সামাজিক মাধ্যম বনাম ব্যক্তিগত তথ্য: সব কি আমাদের

২০১০ সালে শীতকালীন ছুটিতে ইউরোপ যাচ্ছি। একটা বিমানে চেপে বসেছি। হঠাৎ দেখি এক দল কেবিন ক্রু কেক-ক্যান্ডেল নিয়ে হাজির, আমার জন্মদিন। ওরা যানে কীভাবে? আমার পাসপোর্টের কপি থেকে দেখল নাকি? না আমার ফ্রিকোয়েন্ট ফ্লায়ার কার্ড থেকে জেনেছে? আমি আবার ওদের ওয়েবসাইটে আমার ফেসবুক অ্যাকাউন্ট দিয়ে লগইন করি। মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা। যে কেক দিয়েছে, এটাই আমার পছন্দের কেক। আমি কী কেক পছন্দ করি, তা জানে। আমার সঙ্গে কে কে ভ্রমণ করে তাও জানে, তার কী পছন্দ সেটাও জানে।

সামাজিক মাধ্যম বনাম ব্যক্তিগত তথ্য—এ ব্যাপারে আমাদের সবারই মোটামুটি ভীতি আছে। শহরের থেকে গ্রামের সবারই সন্দেহ আছে।

সম্প্রতি আমাদের দারোয়ান বললেন, তাঁর ফোনে কী যেন এসেছিল, তিনি জবাব দেননি। কারণ, ওই ফোন ওনার ফোনের জিনিস হাতিয়ে নিতে চায়। নাইন পাস করা একটা লোকও এই সন্দেহ করেন। গত মাসে একটা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী কথায় কথায় জানালেন, তাঁর ফোন তাঁর সব কথা শোনে। তিনি যদি বন্ধুকে জন্মদিনের উইশ করেন, তিনি কেক কেনার বিজ্ঞাপন আর অফার পান।

আমাদের তথ্য যে নেয়, ওই মাধ্যমগুলো এটা সবাই জানেন। কিন্তু কী কী ব্যক্তিগত তথ্য সামাজিক মাধ্যম জানে বা কতটুকু জানে, সেগুলা তারা কীভাবে ব্যবহার করে, সে সম্পর্কে অনেকেরই সম্যক ধারণা নেই। এ লেখাতে আমার তথ্যপ্রযুক্তির জগতে কাজ করার অভিজ্ঞতা থেকে কিছুটা ধারণা দিচ্ছি। তার আগে এই কথাটা আগেই বলে নিই, আমি তথ্যপ্রযুক্তির মানুষ, কিন্তু আমি স্মার্টফোন ব্যবহার করি না। সামাজিক মাধ্যম একদম সীমিত আকারে ব্যবহার করি (তাও সামাজিক চাপে)। আর যে মেয়েটা বলল সে বন্ধুকে জন্মদিনের উইশ করলে কেক কেনার অফার পায়, সত্যি কথা হলো কেক কেনা তো পরের কথা, সে যে উইশ করবে এবং কোন বন্ধুকে উইশ করবে, সেটা ও সামাজিক মাধ্যম জানে। মজার ব্যাপার না?

তথ্য চুরিকে বলে প্রোফাইলিং
মোটেই মজার না, রীতিমতো ভয়ের। খবরের কাগজে বা টেলিভিশনে দেখেছেন (বলা বাহুল্য, সামাজিক মাধ্যমে ও দেখেছেন) যে ফেসবুকের তথ্য চুরি কেলেঙ্কারি, যার জন্য দায়ী একটা প্রতিষ্ঠান অক্সফোর্ড অ্যানালিটিকস। যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটে বাদানুবাদ হয়েছে, অনুসন্ধান হয়েছে, বিল পাস হতে যাচ্ছে। আরও কিছু দেশে ডেটা প্রাইভেসির আইন শক্ত করা হয়েছে। জার্মানি, ফ্রান্স ব্যক্তিগত তথ্য অপব্যবহারের জন্য গুগলকে বিলিয়ন ডলারের অর্থদণ্ড দিয়েছে। কাজেই তাত্ত্বিকভাবে এটা প্রতিষ্ঠিত যে ওরা ব্যক্তিগত তথ্য চুরি করে। এই চুরিটাকে ওরা বলে প্রোফাইলিং। প্রোফাইলিংয়ের ওপর দাঁড়িয়ে আছে এই মাধ্যমগুলোর বিলিয়ন ডলারের বিজ্ঞাপন বা বিপণন ব্যবসা। ফেসবুক প্রতিটা মানুষের প্রোফাইলের জন্য জন্য ১ দশমিক ৮ মিলিয়ন অ্যালগরিদম চালায়।

অ্যানালিটিকস, প্রোফাইলিং ও টার্গেটিং হলো এখন যেকোনো ব্যবসার প্রাণশক্তি। ফেসবুক, অ্যাপল, গুগল, আমাজন, মাইক্রোসফট, সবাই করে এবং অন্যের কাছে বিক্রি করে। টেকনিক্যালি বললে, ওরা বিক্রি করে না কিন্তু ওরা প্রোফাইলের ভিত্তিতে টার্গেটিং করে দেয় আর টাকা নেয় বিজ্ঞাপনদাতা থেকে। টার্গেটিং হলো ব্যবসাপ্রতিষ্ঠান আর ক্রেতার মধ্যে ম্যাচমেকিং করা। দুই দশক আগে অ্যানালিটিকস তুঙ্গে ছিল। এর মাধ্যমে মোটামুটি সব তথ্য হাতিয়ে নেওয়া হয়। তারপর এগুলো প্রত্যেকের ওপর ধারাবাহিকভাবে ব্যবহার করে, পলিশ করে প্রোফাইলিং করা হয়। তারপর এটা ব্যবহার করা হয় টার্গেট মানুষগুলোর ওপর। প্রোফাইলিং যত পলিশড, টার্গেটিং ততই সহজ। যত বেশি প্রোফাইল করা যায়, তত বেশি টার্গেটিং করা যায়। আপনি পরের মাসে কোনো দেশে কোথায় ভ্রমণ করবেন, কী খাবেন, কীভাবে যাবেন, কী পরবেন, একা যাবেন নাকি ফ্যামিলি নিয়ে যাবেন, আপনি কী ফোন ব্যবহার করে কার সঙ্গে রাতে কথা বলবেন, ওরা সব জানে আর কাউকে টাকার বিনিময়ে এই তথ্য বিক্রি করে।

আমার ব্যক্তিগত তথ্য কে সংরক্ষণ করতে পারে? সরকার পারে। সরকারের কাছে এই তথ্য থাকে সামাজিক নিরাপত্তার জন্য, নাগরিক সেবাদানের জন্য। একটা অপরাধ করলে দেখা যায় সরকার বা ইনটেলিজেন্স প্রতিষ্ঠান আমার কত কিছু জানে। সেটা মেনে নেওয়া যায়। কিন্তু প্রাইভেট কোম্পানির কাছে এই তথ্য থাকে তাদের ব্যবসার জন্য। প্রাইভেট কোম্পানি আমার সব তথ্য জানলে কেমন লাগে? আমার তো ভালো লাগে না।

প্রোফাইল টার্গেটের খেলা
এ পর্যন্ত পড়ে কেউ যদি মনে করেন ‘না, এতটা না, যতটা বলছেন’। ভাই, আমি অল্পতে একটা চ্যালেঞ্জ দিই বা একটা প্রোফাইলিং এক্সপেরিমেন্ট করে দেখিয়ে দিতে পারি। আমার ছেলে বিয়ে করবে। আপনার মেয়ে যদি বিবাহবয়স্ক হয়, তাহলে শুরু করা যায় এই এক্সপেরিমেন্ট। আপনার মেয়ে ফেসবুক, গুগল, স্মার্টফোন ব্যবহার করেন। তাঁর বয়স ২০ থেকে ২৫, ঢাকায় থাকে। ৩০ লাখ নারীর থেকে এক লাফে ১০ লাখে এলাম। তারপর মেয়ে ইডেনে পড়েছে বা মোবাইল ফোন কোম্পানিতে কাজ করেছে, তাহলে ২০ হাজারে চলে এলাম। উনি উবার ব্যবহার করেন, যদিও টয়োটা প্রিমিও আছে। উইকেন্ডে সেভেন স্টোন আইসক্রিম খান ধানমন্ডিতে। ব্যস। ২ হাজারে টার্গেট করে ফেললাম। আর যদি বলেন তাঁর বেস্ট ফ্রেন্ড অমুক আর তাঁর গায়ের রং উজ্জ্বল, তাহলে ২০০–তে নেমে এল। এই ব্যাপারটা আপনিও আমার ছেলের ওপর প্রয়োগ করুন। একটা পর্যায়ে মোটামুটি তিন–চারজনের মধ্যে চলে আসবেন। এমনকি ওই দুজনেই—আমার ছেলে এবং আপনার মেয়ে। বাস্তবে আপনার মেয়ের এই প্রোফাইল তথ্য তো আপনি আমাকে দেবেন না। কিন্তু আপনার মেয়ে আর আমার ছেলে ফেসবুককে আগেই দিয়ে ফেলেছে এসব তথ্য এবং প্রতিদিন আরও দিচ্ছে। কাজেই ফেসবুক আমাকে আপনার মেয়েকে টার্গেট করে দেবে আর আপনাকে আমার ছেলেকে টার্গেট করে দেবে। এই হলো প্রোফাইল আর টার্গেটের খেলা।

এ ফিল্ডে কাজ করেছি প্রায় দুই দশক ধরে। আগে একটা লেক্সাস গাড়ি বিক্রি করতে চাইলে ওদের কাস্টমারের বিশদ বর্ণনা দেওয়া লাগত। আমি কী রকম কাস্টমার খুঁজছি? ধনী, বয়স্ক, গুলশান-ধানমন্ডির বাসিন্দা, পুরুষ, ব্যবসা করে বা বড় চাকরি করে ইত্যাদি। এখন আমি শুধু বলি গাড়ি বিক্রি করতে চাই আর ওরা বুঝে নেয় বাকিটা। ভবিষ্যতে হয়তো এটাও বলতে হবে না যে আমি গাড়ি বিক্রি চাই। আমার গাড়ি বিক্রি করার সময় হলেই আগ্রহী ক্রেতারা আমার আশে পাশে (মানে আমার সামাজিক অ্যাকাউন্টে) ঘোরাঘুরি করবেন। একটা সময় আমার গাড়ি বিক্রির ইচ্ছাও পোষণ করতে হবে না। ওরাই নিয়ন্ত্রণ করবে কখন আমার গাড়ি বিক্রি করতে হবে। ওরা তো দেখে আমি এই সপ্তাহে কতবার গাড়ির মেকানিক গ্যারেজে গিয়েছি আর গাড়ি গ্যারেজে থাকায় আমি কতবার উবার ব্যবহার করেছি।

সামাজিক মাধ্যম এখন বিজ্ঞাপনের মিডলম্যান
আরেকটা ভীতির ভবিষ্যৎ আছে, যেটা না বললেই নয়। সামাজিক মাধ্যম এখন বিজ্ঞাপনের মিডলম্যান। আমার তথ্য নেয় আর তথ্য বিক্রি করে কমার্শিয়াল কোম্পানির কাছে। একটা সময় ওরাই হয়ে যাবে সেবা প্রদানকারী মিডলম্যান। ওদের নিয়ন্ত্রণে কোটি কোটি মানুষ। তখন সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠান সেবা বিক্রি করার জন্য ওদের উপর নির্ভরশীল হয়ে যাবেন। এখনই হচ্ছে। গুগল বা অ্যাপল ওয়ালেট এখন ব্যাংকের কাছে যায় তাদের ব্যাংকিং সেবা মানুষের হাতে পৌঁছে দেওয়ার জন্য। ভবিষ্যতে ব্যাংক ওদের পেছনে ঘুরবে, মানুষের কাছে সেবা প্রদানের জন্য। ওরাই যে গেটকিপার। কোনো ব্যাংকে কাস্টমার পাঠাবে, এটা গেটকিপারের মর্জি। যেই ব্যাংক বেশি টাকা দেবে, তাদেরকে কাস্টমার দেবে। একসময় গুগল ব্যাংক বা অ্যাপল ব্যাংকও হয়ে যাবে। আমেরিকার অ্যাসোসিয়েশন অব ব্যাংকের প্রধান ও ব্যাংক অব আমেরিকার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা বছর দুয়েক আগেই বলেছিলেন, এভাবে ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস ডিজিটাল করতে করতে একসময় মানুষ হয়ে যাবে টেকনোলজি কোম্পানির কাস্টমার আর ব্যাংকের শুধু ইউজার।

এর শেষ কোথায় জানি না। তবে জানি, এটা আরও অনেক দূর যাবে। কারণ, এটা এক পাক্ষিক না, আমরা নিজেরাই ওদের ব্যবহার করি আমাদের প্রয়োজনে, পাশাপাশি ওরা আমাদের ব্যবহার করে ওদের প্রয়োজনে। এটা একটা উইন উইন (বা লুজ-লুজ) সম্পর্ক। শুধু এই যে ওদের লাভটা টাকায় অনেক বেশি। এই বছর আবার আর্টিফিশিয়াল ইনটেলিজেন্সের বাড়াবাড়ি দেখছি—এই বিষয়ে চীন, পশ্চিমারা অনেক কাজ করছে। ফেস টাইম আর ফেস অ্যাপের নাম শুনছি খুব। ডিপ ফেকের জনপ্রিয়তাও কালোবাজারে বাড়ছে। চীনে নাকি এক অবিকল জেমস বন্ড আছেন, যিনি ডিজিটাল ওয়ার্ল্ডেই থাকেন, পণ্যের বিজ্ঞাপন করেন দেশি-বিদেশি ব্র্যান্ডের জন্য, শুটিং করেন, লাইভ প্রেস ইন্টারভিউ করেন (উপস্থিত লাইভ কথাবার্তা বলেন, একদমই স্ক্রিপ্টেড না), তাঁর পেছনে পাপারাজ্জিরা ছোটেন। এই ভার্চ্যুয়াল ভদ্রলোকের জেমস বন্ডের মতো রূপ, আবেগ, ব্রেইন, লজিক, পছন্দ-অপছন্দ সবই আছে। একটা সময়ে আমার ও ভার্চ্যুয়াল ভার্সন তৈরি হয়ে যেতে পারে। অচিরেই ওরা আমার তথ্য, ছবি, চেহারা, চাহনি, ইশারা, মুভমেন্ট, আবেগ, সব মিলিয়ে আমারই ‘আরেকটা আমি’ তৈরি করে ফেলবে। আমি এই দুনিয়াতে না থাকলে ও কিছু যায়–আসে না। ওরা আমাকে বানিয়ে আমার পরিবারের সঙ্গে একসঙ্গে ভ্রমণ করার অভিজ্ঞতা দেবে, আর আমার পরিবারও কিনবে। ওই যে আগেই বলেছি উইন-উইন বা লুজ-লুজ। একতরফা দোষ দেওয়া যায় না কাউকেই। আফটার অল, আমরা সামাজিক তো।