পারকি সমুদ্রের ঢেউয়ে এক দিন

ঝাউবাগান পর্যন্ত সমুদ্রের পানি একবার উঠে আবার নেমে যায়। ছবি: লেখক
ঝাউবাগান পর্যন্ত সমুদ্রের পানি একবার উঠে আবার নেমে যায়। ছবি: লেখক

দিনটি ২১ ফেব্রুয়ারি। ছুটির দিন।

খুব ভোরে ঘুম থেকে উঠলাম। উদ্দেশ্য দুটি। শহীদ মিনারে ফুল দেওয়া এবং বেড়ানো। শহীদ মিনার গেলাম, শহীদদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করে ফুল দিলাম। এরপর রওনা দিলাম পূর্বনির্ধারিত স্থানে, যেখানে সব বন্ধুর এক হওয়ার কথা রয়েছে।

চট্টগ্রাম শহরের টাইগার পাস মোড়ে বন্ধুরা আমার অপেক্ষায় দাঁড়িয়ে আছে। আমার সব সময়ই একটু দেরি হয়। এটা একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। ৪ বান্ধবী এবং ৭ বন্ধু মোট একত্র হলাম টাইগার পাস মোড়ে। দুদিন আগেই এক বন্ধু গাড়ি রিজার্ভ করে রেখেছিল। ওই গাড়িও উপস্থিত। সবাই গাড়িতে চেপে বসলাম। গাড়িতে ওঠার আগে এবং পরে সবাই ছবি তোলায় ব্যস্ত। আমিও কয়েকটা সেলফি নিলাম। এখন গন্তব্য একটাই, পারকির চর।

চট্টগ্রাম শহর থেকে ৩৫ কিলোমিটার দূরে পারকি সমুদ্রসৈকত। চট্টগ্রামের দক্ষিণে আনোয়ারা উপজেলায় অবস্থিত ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ সমুদ্রসৈকত পারকি। চট্টগ্রামের নেভাল একাডেমি কিংবা বিমানবন্দর এলাকা থেকে কর্ণফুলী নদী পেরোলেই পারকি চর। যেতে সময় লাগবে ১ ঘণ্টা। আমরাও আনন্দের সঙ্গে যাচ্ছি এই চরে। তবে রাস্তায় কিছুটা জ্যাম ছিল। তাই আমাদের বাড়তি কিছু সময় লেগেছিল।

এটা মূলত কর্ণফুলী নদীর মোহনায় অবস্থিত। অর্থাৎ কর্ণফুলী নদীর মোহনার পশ্চিম তীরে পতেঙ্গা সমুদ্রসৈকত এবং পূর্ব-দক্ষিণ তীরে পারকি সমুদ্রসৈকত। চট্টগ্রাম সার কারখানা ও কাফকো যাওয়ার পথ ধরে এই সৈকতে যেতে হয়। এটি একটি উপকূলীয় সমুদ্রসৈকত।

মাছ ধরার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে হাঁটছেন জেলে। ছবি: লেখক
মাছ ধরার জন্য প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম নিয়ে হাঁটছেন জেলে। ছবি: লেখক

একসময় বাংলাদেশে সমুদ্রসৈকত বলতে শুধু কক্সবাজার এবং পতেঙ্গা সৈকতকে মনে করা হলেও বর্তমানে পর্যটকদের কাছে পারকি সৈকত বেশ জনপ্রিয় হচ্ছে। যার কারণে আমাদেরও প্রাণ টানছিল যেতে। সেই টানেই আমরা পৌঁছালাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অন্যতম স্থান পারকি চরে।

পারকি সমুদ্রসৈকতে যাওয়ার পথে দেখা মিলে অন্য রকম এক দৃশ্যর। আঁকাবাঁকা পথ ধরে ছোট ছোট পাহাড়, চট্টগ্রাম ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড (সিউএফল) এবং কাফকোর দৃশ্যও পর্যটকদের প্রাণ জুড়াবে। বিচে ঢোকার পথে সরু রাস্তার দুপাশে সারি সারি গাছ, সবুজ প্রান্তর আর মাছের ঘের দেখা যায়। সৈকতে কক্সবাজার সমুদ্রসৈকতের মতো অসংখ্য ঝাউগাছ আর ঝাউবনও রয়েছে, যা দেখে সত্যি মনে হচ্ছে আমি কক্সবাজারেই আছি।

পৌঁছেই প্রথমে আমরা ফুটবল নিয়ে খেলতে নামলাম সৈকতে। সাগরপাড়ে ফুটবল খেলার কী আনন্দ, সেটা নিশ্চয়ই সবার অজানা নয়। ফুটবল খেলে নামলাম সমুদ্রে। যেখানে অসংখ্য পর্যটক আনন্দে মেতে উঠেছেন। আমরাও তাঁদের সঙ্গে আনন্দ ভাগাভাগি করতে নেমেছি সমুদ্রে।

চার চাকার মোটরসাইকেলে ঘোরেন পর্যটকেরা। ছবি: লেখক
চার চাকার মোটরসাইকেলে ঘোরেন পর্যটকেরা। ছবি: লেখক

পানির ঢেউ আর বন্ধুদের দুষ্টামি এক অন্য রকম আনন্দের স্বর্গে নিয়ে গেছে আমায়। এক মুহূর্তের জন্য মনে হলো, আমি যেন পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি সুখী মানুষ। এরপর গোসল করে সবাই একটা স্থানীয় হোটেলে বসলাম। ফ্রেশ হয়ে খেতে বসলাম। স্থানীয় হোটেলের খাবারগুলো মোটামুটি ভালোই ছিল। ডাল, মাংস আর সবজি দিয়ে দুপুরের খাবার সারলাম সবাই।

দুপুরের খাওয়া শেষে সবাই সৈকতের পাশে ঝাউবাগান ঘুরছি। এখানে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীরাও বেড়াতে এসেছেন। শিক্ষাসফরের জন্য এটি একটি আদর্শ জায়গা। ওদের বিভিন্ন অনুষ্ঠানও হচ্ছে। ওসব দেখছি। আবার প্রাকৃতিক দৃশ্য অনেকেই সময় কাটায়। সমুদ্রের পাশে গিয়ে অনেকেই সূর্যাস্ত দেখবে বলে দাঁড়িয়ে আছেন। অনেকেই পানির মধ্যে হাঁটছেন। দেখে সত্যি মন জুড়িয়ে যায়। আমার কিছু বন্ধু আবার মোটরসাইকেলেও চালাচ্ছে। এখানে বিভিন্ন গাড়ি আছে। পর্যটকদের ছড়ার জন্য এসব গাড়ি নিয়ে অনেকেই বসে থাকে। দিন শেষে কীভাবে যে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল, বোঝাই গেল না। সবাই গাড়িতে আবার উঠে গেলাম। মন চাইছে থেকে যেতে, তবে সেটা তো আর সম্ভব নয়। তাই ফিরে যেতে হচ্ছে। সেই টাইগারপাসে এসে নামলাম সন্ধ্যা ৭টার দিকে। এরপর সকলে নাশতা করে বিদায় নিলাম। অন্য কোনো দিন অন্য কোনোখানে আবারও আমরা বেড়াতে যাব।

সমুদ্রের কিনারায় বড় জাহাজ। ছবি: লেখক
সমুদ্রের কিনারায় বড় জাহাজ। ছবি: লেখক

কীভাবে যাবেন
চট্টগ্রাম শহরের যেকোনো স্থান থেকেই বাস অথবা টেম্পোতে চট্টগ্রাম শাহ আমানত সেতু বা কর্ণফুলী সেতু যাবেন, ভাড়া ৩০ টাকা (সম্ভাব্য)। সেখান থেকে আনোয়ারার বটতলী মোহছেন আউলিয়ার মাজারের উদ্দেশে ছেড়ে যাওয়া বাসে উঠবেন, ৩০ টাকা। (এখানে বৈলতলী ও বটতলীর দুই রকম বাস ছাড়ে। আপনি অবশ্যই বটতলীর বাসে উঠবেন) বটতলীর মোহছেন আউলিয়া মাজারগামী বাসে উঠে বাসচালকের সহকারীকে বলতে হবে ‘সেন্টার’ নামক জায়গায় যাতে নামিয়ে দেন। সেন্টারে নেমে সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা রিকশাযোগে যেতে পারেন পারকি সৈকত। ভাড়া ৩০ টাকা।

সব মিলিয়ে চট্টগ্রাম শহর হতে যাওয়ার খরচ লোকাল ৯০ থেকে ১২০ টাকার মতো। তবে এখানে রিজার্ভ যাওয়া–আসা বেশি হয়। চট্টগ্রামের যেকোনো জায়গা থেকে রিজার্ভ সিএনজিচালিত অটোরিকশা নিয়ে পারকি সৈকত আসতে পারবেন। এতে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকার মতো খরচ হবে। এ ছাড়া বাস, মাইক্রোবাস ইত্যাদি ভাড়া করলে ৬০০ থেকে ১ হাজার ৫০০–এর মধ্যে যেতে পারবেন।

সমুদ্রে বিকেলের রোদে নৌকা চলার দৃশ্য। ছবি: লেখক
সমুদ্রে বিকেলের রোদে নৌকা চলার দৃশ্য। ছবি: লেখক

থাকবেন কোথায়?
গত কয়েক বছরে প্রচুর পর্যটক আগমনের কারণে এখানে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গড়ে উঠছে মোটেল। পারকি রিসোর্ট যার মধ্যে অন্যতম। পারকিতে রাত কাটাতে চাইলে স্থানীয় রিসোর্টেও উঠতে পারেন। তবে এসব অনেকের পছন্দসই নাও হতে পারে, তাই আপনি চট্টগ্রাম শহরে এসেও রাত্রিযাপন করতে পারেন। চট্টগ্রাম শহরে আছে বেশ নান্দনিক হোটেল ও মোটেল।

সূর্যাস্তের মুহূর্তে সমুদ্রে পর্যটকের ভিড় যেন বেড়ে যায়। অপূর্ব এক দৃশ্য দেখতে হাজির হন সবাই। ছবি: লেখক
সূর্যাস্তের মুহূর্তে সমুদ্রে পর্যটকের ভিড় যেন বেড়ে যায়। অপূর্ব এক দৃশ্য দেখতে হাজির হন সবাই। ছবি: লেখক

খাবেন কোথায়?
পারকি সৈকতে খাবারের জন্য অনেক রেস্তোরাঁ গড়ে উঠেছে। স্থানীয় ছোট হোটেল ছাড়াও আছে জনপ্রিয় কয়েকটি রেস্তোরাঁ। এ ছাড়া অনেকে লোকজন বেশি আসে। তাই চাইলে যাওয়ার আগেই টিম বা ফ্যামিলির জন্য এই রেস্তোরাঁ অগ্রিম খাবার বুক দিতে পারেন। এ ছাড়া পিকনিক কিংবা শিক্ষাসফরে রান্না করে খাওয়ার ব্যবস্থাও রয়েছে এখানে।

লেখক: শিক্ষার্থী, ওমরগণি এমইএস বিশ্ববিদ্যালয় কলেজ, চট্টগ্রাম।