আমরা বড্ড গুজবপ্রেমী

সংস্কার বিশ্বাস না করলেও আমরা কুসংস্কার খুব ভালোই বিশ্বাস করি। আজব এক জাতি আমরা, আমরা গুজবে বেশি বিশ্বাসী। আমাদের চিন্তা–চেতনা, বুদ্ধি–বিবেক—সবকিছুই দিন দিন খারাপের দিকে যাচ্ছে। আমাদের বিবেক–বুদ্ধি ইদানীং তলানীর দিকে যাচ্ছে। বিশ্বস্ত সূত্র থেকে এত সতর্ক থাকার বাণী আসে কিন্তু সেগুলো আমরা বিশ্বাস করি না। সেগুলো বিশ্বাস না করলেও আমরা তা ভালোভাবেই জানি, কিন্তু মানি না। জানতে ভালোই পারি কিন্তু মানতে আমরা নারাজ। মানতে কেন এত কষ্ট তা কে জানে!

গুজব আমাদের কাছে খুবই পরিচিত একটা বিষয়। আমরা গুজবে খুব দ্রুত বিশ্বাস করে ফেলি। গুজবকে বা কারা ছড়ায়, তা আমরা হয়তো জানিও না, কিন্তু এই ধরনের নিউজগুলো কেন যে এত বেশি ছড়ায়, তা কে জানে!

করোনাভাইরাস বিশ্বব্যাপী চরম আতঙ্ক সৃষ্টি করেছে। বিশ্বব্যাপী ব্যাপক হারে মানুষ মারা যাচ্ছে। ইউরোপীয় দেশগুলো একদম হিমশিম খেয়ে যাচ্ছে পরিস্থিতি সামাল দিতে। বিশেষ করে ইতালির অবস্থা তো খুবই খারাপ। খারাপ অবস্থায় রয়েছে স্পেনও।

আসলে খারাপ নেই কে? কারা চিন্তামুক্ত আছে? সব ধরনের খেলাধুলা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। অনেক দেশেই জরুরি অবস্থা জারি হয়েছে। গণজমায়েত একদম বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে, লকডাউন হয়ে গেছে সবকিছু। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা করোনাকে মহামারি ঘোষণা করেছে। বিশ্বব্যাপী ১০০ বছর পরপর আসছে এই ধরনের মহামারি। বিশাল একটি পরীক্ষার সম্মুখীন পুরো বিশ্ব।

সবাইকে সাবধান থাকতে বলা হচ্ছে, নিরাপদ থাকতে বলা হচ্ছে, পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে বলা হয়েছে। যাঁরা বিদেশ থেকে এসেছেন, তাঁদের কোয়ারেন্টিনে থাকতে বলা হয়েছে। সেগুলো না করে তাঁরা অনেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছেন, কেউ আবার বিয়েও করে ফেলেছেন এই সুযোগে। সবাইকে রাস্তায় মাস্ক পরে বের হতে বলা হচ্ছে। আমাদের অধিকাংশ মানুষই এসব নিয়মকানুনের তোয়াক্কা করেনি।

কিন্তু! মাঝরাতে একটা খবর এল যে থানকুনিপাতা খেলে নাকি করোনায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা নেই। সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল থানকুনিপাতার জন্য। থানকুনিপাতা অবশ্যই একটা ভালো জিনিস। এর অনেক গুরুত্ব রয়েছে। রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বৃদ্ধিতে ভালো কাজ করে থানকুনিপাতা। কিন্তু তাই বলে এই প্রাণঘাতী ভাইরাস ঠেকাবে, এ কথা কীভাবে বিশ্বাস করল মানুষ!

‘এই নিয়েছে ওই নিল যা, কান নিয়েছে চিলে,
চিলের পিছে ঘুরছি দেখো, আমরা সবাই মিলে।’

কান তো নিয়েই যাচ্ছে, তাই আমরা সারা দুনিয়া ঘুরে এসেছি। কিন্তু একবার কানে আমরা হাত দিয়ে দেখি না। এমনও দেখা গেছে কাউকে ঘুম থেকে থানকুনিপাতা জোগাড় করতে বলা হচ্ছে। আত্মীয়স্বজনের বাসায় থানকুনিপাতা দিয়ে আসছে অনেকে। ভোর রাতে নারী-পুরুষনির্বিশেষে সবাই মিলে থানকুনিপাতা খুঁজতে বের হয়ে গেছে। এই পাতায় যদি আসলেই কোনো গুণ থেকে থাকে, তাহলে তো ভালো, কিন্তু এর জন্য এভাবে বদ্ধ পাগলের মতো আচরণ করা সমীচীন নয়।

গুজব রটানোতে আমরা কিন্তু নতুন নই। এটা আমাদের জন্য একটা পর্যায়ক্রমিক প্রক্রিয়া। একটা নির্দিষ্ট কিংবা অনির্দিষ্ট মহল এই গুজব ছড়ানোর কাজে ব্যস্ত থাকে।

নিরাপদ সড়ক চাই আন্দোলনের সময় দেখা যায় একটি মেয়ে মানুষ মরার খবর ছড়িয়ে দিল। একজন মডেলকেও দেখা যায় একই কাজ করতে। যার জন্য তাকে অনেক চড়াই–উতরাই পার করতে হয়েছে।

এই গুজবপ্রক্রিয়ার সবচেয়ে বাজে রূপ দেখা যায় পদ্মা সেতু নিয়ে। আচমকা একটা নিউজ ছড়িয়ে পড়ে যে পদ্মা সেতুর কাজের জন্য মানুষের মাথা প্রয়োজন। এই ধরনের কথাবার্তা আমাদের সভ্য সমাজ খুব সুন্দরভাবে গ্রহণও করল। সবাই সচেতন হয়ে গেল, কিন্তু সচেতনতার উল্টো পিঠ বাইরে প্রদর্শিত হলো। বিভিন্ন জায়গায় সন্দেহজনক মনে অনেককে গণপিটুনি দেওয়া হয়। গণপিটুনিতে বাড্ডায় তাসলিমা রেণু নামের এক নারী নিহত হন। তিনি বাচ্চার স্কুল খুঁজতে গিয়েছিলেন, তাঁর এই ঘটনা সবার মনে দাগ লাগিয়ে দেয়। আমরা মুহূর্তেই এভাবে কেন যে এত বর্বর হয়ে যাই।

এরপর আসে পেঁয়াজ ও লবণ। পেঁয়াজ নিজে মূলত গুজব ছড়ায়নি। পেঁয়াজের দাম ৩০০ টাকা কেজি পর্যন্ত হতে দেখা গেছে এই দেশে। এই ধরনের বিষয় কখনো কারও কল্পনায়ও ছিল কি না, কে জানে। পেঁয়াজের দাম সবার মনে ভয় ধরিয়ে দেয়।

লবণের দাম বেড়ে গেছে এটা শুনে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়ে লবণ কিনতে। আসলে ঘরপোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় তো পাবেই। আমরা তো এমনিতেই নিঃস্ব। আমাদের এমনিতেই অনেক ভয়। আমরা জানি যে সারা বছর পচা–বাসি পণ্য জমিয়ে রাখা হয় উৎসবের সময় বিক্রি করার জন্য। এ জন্যই তো আমরা করনার ইস্যুতে গুজব ছড়ানোর আগেই বেশি করে মাস্ক আর হ্যান্ড স্যানিটাইজার কিনে রেখেছি। এখানে আর গুজব ছড়ানোর প্রয়োজন পড়েনি।

একই কারণে সবাই জানে যে করোনা আমাদের দেশে সেভাবে আক্রমণ করলে খাদ্যের সংকট পড়বে। তাই মূল্যবৃদ্ধির গুজব ছাড়াই সবাই মণে মণে চাল কেনা শুরু করেছে, শুরু করেছে অন্যান্য পণ্য কেনাও। কিছুদিন পরে দেখা যাবে বাজারে কিছু পাওয়াও যাবে না। পাওয়া গেলেও দাম হবে চড়া। আর যাদের মজুত করার সামর্থ্য নেই, তারা মরবে হায় হায় করে।

গুজব শব্দটা আবার একটা রাজনৈতিক ভাষাও হয়ে যায় মাঝেমধ্যে। রাজনীতিবিদেরা সুযোগ নেওয়ার জন্য, বিপক্ষ দলকে দোষ দেওয়ার জন্য গুজব শব্দটি ব্যবহার করেন। কেউ কোনো কাজে ব্যর্থ হওয়ায় যদি বিপক্ষ দল সমালোচনা করে, তাহলে তারা গুজব ছড়াচ্ছে বলে টিপ্পনী কাটা যায়। গুজব এখন বিশাল একটা রাজনৈতিক স্ট্যান্ডবাজি হয়ে গেছে।

সময় আমাদের খুবই খারাপ আসতে যাচ্ছে। আমরা সবাই আশা রাখি যে পরিস্থিতি খারাপ হবে না। কিন্তু হয়ে গেলে আমাদের বিপদের শেষ নেই। যারা সব সময় গুজব নামের প্রপাগান্ডা ছড়ায়, তারা এখনো চেষ্টা চালিয়ে যাবে। কিছু গ্রুপ আছে, যারা ইস্যু খোঁজে। এসব ইস্যুতান্ত্রিক অসাধু থেকে সাবধান থাকতে হবে।

না বুঝে, ঠিকভাবে না শুনে কোনো কথায় কান দেওয়া যাবে না। গুজবের সবচেয়ে বড় অস্ত্র হচ্ছে ফেসবুক। তাই ফেসবুকের পোস্ট দেখে উত্তেজিত হওয়া যাবে না। বিভিন্ন অনলাইন পোর্টালও এসব কাজ করে থাকে। অনলাইন পোর্টাল মানেই কিন্তু নির্ভরযোগ্য নয়, সেটা বুঝতে হবে। টেলিভিশন কিংবা বিশ্বস্ত নিউজ পোর্টাল থেকে কোনো তথ্য না পেয়ে তা ছড়ানো যাবে না। সেগুলো নিয়ে উদগ্রীব হওয়া যাবে না। মনে রাখতে হবে, গুজব কিন্তু আমাদের বড় সর্বনাশ ডেকে আনতে সক্ষম।