সান্ধ্য কোর্স বাতিল না হলে আশ্চর্য হবেন না

সম্প্রতি কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষা ও সান্ধ্য কোর্স নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অবস্থান গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। ‘কেন্দ্রীয় ভর্তি পরীক্ষায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাচ্ছে না’—এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনকে সাধুবাদ জানাই।

ঠিক অপর দিকে সান্ধ্য কোর্স বাতিলের বিপক্ষে শিক্ষকদের একটি অংশের অবস্থান চরম হতাশাজনক। শিক্ষকদের একটি অংশের এ ধরনের অবস্থানের বিষয়ে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই কারণ, যেখানে শিক্ষকদের স্বার্থ জড়িত, সেটা বাস্তবায়ন হবে আর যেখানে শিক্ষকদের স্বার্থ ক্ষতিগ্রস্ত হবে, সেটা বাস্তবায়িত হবে না। পরিষ্কারভাবে বলতে গেলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আলাদাভাবে ভর্তি পরীক্ষা নিলে এ খাত থেকে বিশাল আয় হয়। আর সান্ধ্য কোর্স বন্ধ হলে বিশাল আয়ের রাস্তা বন্ধ হয়ে যাবে। তাই সমন্বিত ভর্তি পরীক্ষায় না যাওয়ার সিদ্ধান্ত একনিশ্বাসে নিতে পারলেও সান্ধ্য কোর্স বন্ধের সিদ্ধান্ত নিতে প্রশাসনের দম বন্ধ হয়ে আসছে।

শিক্ষার্থীদের অনেকে এখনো সান্ধ্যকালীন কোর্সের ভয়াবহ ক্ষতিকর বিষয়টি সম্পর্কে অবগত নন। অনেক শিক্ষক ক্লাসে গিয়ে শিক্ষার্থীদের সান্ধ্যকালীন কোর্স রাখার যৌক্তিকতা বুঝিয়ে তাঁদের কনভেন্স করার চেষ্টা করছেন, যার ফলে অনেক শিক্ষার্থী সাময়িকভাবে কনভেন্স হচ্ছেনও বটে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে দেওয়া তথ্যমতে, বর্তমান ছাত্র প্রায় ৩৭ হাজার ১৮ জন এবং শিক্ষক১ হাজার ৯৯২ জন।

সান্ধ্য কোর্স পর্যালোচনা ও যৌক্তিকতা যাচাই কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট ৩৫টি বিভাগ ও ইনস্টিটিউটে সান্ধ্য কোর্স আছে। মাস্টার্স, ডিপ্লোমা, সার্টিফিকেট, ট্রেনিং কোর্সসহ অনিয়মিত এসব কোর্সের সংখ্যা ৬৯। এর মধ্যে ৫১টি মাস্টার্স, ৪টি ডিপ্লোমা, ৭টি সার্টিফিকেট আর ৭টি ট্রেনিং কোর্স। বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত কোর্সের বাইরে ১০৫টি ব্যাচে এসব কোর্সে বছরে ৭ হাজার ৩০২ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হন। তাঁদের ক্লাস নেন ৭২৫ জন শিক্ষক।

সবচেয়ে বেশি সান্ধ্য কোর্স আছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে। গত বছর ব্যবসায় শিক্ষা প্রশাসনে ১ হাজার ২৫০ জন নিয়মিত শিক্ষার্থী ভর্তি হন। অন্যদিকে ২ হাজার ৫০৩ জন শিক্ষার্থী ভর্তি হন সান্ধ্য কোর্সে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৯-২০ শিক্ষাবর্ষে স্নাতক (সম্মান) এ পাঁচটি ইউনিটে মোট ৭ হাজার ১১৮টি আসনে শিক্ষার্থীরা প্রতিযোগিতা করেছেন। এখানে দেখা যাচ্ছে, প্রতিবছর মোট নিয়মিত শিক্ষার্থী এবং সান্ধ্য কোর্সের শিক্ষার্থীদের সংখ্যা একদম কাছাকাছি। আর ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদে প্রতিবছর নিয়মিত শিক্ষার্থী থেকে সান্ধ্য কোর্সের শিক্ষার্থীদের সংখ্যাই বেশি।

এসব ক্ষেত্রে মৌলিক সমস্যা হচ্ছে, বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ইভিনিং কোর্সের প্রশ্নপত্র প্রণয়ন, পরীক্ষা গ্রহণ এবং উত্তরপত্র মূল্যায়নের ক্ষেত্রে কোনো ধরনের নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারছেন না। ২০০১ সালে বিশ্ববিদ্যালয় একাডেমিক কাউন্সিল ব্যবসায় শিক্ষা অনুষদকে মাত্র পাঁচটি ব্যাচ চালু করার অনুমতি দেয়। এতে এটাই প্রমাণিত হয়, বাকি ৪০টি ব্যাচ বিশ্ববিদ্যালয়ের একাডেমিক কাউন্সিলের অনুমতির বাইরে অবৈধভাবে এবং অনিয়মতান্ত্রিকভাবে পরিচালিত হচ্ছে।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের যে সাধ্য এবং সামর্থ্য রয়েছে, বর্তমান পরিস্থিতি বিবেচনায়, এ সাধ্য এবং সামর্থ্য দ্বারা নিয়মিত শিক্ষার্থীদের চাহিদা মেটাতে বিশ্ববিদ্যালয় হিমশিম খাচ্ছে, সেখানে প্রায় সমসংখ্যক সান্ধ্য কোর্সের শিক্ষার্থীদের নিয়ে এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় অর্ধেকসংখ্যক শিক্ষক এই সান্ধ্য কোর্সের সঙ্গে জড়িত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা ও শিক্ষার মান এবং শিক্ষার্থীদের জীবন গঠন ও ক্যারিয়ার বিনির্মাণকে হুমকির মুখে ফেলে দিয়েছে।

যে সময়টুকু একজন শিক্ষক গবেষণার কাজে মনোনিবেশ করবেন অথবা একজন শিক্ষক নিয়মিত শিক্ষার্থীর জীবন গঠনের জন্য তাদের পেছনে ব্যয় করবেন বা বিশ্ববিদ্যালয়ের কোনো প্রশাসনিক দায়িত্বে থাকলে মনোযোগ এবং গুরুত্বসহকারে সেই দায়িত্ব পালন করবেন সেই সময় যখন সান্ধ্য কোর্সের শিক্ষার্থীদের পেছনে দিচ্ছেন তখন শিক্ষার্থীদের অধিকার থেকে তিনি বঞ্চিত করছেন। তিনি এ কাজ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনিক কাজে অবহেলা করছেন এবং একজন শিক্ষক হিসেবে নিজেকে সমৃদ্ধ করার জন্য অতিরিক্ত অধ্যাপনা ও গবেষণার কাজগুলোতেও ফাঁকি দিচ্ছেন। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে বিশ্ববিদ্যালয়ে সান্ধ্য কোর্সগুলো বন্ধ করে দেওয়া শিক্ষার্থীদের কল্যাণার্থে এখন সময়ের দাবি।

সান্ধ্যকালীন কোর্সগুলোকে সমর্থন করে শিক্ষকেরা কিছু যুক্তি দিয়ে থাকেন। এর মধ্যে অন্যতম হচ্ছে, সান্ধ্যকালীন কোর্স পড়িয়ে যে বিশাল অঙ্কের আয়টি হয়, তার থেকে শিক্ষকেরা যেমন লাভবান হন, তেমনি বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে এ অর্থ কাজে লাগে এবং অনেক শিক্ষক এ অর্থ দিয়ে নিজেরা গবেষণা করে থাকেন। সান্ধ্যকালীন কোর্স বন্ধ হয়ে গেলে এই সুবিধাগুলো বাধাগ্রস্ত হবে। এই খোঁড়া যুক্তির উত্তরে বলা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় পরিচালনা, বিশ্ববিদ্যালয়ের অবকাঠামোসহ বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি এবং শিক্ষকদের গবেষণাসহ শিক্ষকদের বিভিন্ন ধরনের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির দায়িত্ব কার?

এ দায়িত্ব সরকারের। স্বায়ত্তশাসিত বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে আর্থিকভাবে স্বনির্ভর হওয়ার বন্দোবস্ত করার দায়িত্ব ও সরকারের। বর্তমানে সরকার ইউজিসির মাধ্যমে জনগণের ট্যাক্সের টাকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো চালাচ্ছে এবং সরকার চাইলে নানাভাবে বিশ্ববিদ্যালয়ের আয়ের উৎস বৃদ্ধি করে এই সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করতে করতে পারে। সে ক্ষেত্রে সান্ধ্য কোর্স কখনো একটি শিক্ষার্থী বান্ধব আয়ের উৎস হতে পারে না।

শিক্ষকতা একটি মহান পেশা। শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের জীবন গঠন ও ক্যারিয়ার গঠনের যে মহান দায়িত্ব নেবেন বলে এ পেশা বেছে নিয়েছেন, সেই গুরু এবং শিষ্যের সম্পর্কটি সান্ধ্য কোর্সের মাধ্যমে একটি বাণিজ্যিক লেনদেনে পরিণত হচ্ছে।

*শিক্ষার্থী, লোকপ্রশাসন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।