'ভাই, আমার এই ভুঁড়ি কমবে তো?'

বাঙালি ধীরে ধীরে স্বাস্থ্যসচেতন হচ্ছে। আগের মতন শুক্রবার সারা দিন ভূরিভোজের আর বায়না করে না বা রাতের বেলায় রেস্টুরেন্টে আর সেলফি নিয়ে মেতে থাকে না। তার রোজের শব্দতালিকায় কিটো ডায়েট, জিম, টোনড বডি, ক্যালরি ইনটেক, ট্রেড মিল, লেবু গরম পানি প্রভৃতি শব্দবন্ধ জায়গা পেয়েছে।

বাঙালি এখন জিমমুখী হয়েছে বা হালের আমলে একজন চিকিৎসকের ইউটিউব (তার ভিডিও ভাইরাল) নিয়ে সেই লেভেলের ব্যস্ত। প্রমাণ হিসেবে প্রথমেই জিমের ট্রেনারের সঙ্গে নিজের একটা ছবি দেয়, ক্যাপশনে থাকে, ‘মি উইথ মাই ট্রেনার।’ সঙ্গে থাকে ভোরবেলা দৌড়ের সেই রকম একটা মার্ক মারা ছবি। তারপর সে স্বাস্থ্যসচেতনতা আর ডায়েটের উপকারিতা নিয়ে পোস্ট নামায়। কেউ বিরিয়ানির ছবি দিলে সেই পোস্টে অ্যাংরি ইমো দিয়ে কমেন্টে লেখে, ‘জানিস না আমি ডায়েটে আছি? এসব ছবি কেন দিস?’ এরপর স্যাড ইমো।

সচরাচর বাঙালি জিমে যায় ভুঁড়ি কমাতে। প্রথমেই জিমে যায় না। প্রথমে ইউটিউব দেখে। মাত্র দুই দিনে পেটের চর্বি কমান শীর্ষক ভিডিও দেখে ধৈর্য ধরে দিনের পর দিন রাতের পর রাত। চিরতার পানি আরও বিতিকিচ্ছিরি নানা হার্বস মিশিয়ে সকালে খায়। অদ্ভুত দর্শন ব্যাটারিচালিত বেল্ট কিনে পেটে বেঁধে পেট কাঁপায়। রোজ মুখ কুঁচকে গ্রিন টি খায়। সকালে পাড়ার পার্কে ছয় পাক দৌড়ে ফেরার পথে তেল চুপে ভাজাভাজি আর চিনির জিলিপি খেয়ে ঘরে ঢোকে আর ভাবে, মাথা ঘুরলে এমন একটু–আরেকটু না খেলে তো মাথা ঘুরে পরেই যাবে। এক মাস পর সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে দেখে ভুঁড়ি ভেদ করে পায়ের পাতা দেখা যাচ্ছে না। তখন প্রথমে ইউটিউবকে গালি দিয়ে হতাশ হয়ে শুয়ে পড়ে। রাগ করে বিকেলে কাবাব, কাঠি রোল আর বিরিয়ানি খায়।

প্রথমেই ট্রেনার বলেন, দিনে ছয়বার খাবার খেতে হবে। সঙ্গে প্রোটিন সাপ্লিমেন্ট এবং মাল্টিভিটামিন ট্যাবলেট। ট্রেনারের আশ্বাসে এবং ছয়বার খাওয়ার প্রস্তাবে আনন্দিত হয়ে গদগদ হয়ে বাঙালি জিজ্ঞেস করেন,

‘ভাই, আমার এই ভুঁড়ি কমবে তো?’

ট্রেনার প্রথাগত ভঙ্গিতে জানান, কমবে, তবে সময় লাগবে। নিয়ম মেনে চলতে হবে। বাঙালি যেকোনো কাজ শুরু যতটা তেড়েফুঁড়ে করে, সেটার ধারাবাহিকতায় ততটা শক্তি প্রদান করে না। ফলে ছয়বার খাবারের তালিকায় গ্রিন টি, চারটি ডিমের সাদা অংশ, গমের ফ্লেক্স, সালাদ, টকদ‌ই, গাজর ও পেঁপে সেদ্ধ দেখে বুকে হাত দিয়ে বসে পড়ে। তার কল্পনায় ছিল ছয় বেলা বিরিয়ানি, পরোটা, গরুর ঝোল, আর তেল–চুপচুপে ভাজি আর কত কী। যা–ই হোক ওটসের খিচুড়ি, শসা, সয়াবিন সেদ্ধ খেয়ে কোনোমতে প্রাণ ধারণ করে। প্রথম দিন জিম সেরে প্রতি আধঘণ্টায় আয়নায় নিজের ভুঁড়ি দেখে, কতটুকু কমল পেট।

সে বুঝতে চায় না যে ভুল ডায়েট আর চটজলদি মিরাকল অসম্ভব বলে তার ভুঁড়ি এক্ষুনি কমে ইলিশের মতন পেট বা সিক্স প্যাক হ‌ওয়ার আশু সম্ভাবনা নেই। প্রাণপণে সে ব্যায়াম আর ওয়ার্ক‌আউটের চেষ্টা করে, দুটো এনার্জি বার খেয়ে জিমে ঢোকে, বাড়ি এসে ডিপ ফ্র্যাই করা খাবার খায়। দুই মাস পর দেখে ভুঁড়ি সেই এক‌ই আছে। হতাশা বাড়ে। আস্তে আস্তে জিমে ক্লান্তি আসে। জিম কামাই হতে শুরু করে, ইতিমধ্যে সে আকুপাংচার এবং ইউনানি চিকিৎসা করে ফেলেছে ভুঁড়ি কমাতে। সামনের শুক্রবার সে যাবে গ্রামের এক ফকির বাবার কাছে, যার স্বপ্নে পাওয়া ওষুধ খেলে ১১০ কেজির মানুষ‌ও জিরো ফিগার পায়। শেষমেশ জিমে যাওয়া আর ওয়ার্কআউট বন্ধ করে পাশবালিশকে প্রিয় বন্ধু বানায়।

এরপর আবার অপেক্ষায় থাকে কখন রোজা আসবে আর ডায়েট শুরু করবে। কিন্ত রোজা এলে আল্লাহ ভরসা করে ভাজাভাজি গোগ্রাসে গিলতে থাকে। রাজ্যের যত রকম খাবার আছে, ইফতারিতে তার চাই–ই চাই। শেষ রাতে সেই লেভেলের খাবার খেয়ে নামাজের মধ্যে আউউঃ আউউঃ ঢেঁকুর তুলে সবাইকে জানান দেয়, ডায়েট কি জিনিস আর কাকে বলে। বাঙালি ভাবতে থাকে ঈদের পর আবার নতুন করে শুরু করবে। হয়তো আবার জিমমুখী হওয়ার কথা বেমালুম ভুলে যায়। এভাবে এই চক্র চলতেই থাকে।