আগামীর পৃথিবী কোন দিকে যাচ্ছে?

ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি মৃত্যুপুরী। দেশটির সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) পক্ষের লোক বিশেষ করে হিন্দুধর্মাবলম্বী নাগরিকেরা সিএএ-বিরোধী সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে হামলা চালায়। এতে একদিকে যেমন বহু প্রাণহানি ঘটেছে, তেমনি আগুনে বাড়িঘর, দোকানপাট পুড়ে ও ভাঙচুরে একাকার। আর সেই পুড়ে যাওয়া, ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িগুলোর দিকে অসহায়ত্বের সঙ্গে চেয়ে আছেন সেখানকারই এক বাসিন্দা। সম্প্রতি নয়াদিল্লির একটি এলাকায়। ছবি: এএফপি
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লি মৃত্যুপুরী। দেশটির সংশোধিত নাগরিকত্ব আইনের (সিএএ) পক্ষের লোক বিশেষ করে হিন্দুধর্মাবলম্বী নাগরিকেরা সিএএ-বিরোধী সংখ্যালঘুদের টার্গেট করে হামলা চালায়। এতে একদিকে যেমন বহু প্রাণহানি ঘটেছে, তেমনি আগুনে বাড়িঘর, দোকানপাট পুড়ে ও ভাঙচুরে একাকার। আর সেই পুড়ে যাওয়া, ক্ষতিগ্রস্ত বাড়িগুলোর দিকে অসহায়ত্বের সঙ্গে চেয়ে আছেন সেখানকারই এক বাসিন্দা। সম্প্রতি নয়াদিল্লির একটি এলাকায়। ছবি: এএফপি

বদলে যাওয়া সময়ে বদলে যাওয়া পৃথিবী! মানব–বসবাসের উপযোগী এই গ্রহটির চিত্র যেন জ্যামিতিক হারে পরিবর্তন হচ্ছে। বুদ্ধিবৃত্তিক প্রাণী মানুষের হাতেই বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে খোয়া যাচ্ছে মানুষের প্রাণ। আদিকালে মানুষ টিকে থাকার জন্য পরাজিত করেছে অনেক হিংস্র প্রাণিকুলকে। কোনো ধারালো অঙ্গ না থাকা সত্ত্বেও কেবল বুদ্ধির জোরে অনেক ধারালো অঙ্গের প্রাণীকে পরাভূত করেছে মানুষ। আজ মানুষের সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকার মতো কোনো প্রজাতি নেই এই পৃথিবীতে। একচ্ছত্র রাজত্ব কায়েম করেছে মানুষ। আর প্রতিযোগিতার অভাবে নিজ প্রজাতির সঙ্গেই প্রতিযোগিতায় লিপ্ত এই গ্রহের বাসিন্দারা। মানুষের খুব সহজাত প্রবণতাই হচ্ছে কোনো দ্বন্দ্বে জড়ানো। শান্ত থাকাটা মনুষ্য প্রজাতির রক্তে নেই। আর সেই ধারাই আমরা পৃথিবীর প্রতি প্রান্তে দেখতে পাচ্ছি।

এই পৃথিবী দুটি বিশ্বযুদ্ধের সাক্ষী, মানুষের কল্যাণে নয় বরং শক্তিমত্তার প্রয়োগে এক পক্ষ অন্য পক্ষকে ঘায়েল করে আধিপত্য বিরাজের নিমিত্তেই এই যুদ্ধ। পৃথিবীর মানুষ দেখেছে বিনাশ কেমন, হত্যালীলার বোধ কেমন, আর কতটা হিংস্র হতে পারে মানুষের প্রতি মানুষ।

দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর পৃথিবী কিছুটা শান্ত ছিল। সর্বোপরি মানুষের সমাজকাঠামোতে এসেছিল বিরাট পরিবর্তন। বিশ্বব্যাংক, আইএমএফসহ নানান আঞ্চলিক সংগঠন অর্থের প্রসার ঘটিয়ে কায়েম করে পুঁজিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থার। অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ, জীবনযাত্রার মানের ওপর পুরো বিশ্বকে একটি নির্দিষ্ট মানদণ্ডে দাঁড় করায় সংস্থাগুলো! পৃথিবী কোনো দিকে যাবে, পুঁজিবাদ নাকি সমাজতন্ত্র এ নিয়ে বিরোধ পৃথিবীকে করেছে বিভক্ত, জাতিতে জাতিতে আবার যেন এক ভয়াবহ মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধ! পৃথিবী কার অধীনে থাকবে, আমেরিকা নাকি রাশিয়া, এই প্রশ্নের উত্তর জানা ছিল না অনেক দিন। নিজেদের সব শক্তিমত্তা দিয়ে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক, সামরিক দিক থেকে নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার যে প্রচেষ্টা পৃথিবীকে, সেটাকে বিশ্ব শীতল যুদ্ধ হিসেবেই জানি আমরা, যুদ্ধ নয় তবু যেন এক ভয়াবহ আগ্রাসন একে অপরের ওপর।

শীতল মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের ফলে পৃথিবী পায় নতুন কাঠামো
এই শীতল মনস্তাত্ত্বিক যুদ্ধের ফলে পৃথিবী আবার নতুন এক কাঠামো পায়। উন্নয়নের ওপর ভিত্তি করে ভাগ হয়, প্রথম বিশ্ব, দ্বিতীয় বিশ্বে। কোনো পক্ষ অবলম্বন না করা নিরপেক্ষ দরিদ্র দেশগুলো নাম পায় তৃতীয় বিশ্ব নামে। আর এই তৃতীয় বিশ্বকেই নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করতে থাকে পুঁজিবাদ সংশ্লিষ্ট আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্র। শীতল যুদ্ধে রাশিয়ার পরাজয় এবং বিভক্তি বিশ্বের সমাজব্যবস্থা কেমন হবে তার ইঙ্গিত দেয়। পুঁজিবাদের বিকাশ মানুষের জীবনযাত্রাকে করে তোলে অত্যাধুনিক এবং স্বাচ্ছন্দ্যের। বৈশ্বিক দূরত্ব কমতে থাকে, কমতে থাকে মানুষের আবেগ–অনুভূতি, অবাধ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করে শ্রেণিবৈষম্য, যারা নিজেদের যোগ্যতায় টিকে থাকতে পারেন, তারাই হবে এই ব্যবস্থার সর্বেসর্বা, আর কালের স্রোতে হারিয়ে যাবে দুর্বল শক্তিমত্তার মানুষেরা। পুঁজিবাদের বিকাশ পৃথিবীকে বদলে দিয়েছে, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের উদ্ভব ঘটিয়ে মানুষে মানুষে করে দিয়েছে সীমাহীন দূরত্ব। মিডিয়া বিপ্লব ঘটেছে পৃথিবীর অনেক দেশে। যোগাযোগব্যবস্থার অভাবনীয় উন্নতি ঘটলেও মানসিক দূরত্ব বেড়েছে অনেক। মুক্তবাণিজ্যের অর্থনীতি এক দেশের সঙ্গে অন্য দেশের লেনদেনের পরিমাণ বাড়ালেও অবাধ প্রতিযোগিতা সৃষ্টি করেছে বৈষম্যের। নতুন নতুন তাত্ত্বিক কাঠামো গড়ে উঠেছে, সেই রেশ ধরেই এগিয়ে চলছে পৃথিবী।

দিল্লিতে সংঘর্ষের সময় এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়। ছবি: রয়টার্স
দিল্লিতে সংঘর্ষের সময় এক ব্যক্তিকে পিটিয়ে রক্তাক্ত করা হয়। ছবি: রয়টার্স

পৃথিবীর অধিকাংশ জাতিই এখন নিজ স্বার্থ নিয়েই ব্যস্ত, যদিওবা বলা হচ্ছে বিশ্বগ্রাম। জাতিরাষ্ট্রগুলো তাদের স্বার্থ আদায়ে বদ্ধপরিকর, বিশ্বায়নব্যবস্থায় তৃতীয় বিশ্বের রাষ্ট্রগুলোর অবকাঠামোগত উন্নয়ন হলেও ঘটছে না ভাগ্যের পরিবর্তন। এক কথায় বলা চলে, পৃথিবীর ক্ষমতাধর শক্তি রাষ্ট্রগুলো তাদের শোষণের ক্ষেত্র তৈরি করছে তৃতীয় বিশ্বে।

আগামী দিনের পৃথিবী কোন দিকে যাচ্ছে
বর্তমান প্রেক্ষাপটে যদি আমরা তাকাই, তাহলে দেখতে পাই জাতিগত সংঘাত। এক ধর্ম অন্য ধর্মের বিকাশকে কীভাবে ব্যাহত করবে, সেই পরিকল্পনায় ব্যস্ত। যত আধুনিক আমরা হচ্ছি, ততই সংঘাত বাড়ছে, মানুষ মারার নতুন নতুন যন্ত্রকৌশল তৈরি হচ্ছে, এতে ক্ষমতাধর রাষ্ট্রগুলো বাহবাও পাচ্ছে! শক্তিমত্তার প্রদর্শন হয়ে উঠেছে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। জাতিগত সংঘাত কোনো জাতিকেই নিঃশেষ করে দিচ্ছে। একেক অঞ্চলে একেক ধরনের সমস্যাকে কেন্দ্র করে চালানো হয় অভিযান, সাধারণ মানুষের প্রাণ যায়। ফিলিস্তিন, কাশ্মীরে মানুষের মৃত্যু হয় নিয়মিত, এ আধুনিক পৃথিবী জীবনের মূল্য কমিয়ে দিয়েছে। সম্প্রতি ভারতের নয়াদিল্লির ঘটনা আমাদের নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে। শুধু ধর্মের কারণে কোনো মানুষের নির্মম মৃত্যু গ্রহণ করতে হবে একুশ শতকে এসে তা মানা যায় না। একেক শক্তির প্রভাবে একেকজন দমিত হচ্ছেন, এর রেশ ধরে অন্য কোনো জায়গায় আরও নতুন ঘটনার জন্ম দিচ্ছে। সাম্প্রদায়িকতাবাদ আধুনিক পৃথিবীর কোনো ব্যবস্থা হতে পারে না। এমতাবস্থায় প্রশ্ন জাগতেই পারে, আগামী দিনের পৃথিবী কোন দিকে যাচ্ছে?

আসলেই আমাদের ভাবিয়ে তুলে আগামীর পৃথিবী কি শুধু শক্তিমত্তার জয়গানে ভরে উঠবে, নাকি সব মানুষ সমান সুযোগে বাঁচবে? উত্তরটা হয়তো খুব সহজ নয়। উগ্র জাতীয়তাবাদের যে বিকাশ ঘটছে, তাতে অনুমান করা যায়, পৃথিবী খুব বড় কোনো সংকটে পড়বে। ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন বলেন, আমেরিকা গ্রেট অ্যাগেইন, এই বাক্য আমাদের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলে। পৃথিবীতে শক্তির জোরে কি তাহলে আমেরেকি সবকিছু করে যাবে, তৃতীয় বিশ্বের মানুষের দুর্দশার কি কোনো শেষ হবে না, শুধুই কি গ্রেটরা রাজত্ব করে, আর এই সুপার পাওয়ার শক্তির মাঝের দ্বন্দ্বে একসময় হয়তো বিনাশ হবে পৃথিবী। আরও একটি বিশ্বযুদ্ধের দিকে ধাপে ধাপে এগিয়ে যাচ্ছে বিশ্ব, চারপাশের ঘটনা আমাদের এমনই ইঙ্গিত করে।

*লেখক: শিক্ষার্থী, গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ, কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়