করোনা, মানুষকে আসলে কোন রোগে ধরেছে

বাহ! করোনা নিয়ে কথা–কাটাকাটির জেরে একজন নিহত!

মধ্যরাতে থানকুনিপাতা খুঁজতে বের হয়ে গেলেন নারী–পুরুষনির্বিশেষে সবাই। ৩৫ সেকেন্ডের রেকর্ডিংয়ের কথা আর না–ই বা বললাম।

এসব নিউজও দেখতে হয় আমাদের।

মানুষকে সৃষ্টিকর্তা সৃষ্টির সেরা জীব করে পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন। মানুষের সবচেয়ে বড় প্রাপ্তি হচ্ছে মন বা মানসিক শক্তি। আমরা আমাদের মনে দ্বারা চিন্তাভাবনা করতে পারি। তাই চিন্তাচেতনা, বিবেক ও বুদ্ধির মাধ্যমে আমরা কাজ করতে পারি। অন্যান্য প্রাণীর সঙ্গে এটাই আমাদের সবচেয়ে বড় পার্থক্য। কিন্তু দিন দিন এই মানুষের আচরণ হয়ে যাচ্ছে রূঢ় আর খুবই জঘন্য। মানুষে মানুষে হানাহানি মারামারি লেগেই থাকে।

অন্য প্রাণীদের মধ্যে দেখা যায়, নিজ সম্প্রদায়ের মধ্যে এদের খুব মিল। একত্রে মিলেমিশে দলবদ্ধ হয়ে কাজ করে। কিন্তু মানুষেরই দেখা যায় নিজেদের মধ্যে ঝামেলা। একে অন্যের পেছনে লেগে থাকে, কেউ বিপদে পড়লে টেনে তুলতে হয়। কিন্তু মানুষ তা না করে কেউ গর্তে পড়লে আজীবন যেন সেখানে থাকতে পারে, তেমন ব্যবস্থা করে। বিপদে না পড়লেও কীভাবে বিপদে ফেলা যায়, তা নিয়ে ব্যস্ত থাকে মানুষ। নিজের কাজের জন্য যতটুকু সময় ব্যয় না করে তার চেয়ে বেশি সময় ব্যয় করে পরের ক্ষতি করার চিন্তায়।

কেউ বিপদে পড়লে আমরা সাধারণত চেষ্টা করি যাতে বিপদ থেকে উদ্ধার করা যায়। কিন্তু দুর্বলতার সুযোগ নেওয়াটা তো সমীচীন নয়। এ ধরনের আচরণ আবার আমাদের দেশে খুবই বেশি দেখা যায়।

বর্তমানে বাংলাদেশে ৩৯ জনের মতো করোনাভাইরাসের রোগী শনাক্ত হয়েছে, মারা গেছে তাদের মধ্যে ৪ জন। কোয়ারেন্টিনে আছে দুই হাজারের বেশি মানুষ। পুরো পৃথিবীতেই করোনা আতঙ্কের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশ্বের ১৭০টির বেশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে এই ভাইরাসের সংক্রমণ। ইতিমধ্যে মারা গেছে ১৬ হাজারের বেশি মানুষ। এই কারণে খুবই স্বাভাবিকভাবে আমাদের মধ্যেও ছড়িয়ে পড়েছে এই আতঙ্ক। কিন্তু এই আতঙ্ক কাজে লাগিয়ে আবার একশ্রেণির ব্যবসায়ীরা সুবিধা নিতে শুরু করেছে। যেটা এদের আজন্ম অভ্যাস। পৃথিবীর অন্যান্য জায়গায় যখন করোনা ছড়িয়ে যাচ্ছিল, তখন বলা হচ্ছিল যে মাস্ক পরা খুবই জরুরি একটি বিষয়। মাস্ক পরলে ভাইরাস নাক দিয়ে বা মুখ দিয়ে শরীরে প্রবেশ করতে পারবে না—এমন বলা হচ্ছিল। তখনই আমাদের দেশে মাস্কের সংকট। যাঁরা ব্যবসায়ী আছেন, তাঁরা তখনই মাস্ক পুরোদমে তৈরি করা শুরু করেছে কিন্তু বাজারে ছাড়েনি। কারণ, তাঁরা জানতেন যে একসময় এই মাস্কের ব্যাপক চাহিদা তৈরি হবে। যেই ভাবনা সেই কাজ। তেমনটাই হলো। দেশে করোনা এল আর মাস্কের দাম আকাশচুম্বী।

১০ টাকার জিনিস বিক্রি হচ্ছে ১০০ টাকায়, ৩০ টাকার জিনিস বিক্রি হচ্ছে ৩০০ টাকায়। মানুষেরও উপচে পড়া ভিড়। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিনা কারণে মাস্ক পড়ার দরকার নেই। তবে কে সামলায় হুজুগে নাগরিকদের। আসলে আমাদেরও বা দোষ কী? ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলে ভয় তো পাবেই। আমরা তো আমাদের দেশে পিঁয়াজের দাম ৩০০ টাকা হতে দেখেছি। গত বছর পিঁয়াজের বাজার নিয়ে অতিষ্ঠ হয়ে যায় পুরো দেশ। তাই যখন লবণের দাম বেড়েছে, এমন নিউজ বের হলো, তখন সবাই হুমড়ি খেয়ে পড়ল লবণ কিনতে।

আসলে সমস্যাটা কোথায়
গত বছর যখন পিঁয়াজের ফলন কম হলো, তখন যাঁরা পিঁয়াজ ব্যবসায়ী আছেন, তাঁরা সুবিধামতো পিঁয়াজের দাম বাড়িয়ে দিলেন। এটা আসলে আমাদের আজন্ম স্বভাব! এটা খুবই বাজে একটা অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে এখন। মাস্কের প্রয়োজন, তাই মাস্কের দাম বাড়ল। স্বাভাবিকভাবেই আর যা যা করোনার সঙ্গে সম্পৃক্ত, তার দাম বেড়ে যাবে এমনটাই হওয়ার কথা। এমনটাই তো আমরা জেনে থাকি। হ্যান্ড স্যানিটাইজার বা বিশুদ্ধকরণ অন্য যেসব কেমিক্যাল আছে, এগুলোর দাম বেড়ে যাবে বলে সবার দুশ্চিন্তা। তাই দেখা গেছে, কেউ কেউ একাই ১০-২০টি স্যানিটাইজার কিনে নিয়ে যাচ্ছে। অনেককেই নিজের চাহিদা অনুযায়ী দিতেও পারেনি দোকানদার। অনেক দোকানে তো মাস্ক আর স্যানিটাইজার নেই বলে পোস্টার লাগিয়ে দিচ্ছে।

কোনো এক চালের হোম ডেলিভারি সার্ভিসে এক নারী ফোন দিয়ে ৩০০ কেজি চাল চাচ্ছেন। তিনি খুবই টেনশনে আছেন, বারবার জিজ্ঞেস করছে যে তিনি এটা পাবেন কি না! এই হলো আমাদের অবস্থা! এই দেশে আমরা বসবাস করি। সুযোগসন্ধানীরাও সুযোগ নেয় আর আমরাও তাতে গা ভাসাই, প্রতিবাদ করি না।

সামনে ডেঙ্গু জ্বরে আক্রান্ত হওয়ার সময় এসেছে। মশার ওষুধ থেকে শুরু, যা যা লাগবে সবকিছুর দামই বেড়ে যাবে? যেতেই পারে। গত বছরের অভিজ্ঞতা কিন্তু তাই বলে। ৮০ টাকা দামের ওষুধ বিক্রি হয়েছে ৫০০ টাকায়, এমনও দেখা গেছে। ডেঙ্গু আছে কি না, পরীক্ষা না করেই নিয়ে নিচ্ছে দ্বিগুণ, তিন গুণ টাকা। আইসিইউতে মৃত রোগী দু–তিন দিন রেখে টাকা নেওয়ার দৃষ্টান্তও আছে আমাদের দেশে।

সামনে পবিত্র রমজান আসছে। তখন শুরু হয়ে যাবে আরও নোংরা খেলা। সারা পৃথিবীতে দেখা যায়, উৎসবের সময় সব পণ্যে ছাড় দেয়। ভারতে পূজার সময় ছাড়ের ছড়াছড়ি লেগে যায়। এমনকি ইসরায়েলের মতো দেশও রমজান মাসে পণ্যের দাম কমায়। কিন্তু দুঃখী আমরা, অভাগা আমরা যে আমাদের দেশে উৎসব উপলক্ষ করে বাজে বা নষ্ট জিনিসগুলো রেখে দেয় বেশি দামে বিক্রি করার জন্য। রমজান এলেই দেখা যাবে প্রয়োজনীয় জিনিসগুলোর গায়ে হাত দেওয়া যাবে না। বাস কিংবা অন্যান্য যানবাহনের ভাড়া যায় বেড়ে। তাহলে কি মানুষ যদি বেশি হারে মারা যায়, তখন কাফনের কাপড়ের দাম বাড়বে?

পৃথিবীর কিছু দেশে দেখলাম যে মাস্কের দাম আরও কমের দিকে। আমাদের কেন এমন অবস্থা? মানুষের রোগ-শোক কিংবা মৃত্যু নিয়ে এরা মজা করে, এদের কি মৃত্যুভয় বিন্দুমাত্রও নেই?

এখন কথা হচ্ছে, কেউ অপরাধ করে আর কেউ চুপ করে থাকে, কেউ সহ্য করে—সবাই সমান। চুপ করে থাকাও আমাদের রোগে পরিণত হয়ে গেছে। আমাদের মানসিকতা এমন হয়ে গেছে। কেউ হয়ে গেছে ধ্বংসাত্মক মনোভাবের আর কেউ হয়ে গেছে দাসত্ব মনোভাবের। নিজেদের স্বকীয়তা হারিয়ে বসে থাকলে হবে না। আমরা প্রতিবাদ করা কেন ভুলে গেছি? এসবের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলতে হবে। প্রতিবাদ করতে হবে। আমরা সব সময়ই শুধু প্রশাসনের দিকে তাকিয়ে বসে থাকি, যা চরমভাবে অশোভনীয়।

মাস্কের দাম বাড়িয়ে দিয়েছে তো কী হয়েছে? মাস্ক যদি প্রয়োজন হয় আমরা ঘরেই বানিয়ে নিই। স্যানিটাইজার নিজেরা বানিয়ে নিই। চাইলেই এসব সম্ভব। প্রয়োজনে গরম পানি দিয়ে নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে পারি। কিছু একটা হলেই স্রোতে গা ভাসানোর কী দরকার!

করোনা নিয়ে সবচেয়ে বেশি যে বিষয়টি জরুরি, তা হচ্ছে সচেতনতা। পরিষ্কার–পরিচ্ছন্নতা ইমানের অঙ্গ বলে আমরা জানি। তাই পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকা আমাদের সাধারণ কর্মকাণ্ডের সঙ্গেই থাকা উচিত, এর জন্য তো আর নিয়ম করার প্রয়োজন নেই। নিয়ম করলে তো যেকোনো বিষয় কঠিন হয়ে যায়। কোনো কিছুকেই জটিল মনে না করে সহজভাবে এগিয়ে যাওয়া উচিত। শোনা কথায় যেন আমরা কান না দিই, সেটাও চিন্তা করতে হবে। কোথাও কিছু শুনলে প্রথমেই তার সত্যতা যাচাই করে দেখতে হবে। অনেকেই অনেক ধরনের ফোবিয়া বা গুজব ছড়ানোর চেষ্টা করবে, তাই কারও কথায় কান দেওয়া যাবে না, চিলের পেছনে না ঘুরে কানে হাত দিয়ে দেখতে হবে।

একটি কথা মনে রাখতে হবে যে আমরা একা কেউ চাইলেই ভালো থাকতে পারব না। সবাইকে নিয়ে ভালো থাকতে হবে, আর সবাইকেই সাবধান রাখতে হবে।

*লেখক: লেখক, কলামিস্ট