দেশে করোনার দায় কার

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

যে ভাইরাসে দুই মাস যাবৎ গোটা বিশ্ব আক্রান্ত, সেই করোনার উৎপত্তিস্থল ছিল চীনের হুবেই প্রদেশ; যেখানে অসংখ্য মৃত্যু কাঁদিয়েছে সবাইকে। সেই পথেই ইতালিসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশ।

এখন বলা হচ্ছে, দেশে অভ্যন্তরীণ সংক্রমণের উৎস তৈরি হয়েছে। দেশজুড়ে ক্ষীণ আশা ছিল, চীন যেহেতু উৎসটি বন্ধ করতে পেরেছে এবং দক্ষিণ এশিয়ায় গ্রীষ্মকাল শুরু হয়েছে, হয়তো আমরা বড় কোনো ঝুঁকি এড়াতে পারব। হয়েছেও তাই। গত দুই মাসে এ দেশে উল্লেখযোগ্য কোনো সংক্রমণ ছিল না। চীনফেরত উহানের বাঙালি প্রবাসী ও ছাত্রছাত্রীদের সরকার ‘ইনস্টিটিউশনাল কোয়ারেন্টিন’-এর মাধ্যমে কঠোরভাবে এটি নিয়ন্ত্রণ করতে সক্ষম হয়েছিল। যদিও সাধারণ মহলে তীব্র সমালোচনা হয়েছিল এদের ফিরিয়ে আনার বিষয়ে।

মূলত, পশ্চিমা দেশগুলোয়, বিশেষ করে ইউরোপে করোনা সংক্রমণ শুরু হওয়ার পরপরই এ দেশের সরকার চাপের মুখে পড়ে, যেহেতু সেসব দেশে অসংখ্য প্রবাসী বাংলাদেশি নাগরিক বা কর্মী রয়েছেন। অবশ্যই তাঁরা এই সংকটে দেশে ফেরত আসতে পারেন বা নিরাপদে থাকার অধিকার রয়েছে তাঁদের। সরকারের দায়িত্ব তাঁদের প্রত্যেককে দেশে ফেরার ব্যবস্থা করা। সেটিই করা হয়েছে যা অন্য সব দেশই করেছে।

এখন প্রশ্ন হচ্ছে, প্রত্যেক প্রবাসীর জন্য প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিন এবং গভীর পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা কি করা যেত না? স্কুল-কলেজ বন্ধ করে হলেও জায়গা করা উচিত ছিল এবং তাতে করে কমিউনিটি ট্রান্সমিশন আরও কমানো যেত। প্রয়োজনে আরও আগেই লকডাউন করা যেত। বিশেষ করে গত দুই সপ্তাহে যত প্রবাসী এসেছেন, তাঁরা সবাই ভয়াবহ ঝুঁকি নিয়ে এসেছেন। এমনকি তাঁদের কোয়ারেন্টিন কোনো রকম প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা করার সুযোগও হয়নি।

এদিকে করোনার চিকিৎসাব্যবস্থা এখনো সম্পূর্ণ ঢাকাকেন্দ্রিক, যেটি কোনোভাবেই কাম্য নয়। ঢাকার বাইরে অনেকেই করনার প্রাথমিক লক্ষণ বহন করতে পারেন। এ ছাড়া অনেকেই জানেনই কোথায়, কীভাবে পরীক্ষা করতে হবে। এটি একটি বড় দায়িত্ব ছিল সরকারের। সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি সাধারণ মানুষকে আতঙ্কিত করছে, তা হলো ঋতু পরিবর্তনের কারণে সাধারণ ঠান্ডা-জ্বর বা কাশি। এ জ্বরে আক্রান্ত অনেকেই চিকিৎসক বা স্থানীয় বেসরকারি হাসপাতালগুলোয় চিকিৎসা করতে যাচ্ছেন না বা হাসপাতালগুলো ও চিকিৎসকেরাও দায়িত্ব নিতে চাইছেন না। এতে মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে, সরকারি ব্যবস্থাপনায় আস্থা কমছে এবং ছড়াচ্ছে আতঙ্ক। আর রয়েছে বিচ্ছিন্ন বা একঘরে হওয়ার ভয়। অথচ এসব প্রতিরোধ করার জন্য আমরা দুটি মাস সময় পেয়েছিলাম।

এ ছাড়া, করোনা শনাক্তকরণের জন্য প্রয়োজনীয় উদ্ভাবন বা বিপণনের যে ব্যবস্থার কথা আমরা এখন শুনছি, সেটি সরকারি অর্থায়নে আরও এক মাস আগেই হতে পারত। যেহেতু সরকারের পরিকল্পনা ছিল ফিরতে ইচ্ছুক প্রায় সব প্রবাসীকে সুযোগ দেওয়া হবে, তাই আগেই করা যেত। এরই মধ্য হতাশার বিষয়টি হলো সবকিছু বন্ধ করার পর অনেক দেশ থেকে প্রায় দেড় হাজার প্রবাসী দেশে ফিরেছেন কোনো প্রস্তুতি ছাড়া।

এবার আসি সাধারণ মানুষের কথায়। গত দুদিন বিভিন্ন পত্রিকা আর সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রধান আলোচ্য ছিল, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধের সুযোগে ছুটির আমেজে দেশের বিনোদন কেন্দ্রগুলোতে ছড়িয়ে পড়ছে লোকজন। অনেকেই ভাবছেন এটি শুধু বিদেশ থেকে আগত ব্যক্তি বা প্রবাসীদেরই সমস্যা। অথবা তাদের সংস্পর্শে না গেলেই চলবে!

এ ভাইরাসের ভয়াবহতা ও প্রতিরোধ বিষয়ে সরকারি ও বেসরকারি প্রচারণা হাত ধোয়া ও মাস্ক পরার মধ্যে সীমিত রাখার সুযোগ নেই। সংক্রমণের মাধ্যম নিয়ে সচেতনতা বাড়ানোর জোর চেষ্টা করতে হবে। এখনো ওয়াজ মাহফিল, দোয়া মাহফিল হচ্ছে মানুষ নিয়ে। কী ভয়ংকর! জড়িত স্থানীয় প্রশাসনকে অবশ্যই এর জন্য জবাবদিহি করতে হবে। তবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমসহ বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে সাধারণ মানুষে একে অন্যকে সচেতন করার চেষ্টা করছে, সেটি খুবই প্রশংসনীয়। এ ছাড়া শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ সমগ্র জাতি যার যার জায়গা থেকে এই সংকট কাটাতে যেসব উদ্যোগ নিচ্ছে, তা আশাব্যঞ্জক।

তবে যেটি বাকি সব কথার কারণ, তা হলো সদ্য ফেরত প্রবাসীদের দায়িত্বজ্ঞানহীনভাবে হোম কোয়ারেন্টিন মেনে চলার ক্ষেত্রে করা অনিয়ম। তাঁদের অবশ্যই ভাবতে হবে এ দেশে করোনার সংক্রমণ তাঁরাই বয়ে নিয়ে এসেছেন এবং সেটি শুধু দেশ নয়, তাঁদের পরিবার এবং সমাজের জন্যও মারাত্মক হুমকি। বিভিন্ন কারণে এ দেশের মানুষের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কম, দারিদ্র্যের কারণে অপুষ্টিতে ভোগেন, নেই স্বাস্থ্যসচেতনতা ও সুব্যবস্থা। এমন একটি দেশে সরকারি নিষেধ অমান্য করে স্বার্থপরের মতো তাঁরা যা করছেন, সেটি দেশের মানুষ কেন মেনে নেবে? হাসপাতাল থেকে পালাচ্ছেন, বিয়ে করছেন, ঘুরে বেড়াচ্ছেন ইত্যাদি! তার ওপর রয়েছে ঔদ্ধত্য ও অসহযোগিতা। তাঁরা বারবারই বলছেন দেশের বাইরে তাঁদের পরীক্ষা করা হয়েছে, কিন্তু ট্রানজিট থেকে আসার পথে যে তাঁরা আক্রান্ত হবেন না বা সঙ্গে বহনকৃত কোনো বস্তু থেকে যে তাঁরা সংক্রমিত হবেন না, সেটি কে বলবে? এ দেশের মানুষ ও চিকিৎসকেরা জীবনের ঝুঁকি নিয়ে তাঁদের সেবা করছেন সেই বিমানবন্দর থেকে শুরু করে এই অবধি, সেটি কি তাঁরা চাইলেই এড়াতে পারতেন না? ইতিমধ্যে বেশ কজন চিকিৎসক সংক্রমণ সন্দেহে কোয়ারেন্টিনে গিয়েছেন। কোথায় প্রবাসীরা তাঁদের প্রতি কৃতজ্ঞতা জানাবেন, উল্টো সবাইকে ভয়ংকর ঝুঁকিতে ফেলছেন। এমনকি ইতালিতে আইন ভেঙে বাইরে আসার দায়ে কয়েকজন বাংলাদেশি আটক হওয়ার খবর মিলেছে। এ তো রীতিমতো অন্যায়! কী চাইছেন তাঁরা? এখন পর্যন্ত দেশে যতজন আক্রান্ত হয়েছেন বা মৃত্যুবরণ করেছেন, সবাই হয় প্রবাসী, না হয় তাঁদের মাধ্যমে সংক্রমিত। এমনকি স্কুলের শিশুরাও তাদের বাচ্চাদের মাধ্যমে আক্রান্ত হতে পারে। তারপরও কি দায় অস্বীকার করবেন?

প্রবাসীদের যেমন দেশে ফেরার অধিকার রয়েছে, তেমনি দেশে অবস্থানরত প্রত্যেক নাগরিকেরও নিজস্ব স্বাস্থ্য-নিরাপত্তার অধিকার রয়েছে। তাই সরকারকে আর একটি মুহূর্তও নষ্ট না করে এখনই ভীষণ কঠোর হতে হবে প্রবাসী ও স্থানীয়দের অবাধ চলাফেরা ও জমায়েত বন্ধের ক্ষেত্রে। কয়েক স্তরে নজরদারি বাড়ানো হোক। কঠোরভাবে অভ্যন্তরীণ ভ্রমণ ও বহির্গমন বন্ধ করতে হবে; অফিস-আদালত বন্ধ করার উপযুক্ত সময় এখনই। প্রয়োজনে ১৪৪ ধারা জারি করা যেতে পারে।

চীন ও দক্ষিণ কোরিয়াকে দেখে আমাদের শেখা উচিত; মাত্র কয়েক দিনের মধ্যে উহানকে বহির্বিশ্ব ও চীনের বাকি অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন করে কত দ্রুত তারা সফল হয়েছে। তাই আরও বড় কোনো ক্ষতি হওয়ার আগেই দেশের প্রতিটি অঞ্চলে করোনা শনাক্তকরণ কেন্দ্র, জরুরি চিকিৎসা ও পরিবহনব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। ১৬ কোটি মানুষের জীবন ও স্বাস্থ্য অধিকার নিয়ে বারবার গাফিলতি করার সুযোগ নেই। সরকারের সব পরিকল্পনার পাশাপাশি প্রতিটি স্থানীয় ও প্রবাসী বাংলাদেশির নিজেকে, পরিবারকে ও সমাজকে এই ভয়ংকর ভাইরাস সংক্রমণ থেকে রক্ষার সর্বোচ্চ চেষ্টার কোনো বিকল্প নেই। একটি জীবনও যেন কারও অবহেলায় নষ্ট না হয়, সে হোক স্থানীয় বা প্রবাসী!

লেখক: সহযোগী অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়