সচেতনতার মশাল জ্বলবে কবে

ভালোভাবে সাবান পানি দিয়ে হাত ধুতে হবে
ভালোভাবে সাবান পানি দিয়ে হাত ধুতে হবে

বর্তমানে, বিশ্বে করোনাভাইরাস মৃত্যুর খেলায় মেতে উঠেছে। অট্টহাসি দিয়ে দুর্বার ছুটে চলছে পৃথিবীর এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্ত। চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিচ্ছে পৃথিবীর তাবৎ তাবৎ দেশ ও প্রতাপশালী, পরাক্রমশালী নেতা–নেত্রীদের। বাধ্য হচ্ছে তাকে ভয় করতে, কুণ্ঠা করতে। সমীহ করা নিয়ে পৃথিবীবাসীর ওপর কোভিড-১৯–এর হুমকি যেন ঠিক এ রকম, ‘হয় করো নয়তো মরো’। 

সমগ্র বিশ্বের যখন এ অবস্থা, তখন বাংলাদেশের অবস্থা দেখে মনে হবে, সমগ্র বিশ্ববাসীই যেন বোকা, কেবল বাংলাদেশের বাঙালি সমাজের বিশেষ কোনো শ্রেণির মানুষ যেন আপগ্রেড, অকুতোভয়, চালাক। এখন পর্যন্ত বাঙালি সমাজের সেই শ্রেণির মাঝে ভয়ডর তেমনভাবে প্রবেশ করেনি। যারা করোনাভাইরাসের বিধ্বংসী রূপ প্রত্যক্ষ করেছে ইন্টারনেটে প্রকাশিত বিভিন্ন খবরে, কেবল তারাই হয়তো অনেকটা আতঙ্কে দিনাতিপাত করছে।

গাজা উপত্যকা
বিভিন্ন খবরে প্রকাশিত তথ্যমতে, প্রয়োজনীয় প্রতিকার ব্যবস্থার অপ্রতুলতা থাকা সত্ত্বেও যুদ্ধবিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকার ২০ লাখ মানুষ এখনো করোনার প্রকোপ থেকে মোটামুটি নিরাপদ (এএফপির খবর একজন শনাক্ত)। কেমন করে সম্ভব হলো, সে উত্তর এতক্ষণে আমরা সবাই ওয়াকিবহাল। সেটা কেবলই প্রতিরোধ ব্যবস্থা। কী সেই প্রতিরোধ ব্যবস্থা? কেবল সচেতনতা। কী সচেতনতা? যেসব সচেতনতার উপদেশ আমরা গত এক-দেড় মাস থেকে পাচ্ছি, অর্থাৎ একজন আরেকজনের সংস্পর্শে না আসা, মিনিমাম দূরত্ব বজায় রাখা, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকা ইত্যাদি। কেবল এতটুকু সচেতনতাকে অবলম্বন করেই অর্থনৈতিক ভঙ্গুর একটা অঞ্চল গাজা, কেবল একটি মাত্র হাসপাতাল থাকা অঞ্চল গাজা, পৃথিবী থেকে প্রায় বিচ্ছিন্ন একটি অঞ্চল গাজা, জীবনের গতি থমকে যাওয়া একটা অঞ্চল গাজা আজ এই মহামারি করোনাকে এখন পর্যন্ত রুখে দেওয়া অঞ্চলের এক অনন্য উদাহরণ।

কোরিয়া মডেল
এবার যদি আমরা দক্ষিণ কোরিয়ার দিকে তাকাই, তাহলে দেখতে পাচ্ছি, এ দেশটিও করোনাকে রুখে দেওয়ার জন্য উজ্জ্বল নাম। হ্যাঁ, এ দেশটির রয়েছে অনেক সামর্থ্য—কি অর্থনৈতিক, কি বৈজ্ঞানিক, কি সামরিক। কিন্তু এ দেশটি বুঝতে পেরেছে, কোনো বড়াই বা কোনো দাম্ভিকতা দিয়ে কোনো কাজ নেই এখানে। বরং এগুলো হিতে বিপরীত অবস্থা হওয়ার মতো হবে। আবার বিজ্ঞানের ওপর আস্থা থাকলেও সে আস্থা অর্জনে অনেক সময় লাগবে। তত দিনে অনেক ক্ষতি হয়ে যাবে। যেটা হয়তো অপূরণীয় ক্ষতি বলেই বিবেচিত হবে। তাই তারা বেছে নিলেন—প্রতিকার নয়, প্রতিরোধ। নেওয়া হলো সর্বোচ্চ পর্যায়ের সতর্কতা। কি সরকারি পর্যায় থেকে সরকারি অ্যাপের কার্যকর প্রয়োগ, কি বার্তা সবাইকে সতর্ক করানো, কি প্রসিডেন্ট মুন জে ইনের যুগান্তকারী পদক্ষেপ ৩ মিটার দূরত্ব বজায় রাখা, যেটা এখন সমগ্র বিশ্বের গৃহীত শক্তিশালী পদক্ষেপ বলে বিবেচিত। এর চেয়ে বড় ব্যাপার হলো সে দেশের জনগণের আপন বোধোদয় ও সরকার কর্তৃক গৃহীত সিদ্ধান্তে সম্মান প্রদর্শন এবং নিজেদের মধ্যে সেগুলো বাস্তবিক প্রয়োগ। যে কারণে দক্ষিণ কোরিয়ায় করোনার বীভৎস থাবার কারণে এত শত মৃত্যুর খবর পাওয়া যায় না, হয়তো আর সেখানে পাওয়া যায়নি বলে আমরা শুনতে চাই।

ইউরোপের কী অবস্থা
এবার আসা যাক কানাডার প্রধানমন্ত্রীর কথায়, যাঁকে আমরা পৃথিবী সেরা প্রধানমন্ত্রীর তকমা দিয়ে দিয়েছি। প্রিয়তমা স্ত্রী করোনায় শনাক্ত হওয়ায় তাঁদেরও বাধ্য করেছে হোম কোয়ারেন্টিনে নিতে। অন্যদিকে, আকাশপথে নিজেদের অপরাজেয় করে তোলায় যে দেশ থেকে বিশ্ববাসী রাফাল যুদ্ধ বিমান কিনছে, সেই ফ্রান্সও অদৃশ্য করোনার কাছে নতজানু হয়েছে। অর্থাৎ বিশ্বকে নিরাপত্তা দেওয়া সর্বদিক থেকে সক্ষম দেশটি আজ নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। করোনার করাল গ্রাসে সেখানেও চলছে মৃত্যুর মিছিল।

ইতালির মতো শিল্পোন্নত, বিজ্ঞাননোন্নত, সচেতন দেশে করোনার জয়জয়কার, ইতালিবাসীর হাহাকার চলছেই। সর্বশেষ ২৫ মার্চ সাড়ে ৭ হাজার পেরিয়েছে। সংখ্যাটা যে কত বড় আতঙ্কের তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

বিশ্ব মোড়ল যুক্তরাষ্ট্রের অবস্থাও নড়বড়ে করোনাভাইরাসকে নিয়ে। সেখানেও নেওয়া হয়েছে বাড়তি সতর্কতা।

এশিয়া কী করছে
ভারতের মতো বিশ্বমঞ্চে স্থান করা দেশও করোনার কারণে লকডাউন ঘোষণা করেছে। এশিয়ায় যে কয়েকটি দেশ চিকিৎসাবিজ্ঞানে অগ্রসর ও বিশ্বস্ত, ভারত সেগুলোর মধ্যে অন্যতম কোনো সন্দেহ নেই। সেই ভারতেও ইতিমধ্যে ১২ জন মারা গেছেন। তারাও প্রতিকার নয়, প্রতিরোধ হিসেবে সচেতনতাকে বেছে নিয়েছে।

সৌদি আরবে বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে পবিত্র ওমরা হজ। নেওয়া হয়েছে সর্বোচ্চ সচেতনতা। আক্রান্ত হওয়ার পর ইরানও নিয়েছে সর্বোচ্চ সচেতনতা। মোটকথা, যেহেতু এ ভাইরাস করোনার নতুনতম রূপ এবং অদ্যাবধি এ ভাইরাসের নির্ভরযোগ্য প্রতিষেধক আবিষ্কৃত হয়নি, সেহেতু এ ভাইরাস থেকে বাঁচার ক্ষেত্রে একমাত্র পথ হিসেবে বিশ্ব সচেতনতা কেই একমাত্র অবলম্বন হিসেবে গ্রহণ করেছে।

এত সব জানা তথ্য পুনরায় আলোকপাত করার কারণ হলো, বহির্বিশ্বে ত্রাহি ত্রাহি অবস্থা, আহাজারি, মৃত্যুশোক, সেই ভয়ডর আমাদের অর্থাৎ বাঙালির অস্তিত্বে কি মিশেছে? ডর অর্থ হচ্ছে সচেতনতাকে গ্রহণ করা। আমরা বাংলাদেশের মানুষেরা সবাই কি পূর্ণ সচেতন হতে পেরেছি? পূর্ণ সচেতন নাহয় নাই হতে পারি বিভিন্ন কারণে, সচেতন হওয়ার মানুষিকতা কি অর্জন করতে পেরেছি?

উপরিউক্ত আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে যে বিষয়গুলো সামনে আসছে, সেগুলো নিয়ে ভাবার দরকার আছে। মানুষের চোখে না দেখা এই যে অদৃশ্য অথচ ভয়ংকর ভাইরাস ছাড় দিচ্ছে না কাউকেই। একটা জিনিসই এ ক্ষেত্রে কার্যকর সেটি হচ্ছে, সচেতনতা বা সতর্কতা। এর ব্যত্যয় হলেই হয়তো করোনার ক্রোধের মুখে পড়তে হতে পারে এবং অপ্রত্যাশিত ঘটনার মুখোমুখি হওয়া লাগতে পারে।

বাংলাদেশের মানুষ কবে সচেতন হবে
কিন্তু দুঃখের বিষয়টি ঘুরেফিরে আসে কেবল বাংলাদেশের মানুষের কাছে। যাঁরা শহরাঞ্চলে থাকেন ও আধুনিক বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলার চেষ্টা করেন, তাঁরা হয়তো খুব কিংবা মোটামুটি সতর্কতা অবলম্বন করছেন। এমনকি নেট দুনিয়ায় অন্য সব মানুষকে সচেতন হওয়ার জন্য বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ, গণমাধ্যম ব্যবহার করছে সতর্কতামূলক কথাবার্তা বলে। কিন্তু যাঁরা এর বাইরে, তাঁরা করোনার মহামারিকে হয়তো মেনে নিচ্ছেন, কিন্তু সে মহামারির কবলে যে নিজেরাও পড়তে পারেন, সে বিষয়টি এখনো তাঁদের ভাবাতে পারেনি। তাঁরা নিচ্ছেন না তেমন কোনো সতর্কতামূলক পদক্ষেপ। সচেতনতা তাঁদের মধ্যে এখনো কোনো ধরনের রেখাপাত করেনি। শুধু তা–ই নয়, সচেতনতা ও সতর্কতামূলক পদক্ষেপগুলো তাদের মধ্যে কেবল হাসি ও তাচ্ছিল্যের ব্যাপার। তাঁরা এও বিশ্বাস করেন, ‘করোনাকে ভয় করে যে করোনা আক্রমণ করবে তাকেই।’ তাদের এ ভাবনাগুলো কষ্টের ও আতঙ্কের!

কিন্তু এও তো ঠিক যে যদি তাঁদের এ বিশ্বাস ও অন্ধত্বে করোনা আঘাত করে, তবে সেটি কেবল তাঁদেরই নয়, বরং গোটা বাঙালি সমাজের জন্য বিপজ্জনক। তাঁদের কোনোভাবেই বোঝানো যায় না যে তাঁরা সাধারণ খেটে খাওয়া মানুষ। তাঁদের বের হতেই হবে কাজের খোঁজে, বাঁচতে হলে, খেতে হলে। উন্নত দেশের মতো সরকারের পক্ষে এটা সম্ভব নয় যে মাসব্যাপী তাঁদের ঘরে বসিয়ে খাওয়াবে, পরাবে। তাই সচেতনতা অবলম্বন করা সর্বাগ্রে তাঁদেরই উচিত। কিন্তু তাঁদের এ সচেতনতার মশাল কবে জ্বলবে?

এমন সংকটকালীন মুহূর্তে কেবল সরকারের একার পক্ষে এ সমস্যাকে মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। বরং সরকারের সঙ্গে একাত্ম ঘোষণা করতে হবে দেশের আর সব জনগণকে। কিন্তু এ সাধারণ মানুষদের বাদ দিয়ে দেশের ‘সকল জনগণ’ বলা সম্ভব নয়। এ সাধারণ মানুষদের এ রকম অসচেতনতাকে নিয়ে জাতি আজ এ ক্রান্তিলগ্নে ‘সম্পূর্ণভাবে সচেতন’ বলে দাবি করতে পারে না। আর এও আমরা জানি যে করোনার করাল গ্রাসে পড়ার জন্য সবাইকে একসঙ্গে পড়ার দরকার পড়বে না, অল্পসংখ্যক মানুষ আক্রান্ত হলেই এবং তাদের অসচেতনতা এভাবে চলতে থাকলেই হয়তো জাতি অবর্ণনীয় সংকটে অতি দ্রুত পড়ে যেতে পারে। আমাদের ভুলে গেলে চলবে না, ইতিমধ্যে আমাদের ৩৯ জন শনাক্ত হয়েছেন এবং ৫ জন মারা গেছেন। তবে করোনায় সুস্থও হয়েছেন ৭ জন।

কাজেই, সময় হয়তো খুবই কম। কেবল মিডিয়ায় প্রেস ব্রিফিং ও দূর সতর্কতার অধিকতর প্রয়োজনীয়তা হয়তো কমে যাচ্ছে। হয়তো এর পরিবর্তে তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের কাছে গিয়ে সতর্ক ও সচেতন করার প্রয়োজনীয়তা অধিকতর গুরুত্বপূর্ণ হয়ে যাচ্ছে। প্রয়োজনে কঠোর বিধিনিষেধ আরোপ করার বিষয়টিও ক্রমে জরুরি হয়ে পড়ছে।

*লেখক: শিক্ষার্থী