রবীন্দ্রনাথের আদিবাড়ি ও শ্বশুরবাড়ি ভ্রমণ

রূপসা নদী পেরিয়ে ওপারে পিঠাভোগ গ্রামে। ছবি: লেখক
রূপসা নদী পেরিয়ে ওপারে পিঠাভোগ গ্রামে। ছবি: লেখক

হঠাৎ দুলে উঠল নৌকা। ভাসছি রূপসা নদীতে। পুলকিত! যাচ্ছি ওপারে পিঠাভোগ গ্রামে। যেখানে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষের বাড়ি। ‘কুশরী’ থেকে ‘ঠাকুর’। পিঠাভোগ থেকে জোড়াসাঁকো। দক্ষিণডিহি থেকে শান্তিনিকেতন।

খুলনার রূপসা। নদী পেরিয়ে ওপারে পৌঁছালাম। মাহিন্দ্রতে চড়ে রূপসা উপজেলা সদর কাজদিয়ায়। আট কিলোমিটার গ্রামের নিরিবিলি গ্রামীণ রাস্তা পেরিয়ে কাজদিয়া। এরপর অটোভ্যানে তিন কিলোমিটার দূরের পিঠাভোগ।

বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষের বাড়ি। ছবি: লেখক
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পূর্বপুরুষের বাড়ি। ছবি: লেখক

মূল সড়কের সঙ্গেই তোরণ। কলকাতার জোড়াসাঁকোর আদলেই তৈরি। রং বা স্টাইল। তবে কলকাতার তোরণের মতো ঘিঞ্জি বা সরু নয়। কারণ, ওটা শহরে আর এটা গ্রামে। সবুজের আবহ আছে। ঢুকে গেলাম ক্যাম্পাসে। অবহেলায় রয়েছে। উন্মুক্ত মঞ্চ দেখলাম। সেখানেই রবিঠাকুরের আবক্ষ মূর্তি রয়েছে। এরপর সংগ্রহশালায় ঢুকলাম। একতলাবিশিষ্ট ভবনে পাঠকক্ষও আছে। রবিঠাকুরের ছবি, বংশতালিকা রয়েছে। কবির নবীন প্রজন্মের একজন দেখাশোনা করেন। বাইরে রবিঠাকুরের বংশতালিকা আছে। সেখানে দেখা যায়, কুশরী থেকে কলকাতার পরিবার ঠাকুর পদবি পেয়েছেন। এখানে কবির বর্তমান বংশধরেরা ‘কুশরী’ উপাধি নিয়ে আছেন। খুলনার রূপসা উপজেলা চেয়ারম্যান অবকাঠামো ও সৌন্দর্যবর্ধন উন্নয়নে সর্বাত্মক সহযোগিতা করেন বলে এলাকাবাসী জানান। প্রতিবছর ২৫ বৈশাখে কবির জন্মদিন উপলক্ষে তিন দিনের মেলা হয় এখানে।

লাইব্রেরি বা পাঠকক্ষ আছে। ছবি: লেখক
লাইব্রেরি বা পাঠকক্ষ আছে। ছবি: লেখক

এরপর আবার নদী পেরিয়ে কবির শ্বশুরবাড়ির দিকে যাত্রা শুরু করি। নদী পেরিয়ে যেতে নৌকাভাড়া লাগল পাঁচ টাকা। যাওয়ার সময়ও একই ভাড়া। খুলনা থেকে ২৩-২৪ কিলোমিটার দূরে, বাসে ফুলতলা উপজেলা বাজারে। যশোর-খুলনা রোডে। পাশের বেজেরডাঙ্গায়ও নামা যায়। এরপর অটোরিকশায় তিন–চার কিলোমিটার দূরের দক্ষিণডিহি। রবীন্দ্রনাথের শ্বশুরবাড়ি রয়েছে খুলনার ফুলতলা উপজেলার দক্ষিণডিহি। রবীন্দ্রনাথের ২২ বছর বয়সে বিবাহ হয় দক্ষিণডিহি গ্রামের বেণীমাধব রায় চৌধুরীর মেয়ে ভবতারিণী মৃণালিনী দেবীর সঙ্গে। এখানে জাদুঘর করা হয়েছে। আছে কবি রবিঠাকুরের স্মৃতিচিহ্ন। বৈশাখ মাসে এখানে মেলা হয়। কমপেক্সের দুই তলায় ঝুলবারান্দায় হাওয়া খেতে খেতে মনে পড়ল, ‘তোমার খোলা হাওয়ায়...’।

জোড়াসাঁকোর আদলে পিঠাভোগে রবীন্দ্র তোরণ। ছবি: লেখক
জোড়াসাঁকোর আদলে পিঠাভোগে রবীন্দ্র তোরণ। ছবি: লেখক

দুই তলাবিশিষ্ট এ কমপেক্সের নিচতলায় লাইব্রেরি বা পাঠকক্ষ আছে। বইয়ের সমাহার বেশ ভালো। ওপরতলা বা নিচতলায় তথ্য বোর্ডও আছে। রবিঠাকুরের পেইন্টিংস, হস্তলিপি পাণ্ডুলিপিও আছে। শিলাইদহের মতো সমৃদ্ধ না হলেও বাংলাদেশে রবিঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত পতিসর বা শাহজাদপুর থেকে কম নয়। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন এবং নিরিবিলি পরিবেশ এখানে। কমপ্লেক্সে ঢুকতেই দুই পাশে রবিঠাকুরের দুটি ছোট আবক্ষ ভাস্কর্য শোভা পাচ্ছে। দুই তলাবিশিষ্ট এ ভবন দেখতেও বেশ সুন্দর।

দক্ষিণডিহিতে রবীন্দ্র কমপ্লেক্স। ছবি: লেখক
দক্ষিণডিহিতে রবীন্দ্র কমপ্লেক্স। ছবি: লেখক

রবিঠাকুরের স্মৃতিবিজড়িত দক্ষিণডিহি। যশোর-খুলনা মহাসড়কেই ফুলতলা উপজেলা বাজার। এরপর সর্পিল পথে দক্ষিণডিহি। গ্রামের ঠিক মাঝখানেই এ বাড়ি। ছায়া ঢাকা এ গ্রামেই সগৌরবে মাথা উঁচু করে আছে এ বাড়িটি। ফুল, ফল আর বিচিত্র গাছগাছালিতে ঠাসা সৌম্য-শান্ত গ্রাম দক্ষিণডিহি। কলকাতার জোড়াসাঁকোর বিখ্যাত ঠাকুর পরিবারের সঙ্গে দক্ষিণডিহির সম্পর্ক ছিল নিবিড়। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মা সারদা সুন্দরী দেবী আর কাকি ত্রিপুরা সুন্দরী দেবীর জন্ম এ গ্রামেই। রবীন্দ্রনাথের স্ত্রী মৃণালিনী দেবীও দক্ষিণডিহিরই মেয়ে। তাঁর আরেক নাম ভবতারিণী। বিয়ের পর নাম রাখা হয় মৃণালিনী দেবী। পরে কলকাতাতে পাড়ি জমান দক্ষিণডিহির ঠাকুর পরিবারের বেশির ভাগ সদস্য।

পিঠাভোগ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্মৃতি সংগ্রহশালা। ছবি: লেখক
পিঠাভোগ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর স্মৃতি সংগ্রহশালা। ছবি: লেখক

যৌবনে বিশ্বকবি কয়েকবার মায়ের সঙ্গে দক্ষিণডিহি গ্রামের মামাবাড়িতে এসেছিলেন বলে জানা যায়। প্রতিবছর ২৫ বৈশাখ এখানে নানা আয়োজনে রবীন্দ্র মেলা ও আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।

সূচি
সকাল ১০টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা থাকে। প্রবেশ ফি ১০ টাকা। সরকারের প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এটা নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

কীভাবে যাবেন
বাস বা ট্রেনে নওয়াপাড়া বা খুলনা। এরপর বাস বা টেম্পোতে ফুলতলা উপজেলা বাজার। এখান থেকে অটোবাইকে চিকন রাস্তা দিয়ে তিন–চার কিলোমিটার যেতেই রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের শ্বশুরবাড়ি; যা ‘রবীন্দ্র কমপেক্স’ নামে পরিচিত।

থাকা ও খাওয়া
থাকা-খাওয়ার জন্য খুলনা বা নওয়াপাড়া ভালো হবে। বিভাগীয় শহর খুলনাতে বিভিন্ন মান ও দামের অসংখ্য আবাসিক বা খাবার হোটেল রয়েছে। ফুলতলা বাজারে মাঝারি মানের থাকা ও খাওয়ার ব্যবস্থা রয়েছে।