ছুটি পেয়ে গ্রামে ফেরা, করোনা নিয়ে যাচ্ছেন না তো?

রাজধানীর টেকনিক্যাল মোড় থেকে গাবতলীমুখী সড়কে যানবাহন বন্ধ করে দেওয়ায় গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটছেন মানুষ। ছবি: সামছুর রহমান
রাজধানীর টেকনিক্যাল মোড় থেকে গাবতলীমুখী সড়কে যানবাহন বন্ধ করে দেওয়ায় গাবতলী বাসস্ট্যান্ডের দিকে হাঁটছেন মানুষ। ছবি: সামছুর রহমান

বিশ্বব্যাপী মহামারি আকার ধারণ করা কোভিড-১৯, যা করোনা নামে পরিচিত। এ তথ্য শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বের কারও কাছেই অজানা নয়। করোনাভাইরাসের বিশ্ব পরিভ্রমণযাত্রায় সর্বশেষ যোগ হয়েছে উগান্ডা। এ ভাইরাসটি এতই শক্তিশালী যে চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের মতে এটি এ পর্যন্ত ৩৮০ বারের মতো এর গঠন পরিবর্তন করেছে। এ কারণে নির্দিষ্ট কোনো ওষুধ এর প্রতিষেধক হিসেবে কাজ করছে না।

করোনাভাইরাস সর্বপ্রথম মহামারি রূপ ধারণ করে চীনের উহানে। উন্নত যোগাযোগব্যবস্থার কারণে ইতিমধ্যে এ ভাইরাসের ক্ষতির সক্ষমতা, মৃত্যুর হার, ছড়ানোর মাধ্যম সম্পর্কে কমবেশি সবাই অবগত আছি।

প্রশ্ন হচ্ছে চীন যেভাবে করোনাভাইরাস মোকাবিলা করে জয়ী হতে যাচ্ছে পৃথিবীর অন্যান্য দেশ, বিশেষ করে উন্নয়নশীল ও অনুন্নত দেশগুলো কি সেভাবে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারবে! যদি পারে তাহলে তো ভালো কিন্তু না পারলে কী হবে?

বাংলাদেশ একটি উন্নয়নশীল দেশ। এ দেশের আয়ের একটা বড় অংশ আসে প্রবাসীদের রেমিট্যান্স থেকে। করোনাভাইরাস যখন চীনে প্রথম ধরা পড়ল, তখন আমরা চিন্তিত হয়ে পড়লাম চীনে অবস্থানরত আমাদের বাংলাদেশিদের নিয়ে। বাংলাদেশ সরকার চীনা প্রবাসীদের দেশে ফিরিয়ে আনার প্রশ্নে ত্বরিত পদক্ষেপ নিল। তবে বিলম্বের কারণে সরকারকে তুলাধোনা করা হলো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে। সংক্রমণ প্রতিরোধে প্রাথমিক পদক্ষেপ হিসেবে প্রাতিষ্ঠানিক কোয়ারেন্টিনের ব্যবস্থা করল। মানুষ স্বস্তির নিশ্বাস ফেলল। পরবর্তী সময়ে যখন মধ্যপ্রাচ্য, স্পেন, যুক্তরাষ্ট্র, ইতালিসহ অন্যান্য দেশে এ ভাইরাস ভীষণভাবে ছড়িয়ে পড়ল। সেই দেশগুলোতে অবস্থানরত বাংলাদেশিরা বিদ্যুৎ বেগে দেশে ফিরতে শুরু করলেন। সারা দেশের মানুষের উদ্বেগ–উৎকণ্ঠা এবার বহুগুণ বেড়ে গেল। সবার মনে একটি শঙ্কা উঁকি দিতে শুরু করল, বিশ্বের আক্রান্ত দেশগুলো থেকে যে হারে লোকজন ফিরে আসছে, না জানি মাতৃভূমি বাংলাদেশের কী হয়! জনসাধারণের আশঙ্কাই সত্যি হলো ৮ মার্চ ইতালিফেরত প্রবাসীর দেহে করোনাভাইরাস শনাক্ত হলো। আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল সর্বত্র।

দেশবাসী মনে করেন, প্রবাসীদের দেশে আসতে না দিলে করোনাভাইরাস আমাদের দেশে আসত না। বিষয়টি অনেকটা তেমনই। কিন্তু তাই বলে সরকার তো আর নিজ দেশের নাগরিকদের দেশে আসতে না করে দিতে পারে না। বাংলাদেশ সরকার করোনাভাইরাস নির্মূলে ত্বরিত ব্যবস্থা নিল। মুজিব শতবর্ষের অনুষ্ঠান বাতিল করল, বন্ধ করে দিল দেশের সব স্কুল–কলেজ, নিষিদ্ধ করা হলো সব জমায়েত।

করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বিআইডব্লিউটিএ নৌপথে যাত্রী পরিবহন বন্ধ ঘোষণা করলেও মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ও মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া নৌপথে দক্ষিণবঙ্গমুখী যাত্রীদের ঢল নামে। আজ বেলা ১২টার দিকে কাঁঠালবাড়ি ঘাটে। ছবি: প্রথম আলো
করোনাভাইরাস প্রতিরোধে বিআইডব্লিউটিএ নৌপথে যাত্রী পরিবহন বন্ধ ঘোষণা করলেও মাদারীপুরের কাঁঠালবাড়ি ও মুন্সিগঞ্জের শিমুলিয়া নৌপথে দক্ষিণবঙ্গমুখী যাত্রীদের ঢল নামে। আজ বেলা ১২টার দিকে কাঁঠালবাড়ি ঘাটে। ছবি: প্রথম আলো

কিন্তু দিন যত গড়াচ্ছিল, অবনতি হতে থাকল অবস্থার। এ অবস্থায় সরকারও কঠিন থেকে কঠিনতর পদক্ষেপ নিতে শুরু করল। গৃহীত পদক্ষেপগুলোর মধ্যে সর্বশেষ পদক্ষেপ ছিল সরকারি বেসরকারি সব অফিস ১০ দিনের জন্য বন্ধ ঘোষণা। আমরা জাতি হিসেবে খুবই আবেগপ্রবণ। লোকজন ভাবল, অনেক দিন ধরে পরিবার–পরিজনকে সময় দেওয়া হয় না, ছুটি যখন পেয়েছি, তাহলে বাড়িতে চলে যাওয়াই ভালো। তারা একটিবারের জন্যও চিন্তা করল না সরকার কেন তাদের ছুটি দিল, কেনই বা দল বেঁধে তাদের বাড়িতে যেতে হবে! বাঙালিরা এমন কেন! রেমিট্যান্স–যোদ্ধারা যখন দেশে আসছিলেন, পরিবেশ ও পরিস্থিতি অনুযায়ী সরকার অনুরোধ করেছিল তাঁদের বাড়িতে অবস্থান করার জন্য। কিন্তু এত দিন বাদে দেশে এসে কি আর বাড়িতে থাকা যায়! তাঁরা সরকারি নির্দেশনা অমান্য করে অন্যান্য সাধারণ মানুষের সঙ্গে মিশে গেলেন। বাড়িতে থাকল করোনা আক্রান্তের সংখ্যা। মৃত্যুও হয়েছে কয়েকজনের। এ অবস্থায় আমাদের সব সময় সতর্ক থাকতে হবে। অথচ এই সচেতনতার ব্যাপারে আমরা সবচেয়ে পিছিয়ে।

দেশের মধ্যে রাজধানী ঢাকা এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি আক্রান্ত। সাধারণ ছুটি ঘোষণার পর থেকেই ঢাকা থেকে দলে দলে মানুষের গ্রামে ফেরার হিড়িক পড়ে গেল। তাদের ভাবখানা এমন গ্রামে ফিরলেই বেঁচে যাই।

প্রশ্ন হচ্ছে, এখন কী হবে? সাধারণ ছুটির সঙ্গে সঙ্গে করোনাভাইরাস ঢাকা থেকে সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ল না তো! যদি তা–ই হয়, তাহলে এখন উপায়? এটি ভুলে গেলে চলবে না প্রবাস থেকে যাঁরাই দেশে ফিরেছিলেন, তাঁরা কিন্তু প্রায় সবাই সুস্থ ছিলেন। আর আপনারা যাঁরা পরিবারের সঙ্গে দেখা করতে যাচ্ছেন, তাঁরা প্রায় সবাই সুস্থ আছেন। যে পরিবারের জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম করছেন, সেই তাঁদের জন্য করোনাভাইরাস উপহার হিসেবে নিয়ে যাচ্ছেন না তো!

উপায় এখন একটাই, ঘর থেকে বের না হয়ে প্রত্যেকেই নিজ নিজ জায়গায় অবস্থান করুন। সচেতন হোন, পরিষ্কার থাকুন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা প্রদত্ত স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলুন। সম্মিলিত সহযোগিতা, প্রচেষ্টা ছাড়া সরকারের একার পক্ষে মহামারি আকার ধারণ করা এই করোনাভাইরাস মোকাবিলা করা প্রায় অসম্ভব।