ইহা ছুটি, না চার দেয়ালে আটকে থাকা

শিক্ষার্থীদের সঙ্গে বিদ্যায়তনের যোগাযোগ বিছিন্ন। ২২ দিনের ছুটিতে সব বিদ্যায়তন। ভ্রমণ, খেলাধুলায় নিষেধাজ্ঞা। বাড়ি থেকে বেরোনো বারণ। তা এই ছুটিতে আমি কী করব? গোটা দিন এক মুঠোফোন আর ল্যাপটপ নিয়েই। গান, নাটক, মুভিতে আর রুচি নেই। সবকিছুতেই মানা, আমি যেন চার দেয়ালে বন্দী।

গত সোমবার (১৬ মার্চ) গণবিশ্ববিদ্যালয়ের ছুটির বিজ্ঞপ্তির অপেক্ষায় ছিলাম। মা-বাবার কাছে যাব, বাড়িতে গিয়ে সব খেয়ে ফেলব। প্রচুর ঘুমাব। দিনভর বিশ্রাম করব। আগামী কয়েক দিন ক্লাস-পরীক্ষার ঝামেলা থাকবে না। বাড়িতে গিয়ে এটা কিনব, ওটা নিয়ে আসব। কত্ত কিছুই ভেবেছিলাম।

তবে আজ খুব ছন্নছাড়া মনে হচ্ছে। নিজ ঘরে বন্দী লাগছে নিজেকেই। এই পরিস্থিতি থেকে কবে ছুটি পাব? সেই অপেক্ষায় দিন গুনছি এখন...

জনমানবহীন খেলার মাঠ। কেউ মাঠে আসতে পারছে না। কেউ আসে না করোনা আক্রান্তের ভয়ে, কেউবা পুলিশ–সেনাবাহিনীর ভয়ে। বন্ধুবান্ধব ঘরের বাইরে বেরোয় না। ঘোরাঘুরি করারও উপায় নেই। ক্যাম্পাসের দীর্ঘ বন্ধে, নিয়মিত পড়াশোনাও করতে খুব একটা ইচ্ছে করে না।

সম্প্রতি ঘুম থেকে জাগি বেলা গড়িয়ে দুপুর হওয়ার পর। উঠে খেয়ে বাইরে যাই একবার। আবার বাড়িতে চলে আসি। মুঠোফোনে গান, নাটক, মুভি দেখি। কিছু সময় পর আর ভালো লাগে না। আবার গোসল করে খেয়ে বাইরে যাই।

বাইরেও করার মতো কিছু নেই। অহেতুক বাইরে থাকাও নিষেধ। বন্ধুরাও একাকী সময় কাটায় বাড়িতে। সন্ধ্যা থেকে মুঠোফোনে ফেসবুক, ইউটিউব করতে করতে মধ্যরাত হয়ে যায়। খেয়ে আবার সেই ফোন নিয়েই বিছানায় গড়াগড়ি খাই।

কোভিডের শঙ্কায় সুস্থ ও নিরাপদ থাকার জন্য আমরা ঘরকুনো হয়েছি। এতে আমরা নিরাপদ থাকছি ঠিকই, তবে অনেকটা সময় হারিয়ে ফেলছি। করোনায় বাঁচতে চার দেয়ালে আটক থেকে মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে যাচ্ছে মধ্য বয়সীদের।

গবেষণায় জানা যায়, যদি মানুষ টানা ২১ দিন ধরে যেকোনো কাজ করে। তাতে সে অভ্যস্ত হয়ে যায়। মানুষ ঘরে বসে থাকতে থাকতে অভ্যস্ত হয়ে পড়ছে। অলসতা ভর করছে মানুষের দেহ ও মনে। চার দেয়ালের মধ্যে একাকী অলস সময় কাটানোও একসময় ভালো লাগবে মানুষের। তখন করোনার ছুটি হয়ে যাবে। তবে ছুটি পাব না আমরা এই অলসতা থেকে।

এই তো! কিছুদিন আগের কথা। সকাল সকাল ঘুম থেকে ওঠার জন্য পরপর তিনটি অ্যালার্ম দিতে হতো। একটু দেরি হলেই হয় অ্যাটেন্ডেন্স মিস। নইলে বকুনি খাও টিচারের। সকালে খাবার খাওয়ার ফুসরত নেই। সকালের খাবার খেতে খেতে দুপুর দুইটা।

ক্লাস শেষে ঘরে ফিরতে বিকাল হয়ে যেত। ঘরে ফিরে বিশ্রাম করার সুযোগ তো নেই। টিউশনি করাতে হবে দুইটা। রাত আটটা–নয়টায় ক্লান্ত দেহ নিয়ে ঘরে ফেরা হতো। বিশ্রাম নিয়ে আবার পড়তে বসা, অ্যাসাইনমেন্ট করো, এই শিট পড়া, কাল পরীক্ষা, পরশু মিডটার্ম। পড়তে পড়তে রাত দুইটা বেজে যেত। এর মধ্যেই রাতে খাওয়া শেষ।

তখন একটু শুয়ে পড়তাম। ফেসবুক, ইউটিউব না দেখলে ঘুম ঠিকমতো হতো না। এসব করতে করতে কখন যে তিনটা–চারটা বেজে যেত, বুঝতেই পারতাম না। কিন্তু তখনো চোখে একটুও ঘুম আসত না। এই তো দুপুরে, সন্ধ্যায় ঘুমে নড়তে পারছিলাম না। সকালে ঘুম থেকে উঠতেও প্যারা হতো। তবে তখন ঘুম আসত না....।

এভাবেই দিনের পর দিন কেটে যেত। এই মাসের প্রথমে বেশ শরীর খারাপ করেছিল। জ্বরে বিছানা থেকেই উঠতে পারছিলাম না। ক্লাসেও যেতে পারিনি। টানা তিন দিন পর বিছানা থেকে উঠেছিলাম। তারপর আর ক্লাস করতে ইচ্ছা করছিল না। ভাবতাম যদি কয়েক দিনের ছুটি পেতাম বাড়িতে ঘুরে আসতাম। কিন্তু ছুটি নেই, সামনের সপ্তাহ থেকে টানা মিডটার্ম পরীক্ষা। বাসায় যাওয়ার উপায় ছিল না।

এর দুই দিন না যেতেই বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগীর মৃত্যু ঘটল। আমাদের দেশে তখন আক্রান্তের সংখ্যা প্রায় চার–পাঁচজন। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ ঘোষণা করা হলো। তখন খুশিতে ব্যাকুল হয়ে গেলাম। তবে আমার স্টুডেন্ট দুজন এইচএসসি পরীক্ষার্থী। ছুটি তো প্রায় সপ্তাহ দুয়েকের মতো। বাড়িতে তিন–চার দিন পরেই যাই। তাদের বইটা গুছিয়ে দিই।

সেই শেষ পড়িয়ে বাড়িতে এলাম। প্রথম দুই দিন প্রচুর খেলাম, ঘুমালাম। অনেক আনন্দ লাগছিল। অনেক দিন পর একটু ব্যস্ততা থেকে মুক্তি পেয়েছি। তবে এখন এই অলস বন্দী চার দেয়াল থেকে মুক্তি পেতে চাই। অতিদ্রুত ব্যস্ততার ক্যাম্পাসেই ফিরে যেতে চাই আবার। আগামীকাল যেন ঘুম ভেঙে শুনি, করোনা থেকে গোটা বিশ্বের মানুষ মুক্তি পেয়েছে। আতঙ্কিত পৃথিবীর স্বাভাবিক হয়ে গেছে।

মক্কা–মদিনার মসজিদে আজানের পর নামাজ আদায় হচ্ছে। সবাই স্কুলে যাচ্ছে, মাঠে খেলছে। ঘোরাঘুরিতে ব্যস্ত যুবক–যুবতীরা। করোনা বিদায়ে চারদিকে উৎসব ছড়িয়ে পড়েছে। এখন এ স্বপ্ন দেখেই ঘুমিয়ে পড়ি প্রতি ভোররাতে।