের কাছে। ছবি: সংগৃহীত
আমরা সন্তানদের কোনো স্কুলে ভর্তি করেই দৌড় দিই কোচিংয়ের শিক্ষকের কাছে। ছবি: সংগৃহীত

কোচিং করাতে সন্তানদের জন্য অর্থ ব্যয় করতে হয়, মানে কোচিং শিক্ষকদের টাকা দিতে হয়। অর্থাৎ অভিভাবকেরা এ শিক্ষকদের দুভাবে টাকা দেন তাদের ছেলেমেয়েদের জিপিএ–৫ পাওয়ার জন্য। প্রথমটা হচ্ছে শিক্ষকদের সরকারি বেতন। যেহেতু অভিভাবকেরা সরকারকে ট্যাক্স দিয়ে থাকেন এবং সরকার সেটা দিয়েই শিক্ষকের বেতন দেয়। শিক্ষকের দ্বিতীয় বেতন হচ্ছে অভিভাবকদের কাছে নগদ নেওয়া কোচিং ফি।

দেশে যে হারে কোচিং এবং বেসরকারি স্কুল প্রতিষ্ঠা হচ্ছে, এর ধারাবাহিকতা চলতে থাকলে শিক্ষার মূল লক্ষ্য ব্যর্থ হবে খুব তাড়াতাড়ি, যদিও অনেকাংশে ব্যর্থ হয়েছে। সৃজনশীল শিক্ষার্থীর অভাবে পড়বে রাষ্ট্র ও সমাজ। যদিও আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা উচ্চমাধ্যমিক পর্যন্ত সৃজনশীল পদ্ধতি।

মাদক, জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস দমনের মতো কোচিং–বাণিজ্য এখন এ মুহূর্ত বন্ধ করতে না পারলে ছেলেমেয়েরা গতানুগতিক ক, খ এবং এ, বি, সি, ডি-ই বলবে। সৃজনশীলতা হারিয়ে যাবে।

সরকার এবং শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাছে অনুরোধ, অতি দ্রুত বাংলাদেশের সব স্কুল, কলেজভিত্তিক কোচিং বন্ধের ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। বেসরকারি স্কুল ও কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় আরও অধিক নজরদারির ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। জাতির ভবিষ্যতের কথা ভেবেই তা করা উচিত।

লেখক: কবি ও বিশ্লেষক