রেডিওর সংবাদ-অনুষ্ঠানে বৈচিত্র্য থাকতে হবে

বাংলাদেশসহ বিশ্বে সবচেয়ে প্রাচীন এবং বৃহৎ গণমাধ্যম হিসেবে বেতার অধিক সমাদৃত।
বাংলাদেশসহ বিশ্বে সবচেয়ে প্রাচীন এবং বৃহৎ গণমাধ্যম হিসেবে বেতার অধিক সমাদৃত।

তারবিহীন যোগাযোগের অন্যতম মাধ্যম হলো বেতার বা রেডিও। সবচেয়ে প্রাচীন, সহজলভ্য ও একটি শক্তিশালী গণমাধ্যম হিসেবে বেতার পৃথিবীব্যাপী বহুল পরিচিত। ১৯২০ সালে আমেরিকায় সর্বপ্রথম বেতার সম্প্রচার হয়। বর্তমানে সর্বত্রই বেতার প্রযুক্তির ব্যবহার চলছে।

মোবাইল ফোনসহ তারবিহীন যেকোনো যোগাযোগের মূলনীতিই হলো বেতার। এমনকি বেতার তরঙ্গ ব্যবহার করে মহাকাশ পর্যবেক্ষণে ব্যবহৃত হয় বেতার দূরবীক্ষণ যন্ত্র বা রেডিও টেলিস্কোপ।

শক্তিশালী এই গণমাধ্যমের গুরুত্ব অনুধাবন করে ইউনেসকো ২০১২ সালে প্রথম ‘বিশ্ব বেতার দিবস’ পালনের ধারণা দেয়। এরপর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় দিবসটি বিশ্বব্যাপী ‘বিশ্ব বেতার দিবস’ হিসেবে পালনের স্বীকৃতি পায় । ২০১২ সাল থেকেই নিয়মিত ১৩ ফেব্রুয়ারি বিশ্বে ‘বিশ্ব বেতার দিবস’ পালিত হয়ে আসছে। এ বছরও বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। এবারের প্রতিপাদ্য হলো ‘বেতার ও বৈচিত্র্য (Radio and Diversity)’। এ প্রতিপাদ্যে বিভিন্ন রকম অনুষ্ঠান সম্প্রচারের মাধ্যমে বেতারকে সবার কাছে পৌঁছে যাওয়ার ইঙ্গিত করা হয়েছে। অর্থাৎ জাতি-ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ-বয়স-পেশানির্বিশেষে সবার জন্য উপযোগী বেতার অনুষ্ঠান পরিকল্পনার প্রতি অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে এবারের বিশ্ব বেতার দিবসে। এতে শক্তিশালী এ গণমাধ্যমটির আগামী দিনের পথচলা আরও মসৃণ হবে।

ইউনেসকোর মহাপরিচালক আদ্রে আজলে বিশ্ব বেতার দিবসে তাঁর বার্তায় বলেছেন, ‘আমরা রেডিওর শক্তি ব্যবহার করে, সব ক্ষেত্রে বৈচিত্র্যপূর্ণ অনুষ্ঠান এবং চিন্তার প্রতিফলন ও উন্নয়ন ঘটাতে চাই।’

প্রবল প্রযুক্তিনির্ভর এই সমাজেও বেতার তার জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা ধরে রেখে এগিয়ে চলছে। সহজলভ্যতা এবং বহনযোগ্যতার কারণেই বিশ্বব্যাপী বেতার সগৌরবে টিকে আছে এবং থাকবেও অনন্তকাল। ইন্টারনেট লাইভ স্ট্রিমিং এবং ফেসবুক, ইউটিউব অডিও-ভিডিও লাইভ শোনা-দেখার সুবিধা থাকায় সব শ্রেণির শ্রোতার কাছেই পৌঁছে যাচ্ছে আজকের বেতার।

বাংলাদেশে বেতার বলতে সরকারি নিয়ন্ত্রণে পরিচালিত বাংলাদেশ বেতারকেই বোঝানো হতো। কিন্তু ২০০৭ সালের পর বেসরকারি উদ্যোগে প্রাইভেট এফএম রেডিও (২৭টি) এবং কমিউনিটি রেডিও (১৯টি) স্টেশনগুলো চালু হলে আদেশে বেতার ভিন্ন মাত্রা পেতে শুরু করে। বর্তমানে প্রায় ২৭টি প্রাইভেট এফএম স্টেশন রাজধানী ঢাকাকেন্দ্রিক তাদের কার্যক্রম চালাচ্ছে। এর মধ্যে মাত্র গুটিকয়েক চ্যানেল ঢাকার বাইরে প্রায় সব বিভাগীয় শহরে সম্প্রচার হয়। ইনফোটেইনমেন্টের পাশাপাশি খুব সম্প্রতি ৩-৪ টি প্রাইভেট এফএম স্টেশন নিয়মিত বাংলাদেশ দলের ক্রিকেট ম্যাচগুলোর ধারাভাষ্যও সম্প্রচার করছে। সুতরাং বেতার এবং স্পোর্টস একটি নতুন সম্ভাবনা। একে সঠিক দিকনির্দেশনায় এগিয়ে নিয়ে যেতে পারলে ভবিষ্যতে এ ক্ষেত্রটি সমৃদ্ধ হতে পারে বলে সংশ্লিষ্টরা মনে করেন।

বিশ্ব বেতার দিবস ২০২০-এ ইউনেসকো রেডিও স্টেশনগুলোকে তাদের অনুষ্ঠান নির্মাণ, পরিকল্পনা এবং সম্প্রচারের ক্ষেত্রে বৈচিত্র্য বজায় রাখার আহ্বান জানিয়েছে। বিশেষ করে নিউজ রুমে এবং এয়ারওয়েভসে (সম্প্রচার ফ্রিকোয়েন্সিতে) বৈচিত্র্য ধরে রাখতে অনুরোধ করেছেন। এবারের প্রতিপাদ্যে তিনটি বিষয়ের ওপর অধিক গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। এগুলো হলো—

বেতারের অনুষ্ঠান সবার জন্য অংশগ্রহণমূলক করা
বেতার সব সময় সবখানে সবার জন্য—স্লোগানটি মনে রেখে, সব শ্রেণি/পেশার শহর/মফস্বলের সব স্থানের শিল্পী/পারফরমারকে সমান গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলা হয়েছে। সব ধরনের শ্রোতার কথা চিন্তা করেই অনুষ্ঠান পরিকল্পনা করতে হবে এবং সবার অংশগ্রহণমূলক মনোভাব এ ক্ষেত্রে বিশেষ গুরুত্ব বহন করে।

সংবাদকক্ষে প্রতিনিধিত্বমূলক মনোভাব উদ্বুদ্ধ করা
বেতারের সংবাদকক্ষে সমাজের সব শ্রেণি এবং গ্রুপের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করতে হবে। এখানে সংবাদ পরিবেশনের ক্ষেত্রে সব গ্রুপের সবার তথ্য চাহিদা এবং পছন্দের প্রতি সমান গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে। সংবাদকক্ষের বৈচিত্র্য নিশ্চিত করতে পারলে সব শ্রোতার চাহিদা এবং প্রয়োজনমাফিক সংবাদ সংগ্রহ এবং পরিবেশন করা যায়, যা সমাজে ওই রেডিও স্টেশনের গ্রহণযোগ্যতা এবং জনপ্রিয়তা বাড়িয়ে দেয়। ভিন্ন চিন্তা, গল্প, বিষয় পুরো অনুষ্ঠানে আনবে ভিন্নতা এবং বৈচিত্র্য, যা ভিন্ন ভিন্ন গ্রুপের শ্রোতাকে আকৃষ্ট করতে সক্ষম। আর তখনই বেতার শক্তিশালী গণমাধ্যম হিসেবে শ্রোতাদের কাছে অধিক জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।

প্রবল প্রযুক্তিনির্ভর এ সমাজেও বেতার জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা ধরে রেখে এগিয়ে চলছে।
প্রবল প্রযুক্তিনির্ভর এ সমাজেও বেতার জনপ্রিয়তা এবং গ্রহণযোগ্যতা ধরে রেখে এগিয়ে চলছে।

সম্পাদকীয় সামগ্রী এবং অনুষ্ঠান নির্মাণে বৈচিত্র্য অগ্রাধিকার দেওয়া
আমরা জানি প্রতিটি গণমাধ্যমের নিজস্ব চিন্তা এবং ধ্যানধারণা থাকে। সম্পাদকীয়ের মধ্যে তার প্রতিফলন ঘটানোর সুযোগ গ্রহণ করেন। কিন্তু বিশ্ব বেতার দিবসের এবারের থিম অনুযায়ী বৈচিত্র্য নিশ্চিত করতেই হবে। হোক সেটা সম্পাদকীয় ম্যাটার কিংবা সাধারণ ইনফোটেইনমেন্ট অনুষ্ঠান, সর্বত্রই বৈচিত্র্য আনতে হবে এবং সবার চিন্তা ও চাহিদার প্রতিফলন ঘটাতে হবে কনটেন্টের মাধ্যমে।

বেতার ও বৈচিত্র্য প্রতিপাদ্য বিষয়টি শুধু কনটেন্ট বা সম্পাদকীয় আইটেমের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য তা নয়। বরং বেতার সম্প্রচার ফ্রিকোয়েন্সি এবং সম্প্রচার প্রযুক্তির বৈচিত্র্যের ওপরও সমানভাবে গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যেমন—ডিজিটাল অডিও ব্রডকাস্টিং (ড্যাব)। এ প্রযুক্তির মাধ্যমে বেতার স্টেশনগুলো তাদের অনুষ্ঠানমালা ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে সম্প্রচারের প্রতি আরও মনোযোগী হবে এবং গুরুত্ব দেবে। কারণ বর্তমান প্রজন্ম ইন্টারনেটভিত্তিক পরিবেশে বেড়ে উঠছে এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেই তাদের আনাগোনা বেশি। সুতরাং এ শ্রোতা গ্রুপটিকে টার্গেট করেও বেশ কিছু সমসাময়িক কনটেন্ট ডেভেলপ করা যেতে পারে, যা এই ডিজিটাল প্রজন্মকে ভীষণভাবে আকৃষ্ট করতে পারে। আর এভাবেই বেতার যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে শ্রোতা ধরে রাখার কাজটি কতে পারে। ড্যাব রেডিও প্রযুক্তি একই সঙ্গে নানা রকমের সুবিধা দেয়, যেমন বাড়তি তথ্য, লাইভ দেখা/শোনার সুযোগ, অনুষ্ঠান রেকর্ড করার সুযোগ, ইচ্ছেমতো গান শোনার সুযোগ, চাইলে পজ চাপ দিয়ে প্রয়োজনীয় কাজ সেরে আবার সুবিধামতো শুনতে পারে পছন্দের অনুষ্ঠান। ফলে ড্যাব প্রযুক্তিতে রেডিও শোনায় ভিন্ন মাত্রা যুক্ত হয়েছে, যা প্রচলিত এএম বা এফএম রেডিওতে পাওয়া যায় না।

বেতার মাধ্যমে যেহেতু অনুষ্ঠান নির্মাণ ও সম্প্রচার খরচ অপেক্ষাকৃত কম, তাই চারপাশের অজস্র বিষয়ের মধ্য থেকে সমসাময়িক, জনগুরুত্বপূর্ণ এবং জনপ্রিয় বিষয়টি বেছে নিয়ে একাধিক রিপোর্ট, ডকুমেন্টারি, টক-শো, বিতর্ক অনুষ্ঠান নির্মাণ করা যেতে পারে। আর এ অনুষ্ঠানগুলো ভিন্ন ভিন্ন চ্যানেলে একাধিক ভাষায় সম্প্রচারের ফলে খুব দ্রুত একটি বেতার অনুষ্ঠান দেশে-বিদেশে মুহূর্তেই সাড়া জাগাতে পারে। এ জাতীয় ধারণা সবার অংশগ্রহণমূলক প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা যায়।

বাংলাদেশে সবচেয়ে প্রাচীন এবং বৃহৎ গণমাধ্যম হিসেবে বেতার অধিক সমাদৃত। দেশব্যাপী সমগ্র শ্রোতাদের কথা বিবেচনা করে কর্তৃপক্ষ নানা রকমের বৈচিত্র্যপূর্ণ অনুষ্ঠান সম্প্রচার করলেও ক্রীড়া ধারাভাষ্য সম্প্রচার বেতারের সবচেয়ে জনপ্রিয় ও শ্রোতানন্দিত অনুষ্ঠান। দেশে-বিদেশে অনুষ্ঠিত গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সব ইভেন্ট সরাসরি সম্প্রচার করার মাধ্যমে বাংলাদেশ বেতার এ দেশের ক্রীড়া উন্নয়নে ধারাবাহিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখছে। ইদানীং বিদেশের মাঠ থেকে বাংলাদেশ বেতার জাতীয় দলের ম্যাচগুলো সরাসরি সম্প্রচার করছে না। ফলে বেতারের ক্রীড়া ধারাভাষ্যের মান এবং জনপ্রিয়তা দুটোই কমতে শুরু করেছে। বিশ্ব বেতার দিবসের শুভক্ষণে বাংলাদেশ বেতারের অগণিত শ্রোতা এ ব্যাপারে তথ্য মন্ত্রণালয় ও বেতার কর্তৃপক্ষের শুভ উদ্যোগ কামনা করেন এবং ক্রীড়া ধারা বর্ণনার মান অক্ষুণ্ন রাখতে অনুরোধ জানান।

বিশ্ব বেতার দিবসের এবারের প্রতিপাদ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য বজায় রেখে বাংলাদেশের সরকারি এবং বেসরকারি সব রেডিও স্টেশন তাদের সংবাদ এবং অনুষ্ঠান প্রণয়ন ও পরিকল্পনায় সব পর্যায়ে বৈচিত্র্যকে প্রাধান্য দেবে, এই প্রত্যাশা আমাদের সবার।

লেখক: ক্রীড়া ভাষ্যকার, বাংলাদেশ বেতার ও টেলিভিশন এবং প্রিন্সিপাল লাইব্রেরিয়ান, বাংলাদেশ পরমাণু শক্তি কমিশন