চাকরি পরীক্ষা: তরুণেরা কি উপযুক্ত পরিচর্যা পাচ্ছেন

সর্বশেষ তিনটি বিসিএসের চাকরিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীদের পর্যালোচনা করলে দেখা যাচ্ছে, গড়ে প্রতি বিসিএসে প্রায় ৫০ হাজার করে প্রার্থী বেড়েছে। ছবি: প্রতীকী
সর্বশেষ তিনটি বিসিএসের চাকরিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীদের পর্যালোচনা করলে দেখা যাচ্ছে, গড়ে প্রতি বিসিএসে প্রায় ৫০ হাজার করে প্রার্থী বেড়েছে। ছবি: প্রতীকী

বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বা জনসংখ্যার সোনালি ধাপের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নিঃসন্দেহে এক সুন্দর সময়ে উপস্থিত দেশ। কিন্তু কষ্টের বিষয়টাও এখানে নিহিত। ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড বলতে এই যে নির্দিষ্ট রেঞ্জের বয়সের এত সব কর্মক্ষম জনসংখ্যা তথা তরুণেরা বাংলাদেশে অবস্থান করছেন, তাঁরা কি তাঁদের উপযুক্ত পরিচর্যা পাচ্ছেন?

কর্মক্ষম অর্থ এই নয়, যেহেতু তাঁরা (তরুণেরা) কাজ করতে পারেন, তাঁরা কাজ করুক। তাঁদের রুচি-অরুচি, পছন্দ-অপছন্দ বাদ দিয়ে কেবল কাজ করবেন। এটি কখনো হয় না, হতে পারে না। সব যুগে, সব সমাজে মনের চাওয়া-পাওয়ার বিষয়টি গুরুত্ব পেয়েছে। আবার কাজ করতে চাইলেই কাজ করা যায় না, কাজের উপযুক্ত পরিবেশ থাকাটাও আবশ্যক। প্রতিবছর বাংলাদেশে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে যত ছেলেমেয়ে পড়া শেষ করে বের হচ্ছেন এবং চাকরি বাজারে প্রবেশ করছেন, সেটি প্রতিবছর কেবল রেকর্ডই তৈরি করছে না, বরং আগের রেকর্ড ভেঙে দিচ্ছে।

৩৮, ৪০ ও ৪১তম বিসিএস পর্যালোচনা করলে দেখা যাচ্ছে, গড়ে প্রতি বিসিএসে প্রায় ৫০ হাজার করে প্রার্থী বেড়েছে। সর্বশেষ ৪১তম বিসিএসে আবেদনকারীর সংখ্যাটা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৭৫ হাজার। এ সংখ্যা আবার অনেক দেশের মোট জনসংখ্যার সমান কিংবা বেশি। এ বেশি হারে শিক্ষার্থীদের প্রবেশ কিংবা প্রতিযোগিতা (বিশেষত সরকারি চাকরিতে) কোনোমতেই খারাপ নয়, বরং নিঃসন্দেহে ভালো। কেননা, এতে অপেক্ষাকৃত বেশি হারে মেধাবী ও যোগ্য কর্মী পাবে সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো। ভালো চাকরি পাওয়া যেমন তরুণদের স্বপ্ন, তেমনি ভালো কর্মী পাওয়াও সরকারি কিংবা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রত্যাশা। নিদারুণ বাস্তবতার কঠিন ছোবল খাচ্ছে শিক্ষিত তরুণ বেকার সমাজ।

আরও দুঃখের ব্যাপার হচ্ছে, এ ব্যাপারে উচ্চমহলের তেমন কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। কতিপয় দু-চারটা চাকরির পরীক্ষা ছাড়া বাকি সব পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হচ্ছে ঢাকায়। ঢাকায় পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হওয়ার কারণে একটা সাধারণ ঘরের ছেলেমেয়ের পক্ষে সেই পরীক্ষা দেওয়াটা যে কতটা কষ্টের, তা কেবল ওই শিক্ষার্থীই জানে। যদি এ ক্ষেত্রে সমস্যাগুলো একটু পর্যালোচনা করি, তাহলে যে সমস্যাগুলো সামনে আসে তা হলো—

নিরাপত্তার সমস্যা
ছেলেদের চেয়ে মেয়েদের এ ক্ষেত্রে ব্যাপক সমস্যার মুখোমুখি হতে হয়। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে অসংখ্য ছেলেমেয়ে জীবনের তাগিদে, ক্যারিয়ার গড়ার প্রত্যয়ে ঢাকায় আসেন বা তাঁদের আসতে হয়। এসব ছেলেমেয়ের অনেকেরই ঢাকায় বসবাসরত কোনো নিকটাত্মীয় নেই, এমনকি কোনো পরিচিত মানুষও নেই। উপায়হীন হয়ে একটা ছেলে কমলাপুর রেলস্টেশনে রাত যাপন করতে পারেন। কিন্তু মেয়েদের পক্ষে তা কি সম্ভব? আর পারলেও সেটি কতটা নিরাপদ। কতজন অভিভাবক জেনেশুনে এ রকম পরিস্থিতিতে তাঁদের সন্তানদের ঢাকায় পরীক্ষা দিতে যেতে দেবেন? আবার দু-একটা পরীক্ষা এ রকম বিপদের মুখে দিলেই যে তিনি চাকরি পেয়ে যাবেন, এ নিশ্চয়তাও নেই। তাই অনেকে নারী, এমনকি অনেক পুরুষ শিক্ষার্থী ঢাকায় অনুষ্ঠিত পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করা থেকে বিরত থাকেন।

চাকরিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার জন্য ঢাকা যাওয়াটা কষ্টের। ছবি: প্রতীকী
চাকরিপ্রত্যাশী শিক্ষার্থীদের পরীক্ষার জন্য ঢাকা যাওয়াটা কষ্টের। ছবি: প্রতীকী

আর্থিক সমস্যা
প্রায় সব পরীক্ষা ঢাকায় অনুষ্ঠিত হওয়ায় চাকরিপ্রার্থী ছেলেমেয়েদের জন্য উচিত কার্য হলো ঢাকায় থাকা। বাস্তবিক পক্ষে দেশের লাখো চাকরিপ্রত্যাশী ছেলেমেয়ের ঢাকায় থাকাটা কি সম্ভব? ঢাকার জীবন কি সহজলভ্য? আবার যাঁরা হতদরিদ্র পরিবার থেকে আসা, তাঁদের পরীক্ষা দেওয়ার জন্য ঢাকা আসাটা কীভাবে সম্ভব। ছাত্রজীবন কোনোমতে পাড়ি দেওয়ার জন্য বাসায় বাসায় টিউশন করে তিন থেকে চার হাজার টাকা উপার্জন যাঁর কঠিন ছিল (ঢাকা ব্যতীত অন্যান্য শহরে), তিনিই এরপর নিজের প্রয়োজনীয় ব্যয়, পরিবারের প্রয়োজন, চাকরির পরীক্ষার ফি দেওয়া, মাসে দু-তিনবার ঢাকা যাওয়ার হ্যাপা কীভাবে সামলাবেন? ঢাকা থেকে অন্যান্য জেলার দূরত্ব অনুযায়ী যাতায়াত বাবদ খরচ কমবেশি হতে পারে। কেবল যদি কুড়িগ্রাম টু ঢাকা যাতায়াত বাবদ খরচ হিসাব করা হয়, তবে সেটি দুই থেকে আড়াই হাজার টাকার নিচে নয়। আর ঢাকায় মাসে দু–তিনবার যেতে হলে মাসিক ব্যয় একবার চিন্তা করুন। নিজের নিত্যপ্রয়োজন মেটানো, পরিবারের প্রয়োজন মেটানো, পরীক্ষার ফি দেওয়া এবং ঢাকা যাওয়া–আসা, সব মিলিয়ে ওই বেকার ছেলে বা মেয়ের জন্য মাসে ১২ থেকে ১৪ হাজার টাকার চিন্তা মাথায় রাখতে হয়। এখন প্রশ্ন হলো এসব চাকরিপ্রত্যাশীর কোনো উপার্জন নেই, কর্মসংস্থান নেই, তাঁরা কীভাবে প্রতি মাসে এত টাকার চাপ সামলাবেন? কীভাবে নিজের পড়াশোনা করে এই তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরীক্ষায় নিজের মেধার স্বাক্ষর রাখবেন। এত অর্থের চাপ সামলানো এবং তীব্র প্রতিযোগিতাপূর্ণ পরীক্ষায় কোয়ালিফাই করার জন্য তীব্র পড়াশোনা করাটা তাই অনেকাংশে হয়ে ওঠে না বেকার ও গরিব ছেলেমেয়েদের। যে কারণে হয়তো সচ্ছল পরিবারের চেয়ে পিছিয়ে পড়ছেন অসচ্ছল পরিবারের ছেলেমেয়েরা। হয়তো এ কারণে যোগ্যতা থাকার পরেও অনেক ছেলেমেয়ে নিজের অদৃষ্টকে দোষ দিয়ে এ কণ্টকাকীর্ণ পথ ছেড়ে দিচ্ছে চোখের জলে। এসব ছেলেমেয়ের হৃদয়ের হাহাকারের দায়ভার নেওয়ার কেউ নেই। তবে কি এ পথটা গরিবের নয়?

শারীরিক ও মানসিক ভোগান্তি
একজন ছাত্রের দুঃসহ জীবনের শুরু হয় লেখাপড়া শেষে চাকরির যুগে প্রবেশ করতে গিয়ে। আর এ চাকরির ক্ষেত্রে দেখা যায়, ঝাড়ুদার থেকে অফিসার পর্যন্ত প্রায় সব চাকরির পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয় ঢাকায়। বাংলাদেশের দূরবর্তী উপজেলা কিংবা জেলা থেকে আসা ছেলেমেয়েরা শারীরিক ও মানসিক ভোগান্তির শিকার হন। এ ছাড়া সড়ক দুর্ঘটনা তাঁদের জীবনে একটা আতঙ্ক হয়েই থাকে। ঢাকা থেকে ফিরে না আসা পর্যন্ত তাঁদের মা–বাবার উৎকণ্ঠা শেষ হয় না।

অথচ কর্তৃপক্ষ কিংবা ওপর মহল মানবিক দৃষ্টির দুয়ার খুললে সব পরীক্ষা কমপক্ষে বিভাগীয় পর্যায়ে নিতে পারে। এতে এই লাখো ছেলেমেয়ের ভোগান্তি কমার পাশাপাশি পরীক্ষা দিতে কমত ব্যয়। ছেলেদের পাশাপাশি মেয়েরাও সব পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করতে পারতেন। গরিব বলে অসংখ্য ছেলেমেয়ে নীরবে চোখের জল ফেলতে হতো না। আর সবাই নিজেদের যোগ্যতা প্রদর্শনের সমান সুযোগ পেতেন এবং সেই সঙ্গে নিজের ও পরিবারের স্বপ্ন পূরণ করতে পারতেন।