করোনাভাইরাস ও আমাদের ভবিষ্যৎ

এই গ্রাফে ইতালির কীভাবে কোভিড–১৯ ছড়িয়ে পড়েছে তা দেখানো হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত
এই গ্রাফে ইতালির কীভাবে কোভিড–১৯ ছড়িয়ে পড়েছে তা দেখানো হয়েছে। ছবি: সংগৃহীত

করোনাভাইরাস প্রথম যখন উহানে আসে, তখন আমরা বোধ হয় ধরে নিয়েছিলাম এ দেশে আসবে না। এত দূর থেকে ভাইরাস কীভাবে আসবে? চীনের হুবেই প্রদেশের উহান যখন নিজেদের যুদ্ধে ব্যস্ত, আমরা তখন শান্তিতে দিন কাটাচ্ছিলাম, সত্যিকার অর্থে আমরা ঘুমাচ্ছিলাম।

চীনারা খুব শক্ত হাতে যখন উহান লকডাউন করেছিল, অনেকে এর সমালোচনাও করেছিলেন। তখনো সারা বিশ্বের ঘুম ভাঙেনি। এরপর যখন করোনা ইতালি, ইরানে ছড়িয়ে গেল, আমাদের এশিয়া তখনো ঘুমে। কেবল মনে হয় সকাল হলো। আজ ইতালির ভয়ংকর অবস্থা। স্পেন, আমেরিকা, কানাডা যুদ্ধে ব্যস্ত। ভাইরাস মুসলিম, হিন্দু, খ্রিষ্টান, ধনী, গরিব, দেশ, সীমান্ত কিছুই বোঝে না। আর আমরা বাঙালিরা কেবল ঘুম থেকে এক মোচড় দিয়ে আরেক দিকে ঘুরে অ্যালার্ম অফ করে আধো ঘুমে এখনো ব্যস্ত। যারা আবার বেশি সচেতন, তারা বাসার খাবার স্টকে ব্যস্ত আর অন্যের সমালোচনাই ব্যস্ত সামাজিক মাধ্যমে।

অনেক ভালো কাজ দেখলাম এর মাঝে। বুয়েট, চুয়েট, গণস্বাস্থ্য, ব্র্যাক, কেরু অ্যান্ড কোম্পানিসহ আরও নাম না–জানা অনেকে।

কী করা উচিত ছিল বা কী করছি আমি, এখন ওই দিকে না যাওয়াই ভালো। যেহেতু আমাদের তো টাইম মেশিন নেই। আমাদের সাধ্য নেই যা হয়ে গেছে তা থেকে মুক্তি পাওয়ার। বরং কী করা উচিত, সেদিকে মনোনিবেশ করা বুদ্ধিদীপ্ত হবে।

প্রথমত, আমি মনে করি, আমাদের দেশের নীতিনির্ধারকদের ধরে নিতে হবে এখন পর্যন্ত এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় শত্রু, যার সঙ্গে আমাদের যুদ্ধ করতে হবে। করোনাভাইরাসকে দুর্বল করে দেখার কোনো কারণ আর এখন নেই।

ইতালির গ্রাফে (প্রথম ছবি) দেখা যায় প্রথম ১৫ দিন মোটামুটি ফ্ল্যাট। তারপর প্রতিদিন রোগীর সংখ্যা অস্বাভাবিক হারে বাড়তে থাকে। সব দেশের গ্রাফ পর্যালোচনা করে দেখা যায় একই রকম। আমাদের ক্ষেত্রেও এর ব্যতিক্রম আশা করা বোকামি। বরং প্রথম ১৫ দিন বা ২০ দিন পর আমাদের রোগী সংখ্যা ইতালির থেকে আরও বেশি হারে বাড়তেও পারে।

দ্বিতীয়ত, লকডাউন শব্দটি খুব প্রয়োজনীয় শোনালেও দেশের প্রতিটি মানুষকে একসঙ্গে করে কাজ করে যেতে হবে। আগে আসুন দেখি লকডাউন হলে কী কী হতে পারে—

আমাদের দেশের বড় একটা অংশ দিন আনে দিন খায়। সমাজের ধনী–গরিব পার্থক্য অনেক বেশি। করোনার আতঙ্কে এক অংশ কেনাকাটা করে বাড়িতে খাদ্য মজুতে ব্যস্ত, আরেক অংশ ব্যস্ত অধিক মুনাফায় আর সবচেয়ে বড় অংশ না খেয়ে জীবন কীভাবে কাটবে সেটা ভাবতে ব্যস্ত।

সবকিছু বন্ধ করে দিলে ভাবতে হবে দিনমজুরদের কথাও। ছবি: সংগৃহীত
সবকিছু বন্ধ করে দিলে ভাবতে হবে দিনমজুরদের কথাও। ছবি: সংগৃহীত

হ্যাঁ, আমি তাদের কথা বলছি, যাদের দিন চলে দিনের আয়ে। কী হবে আপনি যদি একা বাড়িতে খাবার স্টক করে রাখেন আর এক অংশ না খেয়ে আপনার বাড়িতে খাবারের জন্য হামলে পড়ে? কী হবে আপনি একা বাসাবাড়িতে বসে থাকলেন আর সমাজের বড় অংশ দিনের খাবার জোগাড় করতে বাইরে বেরিয়ে এলে? ওদের তো পেট চালানোর মতো অবস্থা এখনই নেই। লকডাউন করলে ওরা কী করবে? যদি অস্বাভাবিক কিছু করে, এটা কি ওদের দোষ হবে, না দোষ হবে আমার–আপনার? এটা চিন্তার দায় আপনাদের হাতেই ছেড়ে দিলাম।

এবার বাস্তবতাই ফিরে আসি। আমাদের সরকারের এত টাকা নেই, তাদের তিনবেলা এক মাস বা দুই মাস খাওয়াবে। কানাডা, আমেরিকার মানুষের মধ্যে ধনী–গরিব ব্যবধান আমাদের থেকেও কম। ওরা আমাদের থেকে ধনী দেশ। তাই শুধু সরকারের ওপর সব দায়িত্ব না দিয়ে এর দায়িত্ব আমাদের নিতে হবে। যারা আমাদের সামর্থ্য আছে, তাদের এলাকাভেদে এই পদক্ষেপ নিয়ে তাদের খাওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। অথবা সরকারকে আমাদের টাকা দিতে হবে যেন সরকার বিপদে না পড়ে। এ ক্ষেত্রে আমাদের সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে। হ্যাঁ, ঠিক যুদ্ধের মতো। এ জন্য সরকার কিছু ভলান্টিয়ার নিয়োগ করতে পারে। ডিজিটাল উপায়ে টাকা কালেক্ট করতে পারে। মানুষের বাইরে বের হয়ে টাকা দিতে হবে না এবং এলাকাভেদে এভাবে যারা দিন আনে দিন খায়, তাদের সহায়তা করা যেতে পারে। তবে এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, এখানে দুর্নীতি হলে কোনো ছাড় নয়। সাধারণ মানুষ কমবেশি জানে বাংলাদেশের দুর্নীতির অবস্থা। একটি ওয়েবসাইট বানিয়ে সেখানে দিনে কত টাকা এল ডোনেশন এবং কত খরচ হলো, তা প্রকাশ করা হলে মানুষের বিশ্বস্ততা বাড়বে। আমার বিশ্বাস, অনেকে এতে খুশি হয়ে ডোনেশন দেবে। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশের লিডিং পত্রিকা বা কিছু বিশ্ববিদ্যালয়কে দায়িত্ব দেওয়া যেতে পারে। এ ধরনের পদক্ষেপ দ্রুত আমি আশা করি। প্রয়োজন হলে আমি ভলান্টিয়ার হতে প্রস্তুত। শুধু আমি না, আমার বিশ্বাস আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম এতে নিজের জীবন দিয়ে হলেও দেশকে এই ক্রান্তিলগ্ন থেকে বের করে আনতে প্রস্তুত আছে। শুধু তাদের দেখাতে হবে আমরা ভালো কাজ করছি।

লকডাউন করার পর আমাদের সেলিব্রেটি, খেলোয়াড়, ইমাম—সবাইকে দিয়ে প্রচার চালালে যদি আমরা লকডাউন করতে পারি এবং সেই সঙ্গে দেশের আইনশৃঙ্খলা বজায় রেখে এবং গরিব মানুষের খাবারের ব্যবস্থা করতে পারি তবেই এর মুক্তি সম্ভব।

এটা একটা যুদ্ধ, তাই যাঁরা স্বার্থপর এর মতো শুধু নিজের কথা ভাবছেন, আমি বলি এই যুদ্ধে একা জয়ী হওয়ার উপায় নেই। আসুন আমরা সবাই একসঙ্গে ঝাঁপিয়ে পড়ি। আমরা বীরের জাতি। হয়তো আমরা এত দিনে অনেকটাই ঘুমন্ত। আমি এখনো বিশ্বাস করি আমরা একসঙ্গে সবাই মিলে কাজ করতে পারি, করোনা থেকে আমরা মুক্তি পাবই। উহানের মতো আমরাও আতশবাজি ফুটিয়ে আমাদের জয় উদ্‌যাপন করতে পারব।