করোনায় আতঙ্ক নয় সতর্কতা, কীভাবে

পাঁচ থেকে ছয় ফুট গড় উচ্চতার মানুষকে সমগ্র বিশ্বব্যাপী স্মরণকালের অন্যতম বিপর্যয়ের মুখোমুখি করেছে মাত্র ১২০ ন্যানো মিটারের (তিন ফুট বা এক মিটারের প্রায় এক কোটি ভাগের এক ভাগ অর্থাৎ মানুষের দুই কোটি ভাগের এক ভাগ) এক ভাইরাসকণা, যার নাম করোনা। ব্যাপক উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার মধ্যে সারা বিশ্বের মানুষ। প্রতিরোধে সবাই বলছেন আতঙ্কিত না হয়ে সতর্ক হতে, একটু জেনে নিই কীভাবে?

তথ্যপ্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার
তথ্যপ্রযুক্তির এই যুগে বারবার জেনে নিই এবং অন্যকে জানিয়ে দিই সঠিক তথ্য। এই মহামারি মোকাবিলায় আতঙ্ক সৃষ্টি হয়, এমন তথ্য চারদিকে না ছড়িয়ে বেশি করে ইতিবাচক তথ্য আদান-প্রদান করি। প্রয়োজনে দায়িত্বপ্রাপ্ত লোকজনকে বিষয়টি অবহিত করি। অর্থাৎ এখন প্রয়োজন প্রতিটি নাগরিকের দায়িত্বপূর্ণ আচরণ করা আর ইতিবাচক তথ্যগুলো জনসাধারণের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়া আর নেতিবাচক তথ্য পরিহার করা।

‘হ্যান্ড স্যানিটাইজার’ কি জরুরি
না। যদি হ্যান্ড স্যানিটাইজার সহজলভ্য হয়, তবে তা ব্যবহার করা যেতে পারে। একই সঙ্গে এটি জেনে রাখা ভালো, কোনোক্রমেই এটি সর্বশ্রেষ্ঠ পন্থা নয়। সাধারণত ভ্রমণসহ বিভিন্ন কারণে পানির প্রাপ্যতা না থাকা অথবা পানি ব্যবহারে যেকোনো ধরনের অসুবিধা থাকায় তা এড়াতে অ্যালকোহল বেইজ ‘হ্যান্ড স্যানিটাইজার’ ব্যবহার করা হয়। অণুজীব মারতে অধিক কার্যকর, এমন কারণে নয়। তবে অ্যালকোহল বেইজ ‘হ্যান্ড স্যানিটাইজার’ ছাড়া অন্য উপাদানসমৃদ্ধ (ক্লোরোহেক্সাডিন, ক্লোরোজাইলেনল ইত্যাদি) ‘হ্যান্ড স্যানিটাইজার’ যথেষ্ট কার্যকর হলেও দুষ্প্রাপ্য ও ব্যয়বহুল।

আমাদের দেশের জন্য সবচেয়ে উপযোগী ‘হ্যান্ড স্যানিটাইজার’ হচ্ছে ক্ষারযুক্ত সাবান। ব্যবহারের উপযোগিতার জন্য মার্চ ২৫ প্রথম আলো পত্রিকার অনলাইন পাতায় ‘ঘরে বানান তরল সাবান’ শিরোনামে যে ভিডিওটি রয়েছে, তা অতি গুরুত্বের সঙ্গে বহুল প্রচারের ব্যবস্থা করা প্রয়োজন। এখানে দেখানো হয়েছে কীভাবে অতি সহজে ও কম ব্যয়ে যে কেউ তরল সাবান প্রস্তুত করতে পারবেন। একটি বোতলে দেড় লিটার পানিতে চার চা-চামচ পরিমাণ বাজারে সহজলভ্য যেকোনো ডিটারজেন্ট গুলিয়েই এ ধরনের তরল সাবান প্রস্তুত করা সম্ভব। এ ছাড়াও শক্ত বা বার সাবানকে তরল করতে প্রয়োজনীয় পরিমাণ পানিতে গুলিয়েও তৈরি করা যায় তরল সাবান। এভাবে তৈরি করা তরল সাবান ব্যবহারের উপযোগী সহজলভ্য বোতলে ভরে বোতলের মুখে একটি ছোট ছিদ্র করে অথবা স্প্রে লাগিয়ে ব্যবহার করা যেতে পারে। করেনাভাইরাস মারতে এ পর্যন্ত আবিষ্কৃত ‘হ্যান্ড স্যানিটাইজার’ এর মধ্যে তরল বা কঠিন সাবানই সবচেয়ে কার্যকর। এ বিষয়ে সরকারসহ সব কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি। প্রয়োজনে এ ধরনের সাবান ও ডিটারজেন্ট উৎপাদনে জরুরি পদক্ষেপ নেওয়া যেতে পারে। পাশাপাশি মহল্লার মোড়ে, প্রতিষ্ঠানের প্রবেশমুখে, এমনকি নাগরিকেরা নিজ দায়িত্বে নিজ নিজ গৃহে প্রবেশের মুখে সাধ্যমতো হাত ধোয়ার ব্যবস্থা রাখতে পারেন।

শ্বাসযন্ত্রীয় স্বাস্থ্যবিধি ও কাশি শিষ্টাচার মেনে চলা
কোভিড-১৯ ছড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বে নতুন আরেকটি শব্দের ব্যাপক প্রচলন ঘটেছে তা হলো, শ্বাসযন্ত্রীয় স্বাস্থ্যবিধি ও কাশি শিষ্টাচার বা রেসপোরেটরি হাইজিন অ্যান্ড কফ অ্যাটিকুয়েট। করোনার বিস্তার ঠেকাতে এটিও অত্যন্ত জরুরি। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এ বিষয়ে প্রথমেই সবার বিশেষত রোগী, রোগীর সঙ্গে থাকা ব্যক্তিবর্গ ও স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত লোকজনকে এ বিষয়ে প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব দিয়েছে। যেখানে-সেখানে কফ, থুতু না ফেলা। হাঁচি-কাশির সময় মুখ ও নাক কাপড় বা টিস্যু দিয়ে ঢাকা, কমপক্ষে হাঁচি-কাশির সময় কনুই ভাঁজ করে নাক মুখ ঢাকা। হাঁচি-কাশির পর হাত পরিষ্কারের স্বাস্থ্যবিধি অর্থাৎ সাবান বা ‘হ্যান্ড স্যানিটাইজার’ দিয়ে হাত ধোয়া। প্রয়োজনে অন্যদের থেকে হাঁচি-কাশি দেওয়া লোকজনকে বিচ্ছিন্ন করে রাখা। হাঁচি-কাশিতে ব্যবহৃত কাপড় বা টিস্যু আবরণযুক্ত ময়লা ফেলার বাক্সে আবদ্ধ করে ফেলা। হাঁচি-কাশি দেওয়া ব্যক্তির কাছ থেকে কমপক্ষে তিন ফুট বা এক মিটার দূরে থাকা। দূর থেকেই হাঁচি-কাশি দেওয়া রোগী চিহ্নিত করে স্বাস্থ্যকর্মীরা কেবল যথাযথ পোশাক পরেই তাদের কাছে যাবেন এবং রোগী পর্যবেক্ষণের পর নির্দেশিত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন।

আমাদের মনে রাখতে হবে, করোনাভাইরাস সাধারণত নাক, মুখ ও চোখ দিয়ে দেহে প্রবেশ করে। এ কারণে বারবার হাত ধোয়ার অভ্যাস করতে হবে, যখন-তখন নাকে, মুখে, চোখে হাত দেওয়া যাবে না। অনিরাপদ কঠিন তল যেমন টেবিল-চেয়ার, দরজার হাতল ইত্যাদির স্পর্শ পরিহার করতে হবে। যদি এ ধরনের তল ধরা এড়ানো না যায়, তা হলে তা স্পর্শ করার পর সম্ভাব্য প্রথম সুযোগেই হাত পরিষ্কার করতে হবে। হাত পরিষ্কার করার আগ পর্যন্ত কোনোভাবেই মুখমণ্ডলের কোনো স্থানে হাত দেওয়া যাবে না। এ ধরনের সতর্কতা মেনে চললেই আমরা করোনা প্রতিরোধে সফল হতে পারব।

*লেখক: অধ্যাপক, ফার্মেসি বিভাগ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়