বইমেলার সার্থকতা সংখ্যায় না মানের আশঙ্কায়

বইমেলায় দোকানে বইয়ের সারি। ছবি: আবদুস সালাম
বইমেলায় দোকানে বইয়ের সারি। ছবি: আবদুস সালাম

বাংলার ইতিহাস-ঐতিহ্যের অনুষঙ্গই শুধু নয়, বরং তার চেয়েও বেশি কিছু, বায়ান্ন ফেব্রুয়ারি, যে মাসের ২১ তারিখ তাৎপর্যপূর্ণ একটি দিন বাংলার রাজনীতি, তথা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের। ১৪৪ ধারার বেড়া ডিঙানো সেই ঐতিহাসিক দিনটিই পরবর্তী সময়ে স্বাধীন রাষ্ট্র ‘বাংলাদেশ’ গড়ার শুভসূচনা।

১৯৭২ সালের ফেব্রুয়ারিতে শুরু হওয়া বাংলাদেশের ইতিহাসের প্রথম বইমেলা, ১৯৮৪-তে ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ নামে পরিচিতি লাভ করে। সেই ‘অমর একুশে গ্রন্থমেলা’ আজ দিনে দিনে পরিণত। একটুকরো চটের ওপর ৩২টি বইয়ের সমাবেশ খুব বড় কিছু ছিল না, তবে গোড়াপত্তনের জন্য ছিল যথেষ্ট, যার ফল আজকের বিস্তৃত মেলা প্রাঙ্গণ।

কবি-সাহিত্যিকদের কেউ জন্ম দেয় না, তাঁদের জন্ম হয়। বাংলা সাহিত্য আজ যতটুকু পূর্ণতা লাভ করেছে, তা সেই ক্ষণজন্মাদের হাত ধরেই তাঁদের সাহিত্যকর্ম সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছেছে। এ সৃষ্টিকর্ম মানুষকে করেছে বিমোহিত। সবার কাছে এই সাহিত্যকর্ম পৌঁছে দিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম প্রাণের মেলা বইমেলা, বলাই বাহুল্য।

তবে একধরনের বাহুল্যদোষের দুষ্টতা আজকের দিনে পাঠকদের খানিকটা ভাবিয়ে তুলেছে। যে বইমেলা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকার ছোট একটি প্রাঙ্গণ থেকে শুরু হয়ে আজ বিরাট কলেবরে সেজেছে, তার পেছনে অসংখ্য প্রকাশনী, অগণিত বইয়ের সমারোহ শুভেচ্ছা পাওয়ার দাবি রাখে। তবে গুণগত মানের শতভাগ নিশ্চয়তার প্রশ্নবোধক ‘?’ চিহ্নটি নজর কাড়ছে সাহিত্যবোদ্ধাদের। এই প্রশ্নের অবতারণা কিছুদিন যাবৎ হয়ে আসছে। সুতরাং এর যৌক্তিক কারণটি বোধ হয় খতিয়ে দেখার সময় এসেছে। বাংলা সাহিত্যের এক সোনালি যুগে আমরা পেয়েছিলাম বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, জসীমউদ্‌দীন প্রমুখ ক্ষণজন্মা ব্যক্তিত্ব।

নানান বয়সের বইপ্রেমী এসেছেন মেলায়। ছবি: আবদুস সালাম
নানান বয়সের বইপ্রেমী এসেছেন মেলায়। ছবি: আবদুস সালাম

কালক্রমে ম্লান হয়নি সুফিয়া কামাল, শহীদুল্লা কায়সার, মুনীর চৌধুরী, জহির রায়হান, শামসুর রাহমানসহ অসংখ্য গুণী মানুষের সাহিত্যচর্চা। এই চর্চায় হুমায়ুন আজাদ, হুমায়ূন আহমেদ, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, সৈয়দ শামসুল হক, সমরেশ মজুমদার প্রমুখ সাহিত্যিকের সম-রেশ বহাল তবিয়তে থাকলেও বর্তমান সময়ে আধুনিক লেখার ‘মানে’ যে খানিকটা ভাটা পড়েছে, তার কিছুটা হলেও আঁচ পাওয়া যায় পাঠকদের রুচিবোধে দৃষ্টিপাত করলে।

এবারের বইমেলায়ও দেখা গেছে পুরোনো বইয়ের চাহিদা। একটা সময় যেখানে দেখা যেত বিভিন্ন প্রকাশনীর স্টলগুলোর সামনে উপচে পড়া ভিড়, শুধু লেখকের নতুন বইটি হাতে পাওয়ার জন্য, এখন সেই ভিড়ের বদলে স্টলের সামনে পাতা উল্টে বই ও লেখকের মান যাচাই করতে দেখা যায় দর্শনার্থীদের। মানসম্মত বইয়ের বিশ্বাসে কিছুটা ভাটা তো এখানেই অনুমেয়। মানের চেয়ে সংখ্যার গুরুত্বের আধিক্যটাই চোখে পড়ার মতো। অনেক নবীন কবি-ঔপন্যাসিকের লেখা কবিতা, উপন্যাস, ছোটগল্পের সংখ্যাটা এতটাই বেশি যে শুনতে খানিকটা শ্রুতিকটুই লাগে। কিন্তু এটাও ঠিক, লেখকদের কোনোরূপ শিকলে বাঁধা অনুচিত। সাহিত্যের প্রসার ঘটবে শুধু লেখার মাধ্যমেই। লেখার অভ্যাসটাই একজন লেখককে নিয়ে যাবে শীর্ষে, ফলে আমরা পাব সুন্দর সময় কাটানোর সেরা উপকরণ। কিন্তু অসংখ্য লেখার ভিড়ে সেরাটা খুঁজে পেতে ক্লান্ত পাঠকেরা নতুনের চেয়ে পুরোনোর দিকেই যেন একটু বেশি ঝুঁকছেন। ফলে নতুন প্রতিভাবান লেখকদের খুঁজে পেতে খানিকটা বেগ পেতে হচ্ছে পাঠকদের। তবে নিম্নমানের লেখার প্রসার একটা ভয়ের জন্ম তো দিচ্ছেই। একজন পাঠকের লেখার আগ্রহ জন্ম নেয় ‘বইপড়া’ থেকেই। একজন পাঠক যদি সেই আগ্রহ তাঁর পঠন থেকে না পান, ভবিষ্যতের জন্য হয়তো আমরা একজন সম্ভাবনাময় লেখককে হারাব, নতুবা মানহীন সাহিত্যের প্রভাব মনোজগতে ঢুকে পড়লে সেই জায়গা থেকে একের পর এক সৃষ্টি হবে নীরস কর্মযজ্ঞ।

মেলার শুরু থেকেই ক্রেতাদের বই দেখা। ছবি: আবদুস সালাম
মেলার শুরু থেকেই ক্রেতাদের বই দেখা। ছবি: আবদুস সালাম

এ ক্ষেত্রে দায়িত্ববোধের জায়গাটা লেখকের চেয়ে বেশি প্রকাশকদের। কিন্তু সেখানেও আরেক বাধা। কমার্শিয়াল বা পেশাদার দৃষ্টিভঙ্গি আশাভঙ্গেরই কারণ হয় কিছু কিছু ক্ষেত্রে। সেই পেশাদারি মনোভাব লক্ষ করা যায় স্বয়ং নবীন লেখকদের মধ্যেও। অতিরঞ্জিত প্রচার—যা কিনা তাঁর ব্যক্তিত্বের সঙ্গে বেমানান। সোনালি যুগের জায়গাটা পেশাদার যুগেই যেন পদার্পণ করতে আটঘাট বেঁধে নেমেছে। এ থেকে উত্তরণের জন্য ভাবতে হবে, ভাবতে হবে সংশ্লিষ্টদের। লেখার মান সমুন্নত রাখার প্রত্যয়ে সাহিত্যবোদ্ধাদের আরও খানিকটা এগিয়ে আসা জরুরি। দাবিটা অগণিত পাঠকের, দাবিটা সময়েরও।

*লেখক: শিক্ষার্থী, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়