বিড়ালপ্রেমী মাহমুদুল হাসানের গল্প

মাহমুদুল হাসান বিড়ালছানাগুলোর দেখভাল করেন। মাছ ও গরুর দুধ কিনে খাওয়ান। ছবি: লেখক
মাহমুদুল হাসান বিড়ালছানাগুলোর দেখভাল করেন। মাছ ও গরুর দুধ কিনে খাওয়ান। ছবি: লেখক

১৬ ফেব্রুয়ারি সকাল ১০টা। শীতের স্বর্ণালি রোদ চিকমিকিয়ে আলো ছড়াচ্ছে। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের (রাবি) হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দী হলের তৃতীয় ব্লকের দ্বিতীয় তলায় ঠিকরে পড়ছে সেই আলো। রংচটা ব্লকের করিডরটিতে হাতলভাঙা একটি চেয়ারে হাত-পা ছড়িয়ে এলোমেলো ভঙ্গিমায় শুয়ে আছে চারটি বিড়ালছানা। হয়তো শীতের সকালে সূর্যস্নান করছে বিড়ালছানাগুলো।

করিডর দিয়ে অনেকেই যাতায়াত করছেন। তবে বিড়ালছানাদের ভ্রুক্ষেপমাত্র নেই সেদিকে। এরই মধ্যে একজনের আগমন। নাম মাহমুদুল হাসান শাকিল। তাঁকে দেখেই আড়মোড়া ভাঙল বিড়ালছানাদের। গা–ঝাড়া দিয়ে চেয়ার থেকে নেমেই দৌড়ে এগিয়ে গেল তাঁর দিকে। চারপাশ থেকে ঘিরে নিল। যেন তাঁরই অপেক্ষা করছিল বিড়ালছানাগুলো।

বেশ আগ্রহ নিয়ে বিষয়টি দেখলাম। এরই মধ্যে বিড়ালছানাগুলোও মাহমুদুল হাসানের সামনে এসে বিনয়ীর মতো বসে পড়ল। দেখেই বোঝা যাচ্ছে, চাতক পাখির মতো কিছু একটা পাওয়ার আশা করছে তারা। ঠিক তখনই হাতে থাকা পলিথিনের ব্যাগটি খুলে ফেললেন মাহমুদুল হাসান। পলিথিনের ভেতর থেকে মাছের ফুলকা, মাথার উচ্ছিষ্ট কিছু অংশ বের করে খেতে দিলেন বিড়ালছানাদের।

এখানেই শেষ নয়; খানিক বাদে মাহমুদুল হাসান যা করলেন, তা দেখে অবাক হতে বাধ্য হলাম। পলিথিনে থাকা কয়েক টুকরা মাছ বের করে তিনি সেগুলো রান্নার উপযোগী করে ধুয়ে নিলেন। ভাবলাম হয়তো সেগুলো রান্না করবেন তিনি। কিন্তু না, ধোয়ার পর তিনি মাছের টুকরাগুলো নিজ হাতে বিড়ালছানাদেরই খাওয়ালেন। পেটপুরে খেল বিড়ালছানাগুলো। দৃশ্যটি দেখে মাহমুদুল হাসানের চোখ-মুখে তৃপ্তির হাসি খেলা করছে।

মাহমুদুল হাসান শীতে যেন বিড়ালছানাগুলোর কষ্ট না হয় সে জন্য বিছিয়ে দিয়েছেন কাপড়। মশার উপদ্রবে যেন বিড়ালের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে, সে জন্য প্রতিরাতে কয়েল জ্বালিয়ে দেন। ছবি: লেখক
মাহমুদুল হাসান শীতে যেন বিড়ালছানাগুলোর কষ্ট না হয় সে জন্য বিছিয়ে দিয়েছেন কাপড়। মশার উপদ্রবে যেন বিড়ালের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে, সে জন্য প্রতিরাতে কয়েল জ্বালিয়ে দেন। ছবি: লেখক

আজকাল মানুষের জন্য মানুষেরই এমন সহানুভূতি দেখা যায় না। অথচ অবলা প্রাণীর জন্য মাহমুদুল হাসানের অবর্ণনীয় মায়া। আগ্রহ নিয়ে এগিয়ে গেলাম। জানলাম, মাহমুদুল হাসান এই ব্লকেই থাকেন। তাঁর বাড়ি সিরাজগঞ্জে। লেখাপড়া করছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগে। লেখাপড়ার পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহসভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন তিনি। বাজার থেকে আলাদাভাবে বিড়ালছানাগুলোর জন্য খাবার নিয়ে আসেন। এ জন্য প্রতিদিন কিছু টাকা বরাদ্দ রাখেন তিনি। এই টাকায় কোনো দিন মাছ, কোনো দিন আবার গরুর দুধ নিয়ে আসেন বিড়ালছানাগুলোর জন্য।

মাহমুদুল হাসান বলছিলেন, ‘শখের বশেই আমি বিড়ালছানাগুলোকে খাওয়াই। বিড়ালছানাগুলোকে খাইয়ে দিতে, গোসল করিয়ে দিতে আমার খুবই ভালো লাগে। এ বিড়ালছানাদের শুধু আমি না, এ ব্লকের অনেকেই তাদের যত্ন করেন।’

গল্পে গল্পে মাহমুদুল হাসান বলছিলেন, একদিন বিড়ালছানাগুলোকে খেতে দিয়ে তিনি রুমের ভেতরে গিয়েছিলেন। তখন বাইরে থেকে একটি বিড়াল এসে খাবার কেড়ে নেওয়ার চেষ্টা করে। পরে বাইরের বিড়ালটির আঘাতে একটি বিড়ালছানার পা মচকে যায়। এতে কষ্ট হয়। পরে যত্ন পেয়ে বিড়ালছানার পা অনেকটাই ভালো হয়ে যায়। এরপর থেকে বিড়ালছানাদের খাওয়া শেষ না হওয়া পর্যন্ত পাশে বসে থাকেন ওই শিক্ষার্থী।

বিড়ালছানাগুলোর সঙ্গে মাহমুদুল হাসান। ছবি: লেখক
বিড়ালছানাগুলোর সঙ্গে মাহমুদুল হাসান। ছবি: লেখক

বিড়ালপ্রেমী মাহমুদুল হাসানের গল্প এখানেই শেষ নয়; অবাক করার মতো আরও গল্প রয়েছে তাঁর। বিড়ালছানাগুলো যেন আরামে রাত্রিযাপন করতে পারে সে জন্য কাগজের কার্টন দিয়ে ঘর তৈরি করে দিয়েছেন। শীতে যেন বিড়ালের কষ্ট না হয়, সে জন্য কার্টনের ভেতর বিছিয়ে দিয়েছেন কাপড়। মশার উপদ্রবে যেন বিড়ালের ঘুমের ব্যাঘাত না ঘটে, সে জন্য প্রতি রাতে কয়েল জ্বালিয়ে দেন।

বিড়ালছানাগুলোও সারা দিন পুরো ব্লকের শিক্ষার্থীদের মাতিয়ে রাখে। কেউ কেউ বিড়ালছানাগুলোর সামনে এসে ‘ম্যাও’ ‘ম্যাও’ করে ডাকেন। অমনি লাফিয়ে তাঁর কোলে উঠে পড়ে বিড়ালছানাগুলো। বিড়ালছানাগুলোকে নিয়ে নানান খেলা খেলেন শিক্ষার্থীরা।

বিড়ালেরও যে ক্ষুধা আছে, সেটা আমরা সবাই জানি। কিন্তু কয়জনই–বা সেটা নিয়ে ভাবি, কয়জনই–বা একটুখানি খাবার তুলে দিই এদের মুখে?

লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়