রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে আড্ডায় রণাঙ্গনের গল্প

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্মদের নিয়ে আড্ডায় বসেছিল রাবি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড। ছবি: সংগৃহীত
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্মদের নিয়ে আড্ডায় বসেছিল রাবি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড। ছবি: সংগৃহীত

লাখো শহীদের রক্তে অর্জিত মহান স্বাধীনতাযুদ্ধের গল্প শোনার আগ্রহের কমতি নেই কারও। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্মের কাছে আগ্রহ অনেক বেশি। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে (রাবি) অধ্যয়নরত মুক্তিযোদ্ধার সন্তান ও প্রজন্মদের নিয়ে এমন আড্ডায় বসেছিল রাবি মুক্তিযোদ্ধা সংসদ সন্তান কমান্ড। সেই আলোচনায় উঠে আসা গল্পই এখানে।

১৯৭১ সালের ৫ সেপ্টেম্বর! তৎকালীন ক্যাপ্টেন গিয়াস উদ্দীনের কথামতো চাঁপাইনবাবগঞ্জ রোডে অ্যাম্বুস টিভি হাসপাতাল সেনাবাহিনী ক্যাম্প অপারেশন এবং নওহাটা এয়ারপোর্ট ক্যাম্প অপারেশনের দায়িত্ব পড়ে যুদ্ধাহত বীর মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেকের (বীরবিক্রম) ওপর। প্রেমতলীতে জিন্নাত মাস্টারের বাড়িতে সেনাবাহিনী ক্যাম্প করেছে। ছয়জন মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে অপারেশনে যান তিনি। কিছুক্ষণের মধ্যে গোলাগুলি শুরু হলে সঙ্গীদের সেটা প্রতিরোধ করতে বলেন, কিন্তু পরক্ষণেই গোলাগুলিতে বুকে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন। সহযোগীরা ক্ষতস্থান গামছা দিয়ে বেঁধে নিরাপদ ক্ষুদ্র জাতিসত্তার এক ব্যক্তির বাড়িতে আশ্রয় নেন। ভেবেছিলেন, লাল–সবুজ বাংলা হয়তো দেখতে পাবেন না। কিন্তু তাঁদের মতো বীরযোদ্ধাদের জন্য আজ বাংলাদেশ স্বাধীন। বিশ্বের মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে। গল্পের শুরুতেই একাত্তরের স্মৃতিময় দিনগুলোর কথা তুলে ধরলেন মুক্তিযোদ্ধা আবদুল খালেকের নাতি রুকন উদ্দীন।

ঐতিহ্যবাহী ভীটিবাড়ি যুদ্ধ
জান্নাতুন নাঈমা জানার বাবা একজন মুক্তিযোদ্ধা। ছোটবেলা থেকেই বাবার মুখে শুনেছেন রণাঙ্গনের কথা। আড্ডায় তিনি বলেন, মুক্তিযোদ্ধার সন্তান হওয়ার জন্য মুক্তিযুদ্ধের রোমাঞ্চকর গল্পগুলো শোনার সুযোগ পাওয়া যেন সবচেয়ে বড় সৌভাগ্য। তেমনই একটি গল্প আমার বাবা মুক্তিযোদ্ধা আবদুল হাই আকন্দের মুখে শুনেছি। মুক্তিযুদ্ধের সময় ১১ নম্বর সেক্টরের অন্তর্গত ময়মনসিংহের মুক্তাগাছার ১০ নম্বর খেড়ুয়াজানী ইউনিয়নের ভীটিবাড়িতে পাকিস্তানি মিলিটারির আতঙ্ক রেফাজ কোম্পানি সম্মুখ যুদ্ধরত ছিল। এ কোম্পানিতে বাবাসহ শতজনের মতো সাহসী মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। যুদ্ধের একপর্যায়ে জয়ের সম্ভাবনার মধ্য দিয়েই হঠাৎ ফুলবাড়িয়া থানা থেকে অর্থাৎ সম্মুখ শত্রুর পাশাপাশি পেছন থেকে আক্রমণ আসতে থাকে। সেই আক্রমণের গতিবিধি লক্ষ করতে গিয়ে এক পর্যায়ে হেলমেটে এসে গুলি লাগে এবং তিনি একটুর জন্য বেঁচে যান। পরে তারা সেখান থেকে ২০ জন আলবদর ও রাজাকারকে আটক করেন। এর মধ্যেই সামনে এবং পেছনে দুদিকেই শত্রু, তাই ১৯ জন রাজকারকে গুলি করতে বাধ্য হয় এবং একজন বাধ্য হয়ে রাজাকারে যোগ দিয়েছেন বলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়। এ সম্মুখযুদ্ধটি মুক্তাগাছার ঐতিহ্যবাহী ‘ভীটিবাড়ি যুদ্ধ’ হিসেবে পরিচিত।

মুক্তিযুদ্ধকালীন বাবার রণাঙ্গনে যুদ্ধের ঘটনা সম্পর্কে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় মুক্তিযোদ্ধার সন্তান কমান্ডের সম্পাদক অমর কুমার রায় বলেন, ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের দিকে খুলনার পাইকগাছার কপিলমুনীতে নদীতে মোটরচালিত নৌকাতে পাকিস্তান সেনাবাহিনী টহল দিত। সেখানে বর্ষার শেষ দিকে বাবাসহ ১৫ থেকে ২০ জন মুক্তিযোদ্ধা আগে থেকে পজিশন নিয়ে ছিলেন। যখন নৌকায় সেনারা এল, একসঙ্গে গর্জে উঠল রাইফেল। তারপর পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কয়েকজন লাফ দিল এবং পালিয়ে গেল। বাকিরা সব মারা গেল।

মুক্তিযোদ্ধা নানার যুদ্ধে অংশগ্রহণের বিষয়টি নিয়ে ওমর ফারুক বলেন, ১৯৭১ সালে ৭ মার্চের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে যখন যুদ্ধে শুরু হয়েছিল, তখন ১১ নম্বর সেক্টরের অধীনে ফুলবাড়িয়া, ভালুকা (ময়মনসিংহ) এলাকায় যুদ্ধে অংশ নেন ইদ্রিস আলী। যখন তিনি যুদ্ধে গিয়েছিলেন, তখন স্থানীয় আলবদর বাহিনী সেই এলাকায় ঘরবাড়ি পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়েছিল। যাঁরা যুদ্ধে গিয়েছিলেন, তাঁদের পরিবারের ওপর চালানো হতো নির্যাতন। যুদ্ধে না যাওয়ার জন্য নানা ধরনের হুমকি মুখে পড়তে হয়েছে তাঁদের পরিবারকে। কিন্তু এত কিছুর পরেও পরিবারের কথা চিন্তা না করে মাতৃভূমির টানে জীবন বাজি রেখে দেশ স্বাধীন করে লাল–সবুজের পতাকা হাতে নানা ঘরে ফিরছিলেন বীরের বেশে।

মুক্তিযোদ্ধা প্রজন্মদের গল্পে এমনই তথ্য উঠে আসে ১৯৭১ সালের নয় মাসের রণাঙ্গনের দিনগুলোর কথা। সেই দিনগুলোয় শোষণ-বঞ্চনা উপেক্ষা করে ছিনিয়ে এনেছিলেন লাল–সবুজের পতাকা। যাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমরা পেয়েছি এই স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ, তাঁদের এই ত্যাগের ইতিহাস কখনো ভোলার নয়। তরুণ প্রজন্মের কাছে মুক্তিযুদ্ধের সঠিক ইতিহাস তুলে ধরার কোনো বিকল্প নেই, যাতে তরুণ প্রজন্মের মনে হাজার বছর অম্লান হয়ে থাকেন দেশের সূর্যসন্তানেরা।

*লেখক: শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়