মহামারি করোনার প্রকোপ রোধে সামাজিক দূরত্ব

সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলে করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে নিজেকে অনেক আড়াল করা যায়।
সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখলে করোনাভাইরাস সংক্রমণ থেকে নিজেকে অনেক আড়াল করা যায়।

যানবাহনের পেছনে আমরা প্রায়ই একটা বাক্য লেখা থাকতে দেখি, ‘১০০ হাত দূরে থাকুন’। মাঝেমধ্যে আমরা রাগের বশেই হোক বা মজা করে হোক, একে অন্যকে বলি, ‘দূরে গিয়া মর!’ এসবের মূলকথাই হলো ‘দূরত্ব বজায় রাখুন’।

হ্যাঁ, দূরত্ব বজায় রাখুন। সামাজিক দূরত্ব মেনে চলুন।

সামাজিক দুরত্ব আসলে কী? সামাজিক দূরত্ব হলো কিছু নীতিমালা, যেগুলো সংক্রামক বা ছোঁয়াচে রোগের দ্রুত ছড়িয়ে পড়া রোধ করে। এ ক্ষেত্রে পরস্পরের মধ্যে ছয় ফুট বা প্রায় দুই মিটারের ব্যবধান বজায় রাখতে হয়।

সামাজিক দূরত্বের এই পদ্ধতি এখন প্রমাণিত।
সামাজিক দূরত্বের এই পদ্ধতি এখন প্রমাণিত।

আমাদের দেশে প্রচলিত কিছু অভ্যাস আছে, যা কিন্তু খুব একটা সুখকর নয়। যেমন কাঁধে হাত দিয়ে বা গলাগলি ধরে দুলতে দুলতে হাঁটা। এটা এতটাই প্রকট যে কিছুদিন আগে আমার সপ্তম শ্রেণির দুই শিক্ষার্থীকে ক্লাসে গলাগলি ধরে বসে থাকতে দেখে ‘এটা রাস্তাঘাট নয়, ক্লাসরুম’ বলে বেশ কঠোরভাবেই সতর্ক করতে হয়েছে। অনেকেরই আরেকটা অভ্যাস আছে। দেখা হলেই চাপড় মেরে কেমন আছে জানতে চাওয়া বা হাগ করা। অনেক দিন পর দেখা হলে আপনি হাগ করতেই পারেন। না করলে বরং আপনার মায়ামমতা নিয়ে প্রশ্ন উঠে যায়। তাই বলে নিত্য যাদের সঙ্গে দেখা হচ্ছে, তাদের সঙ্গে কথায় কথায় হাগ দেওয়া বা চাপড় দেওয়াকে ভালো অভ্যাস বলা চলে না!
আরেকটা ব্যাপার হলো, কথা বলতে গিয়ে একেবারে মুখোমুখি দাঁড়ানো। এতে যার সঙ্গে কথা বলছেন, তিনি বিব্রত হতে পারেন অথবা আপনার অনিচ্ছা সত্ত্বেও কথা বলার সময় থুতু তার গায়ে লাগতে পারে অথবা হুট করেই আপনার হাঁচি-কাশি চলে এল! ভাবুন তো, ব্যাপারটা কী রকম অস্বস্তিকর!

এসব বদভ্যাস দূর করার জন্য করার জন্য একটু দূরত্ব বজায় রেখে চললে তা কিন্তু আপনার জন্যই ভালো। এ অছিলায় আপনি মোটামুটি সব সময়ই ভাইরাসজনিত রোগবালাই থেকে অন্যদের তুলনায় কিছুটা হলেও নিরাপদ থাকবেন। আর মহামারি হলে তো কথাই নেই!
এ জন্যই আসলে ‘সামাজিক দূরত্ব’ বা ‘Social Distancing’।

সেই ১৯১৮ সালে যখন ‘স্প্যানিশ ফ্লু’ মহামারি আকার ধারণ করে, তখন এবং তার প্রায় এক শ বছর পর ২০১৪ সালে ইবোলা ভাইরাসের ছড়িয়ে পড়া ও সংক্রমণ রোধে ‘social distancing’। অনেক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল। ষাটের দশকে যখন ‘এসিয়ান ফ্লু’ মারাত্মক আকার ধারণ করে, তখন সামাজিক দূরত্বই এর সংক্রমণ হার ৯০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশে কমিয়ে নিয়ে আসে।

সামাজিক দূরত্ব হলো কিছু নীতিমালা, যেগুলো সংক্রামক বা ছোঁয়াচে রোগের দ্রুত ছড়িয়ে পড়া রোধ করে।
সামাজিক দূরত্ব হলো কিছু নীতিমালা, যেগুলো সংক্রামক বা ছোঁয়াচে রোগের দ্রুত ছড়িয়ে পড়া রোধ করে।

অতিসম্প্রতি বিশ্বজুড়ে মহামারি আকার ধারণ করা কোভিড–১৯–এর ব্যাপক হারে ছড়িয়ে পড়া রোধেও ইতিমধ্যেই ‘Social Distancing’ ভূমিকা রাখতে শুরু করেছে। দক্ষিণ কোরিয়া এ ব্যাপারে আশাব্যাঞ্জক সাফল্য লাভ করেছে। চীনা সাংবাদিক ডেনিশ নরমিলের এক প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ২৯ ফেব্রুয়ারিতে দক্ষিণ কোরিয়াতে আক্রান্তের সংখ্যা ৯০৯–এ পৌঁছে গিয়েছিল সেখানে ১৭ মার্চ এ সংখ্যা কমে ৮৪ জনে নেমে আসে। সর্বশেষ ২১ মার্চে সংখ্যা ছিল ১৪৭। আশ্চর্য হলেও সত্যি যে এটা সম্ভব হয়েছে কোনো রকম লকডাউন ছাড়াই!

তবে এখানে কোরিয়ান সরকার ২ লাখ ৭০ হাজারের বেশি সন্দেহভাজনকে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা এবং আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তিদের ট্র্যাক করার একটি অ্যাপসও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

এতে অনুপ্রাণিত হয়ে অস্ট্রেলিয়া সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে ১৫ মার্চ একটি বার্তা প্রকাশ করেছে। এতে স্পষ্ট করে বলা হয়েছে বাড়ি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র এবং জনসমাগম এ সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে।

‘Social Distancing’ বা ‘সামাজিক দূরত্ব’–এর ভূমিকা নিয়ে সম্প্রতি একটি চমৎকার প্রতিবেদন প্রকাশ করেছে ওয়াশিংটন পোস্ট।

ষাটের দশকে ‘এসিয়ান ফ্লু’ যখন মারাত্মক আকার ধারণ করে, তখন সামাজিক দূরত্বই এ সংক্রমণের হার ৯০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশে কমিয়ে নিয়ে আসে।
ষাটের দশকে ‘এসিয়ান ফ্লু’ যখন মারাত্মক আকার ধারণ করে, তখন সামাজিক দূরত্বই এ সংক্রমণের হার ৯০ শতাংশ থেকে ৫০ শতাংশে কমিয়ে নিয়ে আসে।

কতগুলো কার্ভ, সিমুলেশন দিয়ে তারা খুব ভালোভাবে মহামারির প্রকোপ রোধে সামাজিক দূরত্ব কীভাবে কাজ করে তার ব্যাখ্যা দিয়েছে। প্রথম চিত্রটি (ছবিটি) যদি দেখি, তাহলে দেখা যাবে যখন ‘free for all’ অর্থাৎ সবাই অবাধে মেলামেশা করছে, তখন sickness rate অনেক high। একেবারে সর্বাধিক উচ্চতায় পৌঁছে গেছে। যেটা আমরা বর্তমানে ইতালির ক্ষেত্রে প্রত্যক্ষ করছি। আবার ‘attempted quarantine’–এ অর্থাৎ কিছু পরিমাণ মানুষ দূরত্ব বজায় রাখছে তখন কিন্তু ‘sickness rate’ কম। আবার অধিকাংশ মানুষ যখন একটা সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে চলছে, তখন ‘sickness rate’ আরও কম।

সর্বশেষ মানুষ যখন ‘extensive distancing’ ফলো করছে, তখন কিন্তু sickness rate একেবারেই কমে আসছে। দক্ষিণ কোরিয়া যেটা ফলো করেছে। তাদের বাসস্টপ বা ট্রাফিক সিগন্যালে এই মুহূর্তে লেখা আছে, ‘Hold on! lets take a break from social life!’

ওয়াশিংটন পোস্টের সিমুলেশনগুলো দেখে বোঝা যায়, মানুষের মেলামেশায় barrier থাকলে ভাইরাসঘটিত রোগ বা মহামারি সংক্রমণের গতিকে তুলনামূলক স্লথ করে দেয়।

কোরীয় সরকার করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা এবং আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তিদের ট্র্যাক করার একটি অ্যাপসও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।
কোরীয় সরকার করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা এবং আইসোলেশন ও কোয়ারেন্টিনে থাকা ব্যক্তিদের ট্র্যাক করার একটি অ্যাপসও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে।

তবে গবেষণা এটাও বলে যে আইসোলেশন ডিভোর্সের হার বাড়িয়ে দিতে পারে, একাকিত্ব, হতাশা—এগুলোও সৃষ্টি করতে পারে। এ জন্যই আমরা যদি সব সময় একটা স্বাভাবিক ভদ্রতাসূচক দূরত্ব বজায় রাখতে পারি, তবে আইসোলেশনের মতো যন্ত্রণাদায়ক বিষয় আমাদের খুব একটা প্রভাবিত করতে পারবে না।

প্রতিটি আপদই আমাদের পরবর্তী সময়ে আরও ভালো ও সুস্থভাবে বেঁচে থাকার জন্য কিছু না কিছু শিখিয়ে যায়। করোনা হয়তো আমাদের মানবসভ্যতার বেশ ক্ষতি করবে। কিন্তু এটা আমাদের শিখিয়ে যাক নিরাপদ দূরত্ব বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার অভ্যাস যেন আমরা পরবর্তী সময়ে ছোটখাটো অনেক বায়ুবাহিত বা ভাইরাস ঘটিত রোগবালাই থেকে মুক্ত থাকতে পারি।

সর্বশেষে একটি কথা না বললেই নয়, চিকিৎসাবিজ্ঞানও যেখানে আশার আলো খুঁজে পায় না, সেখানে অনেক বড় বড় চিকিৎসক-গবেষকও দুটি উপদেশ দেন, ‘ধর্মীয় অনুশাসন মেনে চলুন এবং নিয়মতান্ত্রিক জীবন যাপন করুন।’

সবাই সুস্থ থাকুন। নিরাপদে থাকুন। শুভকামনা।

কৃতজ্ঞতা: সালমা সিদ্দিকা, পিএইচডি গবেষক, নর্থ ক্যারোলাইনা স্টেট ইউনিভার্সিটি

তথ্যসূত্র:
www.hopkinsmedecine.org
www.cdc.gov
sciencemag.org/author/dennis-normille
http://www.health.gov.au
http://www.washingtonpost.com/graphics/world/corona-simulator