'পলাশীপুরাণ' যাত্রায় মুখ ফেরায়নি কেউ

‘পলাশীপুরাণ’ যাত্রাপালায় অংশ নেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের ১৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। ছবি: লেখক
‘পলাশীপুরাণ’ যাত্রাপালায় অংশ নেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের ১৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থীরা। ছবি: লেখক

হঠাৎ করে মাইকে শোনা গেল ‘হই হই কাণ্ড রই রই ব্যাপার! যাত্রা যাত্রা যাত্রা!’ প্রচার মাইকে এমনটি শোনার অভিজ্ঞতা আছে অনেকেরই। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের ভেতরে এমন প্রচার শুনে অভ্যস্ত ছিলেন না অনেকেই। তাই কারও আগ্রহের কমতি ছিল না। এর প্রভাব পড়ে সন্ধ্যায়। মাইকে প্রচার আসছে, ‘আপনারা সারিবদ্ধভাবে প্যান্ডেলে প্রবেশ করুন। আমাদের সহযোগিতা করুন। দর্শক হয়ে যাত্রা উপভোগ করুন।’ প্রায় এক ঘণ্টা ধরে সারিবদ্ধভাবে দর্শকেরা প্রবেশ করেন প্যান্ডেলে। আসন ফাঁকা না থাকায় ফেরত গেছেন অনেকে। বলছিলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের আয়োজনে হয়ে যাওয়া ‘পলাশীপুরাণ’ যাত্রাপালার কথা।

নিউ মিডিয়ার যুগে প্রায় হারাতে বসেছে বাঙালি সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সমৃদ্ধিশালী অঙ্গনগুলো। পালাগান, ঐতিহ্যবাহী বাংলা নাট্য, কবিগান, জারি-সারির মতো যাত্রার আয়োজন খুব কমই চোখে পড়ে এখন। এসব আয়োজনের খামতির জন্য বর্তমান প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা বেশির ভাগ সময় অতিবাহিত করছেন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। এ জন্য অনেকেই এগুলোর নামই হয়তো জানেন না। কিন্তু একসময় এগুলোই ছিল আমাদের আনন্দ-বিনোদন ও সংস্কৃতির অন্যতম মাধ্যম। কোনো এলাকায় যাত্রার আয়োজন মানে অঞ্চলজুড়ে উৎসবের আমেজ। যাত্রা উপলক্ষে নানা ধরনের খাবারের পসরা নিয়ে বসতেন হরেক রকমের দোকানি। চলত রাতভর যাত্রাপালা। দর্শকেরা যাত্রার রাজা-বাদশাদের অভিনয় দেখে কল্পনায় নিজেদের ওই সব চরিত্রে অনুভব করতেন। যাত্রা শেষে বাড়ি ফেরার পথে সংলাপগুলো আওড়ানোর চেষ্টা করতেন। এ সব আয়োজনে দর্শকেরা ব্যাপকভাবে সাড়া দিতেন, উপচে পড়া ভিড় জমত যাত্রা প্যান্ডেলের সামনে টিকিট কাউন্টারে। অনেকেই টিকিট না পেয়ে যাত্রা না দেখে বাড়ি ফিরতেন ক্ষুণ্ন মনে। যাত্রা শুরুর আগে প্রবেশ পথে ঝুলত ‘হাউসফুল’ লেখা। ৯০ দশকের বাংলা সিনেমার প্রেক্ষাগৃহগুলোতে প্রদর্শনীর পূর্বে হাউসফুল লেখা ঝুলত প্রায় প্রতি শোতে। অবশ্য এখন হাউসফুল লেখা ঝুলতে দেখাটা রীতিমতো সৌভাগ্যের বিষয়! অবশ্য অশ্লীলতার অভিযোগও যাত্রা হারিয়ে যাওয়ারও একটি কারণ।

পলাশীপুরাণ যাত্রাপালার পোস্টার। ছবি: লেখক
পলাশীপুরাণ যাত্রাপালার পোস্টার। ছবি: লেখক

এমন হাউসফুল লেখা ঝুলতে দেখা গেছে ‘পলাশীপুরাণ’ নামে দুই দিনব্যাপী (২ ও ৩ ফেব্রুয়ারি) হয়ে যাওয়া যাত্রা শোতে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের আয়োজনে সিকানদার আবু জাফরের নাটক ‘সিরাজউদ্দৌলা’ অবলম্বনে প্রদর্শিত হয় ‘পলাশীপুরাণ’ যাত্রাপালা। বিশ্ববিদ্যালয়ে এমন ঐতিহ্যবাহী আয়োজন ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল শিক্ষার্থীদের মাঝে। টিকিট কেটে যাত্রা দেখেছে সবাই। এমনকি টিকিট না পেয়ে ফিরে গেছেন অনেক দর্শক। সমগ্র পালা উপভোগ করেছেন দর্শকেরা। এমন আয়োজন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় বেশি বেশি হওয়া দরকার—পালা দেখা দর্শকদের উপলব্ধি। এ যাত্রার টিকিটের দাম ছিল বাংলার মাটি ৩০ টাকা, সাধারণ কেদারা ১০০ টাকা, আরাম কেদারা ৫০০ টাকা। দর্শক আসনে ছিল শিশু থেকে শুরু করে প্রায় সব বয়সী মানুষ। পালা উপভোগ করেছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এম আবদুস সোবহান। তিনি বলেন, ‘আমার যত দূর মনে পড়ে প্রায় ৫০ বছর পর যাত্রা দেখছি। এমন আয়োজন বেশি বেশি হওয়া দরকার।’

‘পলাশীপুরাণ’ প্রদর্শিত হয় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শেখ রাসেল স্কুল মাঠে। খোলার মাঠে প্যান্ডেল করে আয়োজনের বন্দোবস্ত করা হয়। প্রায় এক হাজার দর্শক একসঙ্গে উপভোগ করেছেন পালাটি। পোশাক, মেকআপ, সংগীত, আলো, সংলাপ, অভিনয়—মঞ্চে ছিল পুরো যাত্রার ঢং। এ পালার অভিনেতা-অভিনেত্রীরা ছিলেন নাট্যকলা বিভাগের ১৮তম ব্যাচের শিক্ষার্থী। এটা তাঁদের পরীক্ষার প্রযোজনা ছিল। যাত্রাপালাটি নির্দেশনা দিয়েছেন বিভাগের চেয়ারম্যান রহমান রাজু।

এ শিক্ষার্থীদের যাত্রাদলের নাম দেওয়া হয়েছিল অদম্য-১৮ অপেরা। তাঁদের স্লোগান ছিল, ‘এ যাত্রায় মুখ ফেরানোর কিছু নেই’। সত্যি তাঁদের উপস্থাপনা কাউকে বিমুখ করেনি। এ পালা শুধু বিশ্ববিদ্যালয় পরিবারকেই আলোড়িত করেনি, পুরো রাজশাহী শহরের সংস্কৃতিমনা মানুষ ছিলেন দর্শকাসনে। তাঁদের দাবি, এমন আয়োজন প্রতিনিয়ত হওয়া দরকার। এতে আমাদের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্য টিকে থাকবে।

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, নাট্যকলা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। শিক্ষক, আর্ট অব লিভিং, ড্যাফোডিল ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি।