করোনা, থানকুনিপাতা, গুজব এবং বাংলাদেশ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

বিশ্বব্যাপী মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়েছে করোনাভাইরাস। ভাইরাসটির উৎপত্তিস্থল চীন হলেও ইতালিতে ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে। ইতালির চেয়েও ভয়ংকর রূপে এ ভাইরাস স্পেনে আক্রমণ করেছে। নানা সমস্যায় জর্জরিত ছোট্ট ঘনবসতিপূর্ণ একটি দেশ বাংলাদেশও আজ এই ভাইরাসের কবলে। ইতিমধ্যে এই ভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন ডাক্তারসহ ৪৮ জন। পরপারে চলে গেছেন ৫ জন।

বিদেশে জনশক্তি রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান প্রথম সারিতে। তাই উন্নত দেশগুলোতে প্রবাসী বাংলাদেশির সংখ্যা অনেক বেশি। করোনার থাবায় ওই দেশগুলো থেকে গণহারে এ দেশে প্রবাসীরা এসেছেন। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে সরকার পড়েছে নানা সংকটে। জনসাধারণ মানছে না নিয়মকানুন। যেখানে দেশের সর্বসাধারণের ভালোর জন্য নাগরিক হিসেবে সরকারকে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি সাপোর্ট দেওয়া উচিত, সেখানে জনগণ ছড়াচ্ছে একের পর এক গুজব।

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক বিশ্বে কোথাও আবিষ্কৃত না হলেও বাংলাদেশের মানুষ নিজেদের মহাগবেষক দাবি করে একের পর এক আবিষ্কার করে চলছে প্রতিষেধক। কখনো থানকুনিপাতা, কখনো আদা-লবঙ্গ দিয়ে রং চা, কখনো গোলমরিচ। দেশের আপামর জনগণ এসবকে করোনাভাইরাসের প্রতিষেধক হিসেবে স্বীকৃতি দিয়ে দিচ্ছি। এসব কি বিশ্বাস করার মতো? নোয়াখালীর এক বন্ধু জানাল করোনাভাইরাস থেকে বাঁচতে ওদের এলাকায় সবাই রঙ চা খাচ্ছে। পুরো বিশ্ব যুক্তিতে, চিন্তা আর বুদ্ধিতে যখন এগিয়ে যাচ্ছে, তখন আমরা আদিম যুগে পড়ে আছি। চিন্তাভাবনার লেভেল আদৌ প্রসারিত হয়নি। এখনো চিলে কান নিয়ে গেছে ভেবে চিলের পেছনে দৌড়াই। কয়েক দিন আগে থানকুনিপাতার গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল। থানকুনিপাতার পেছনে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দিয়েছিলাম আমরা।

থানকুনির তিনটি পাতা খেলে করোনাভাইরাস প্রতিহত করা যাবে—এ গুজবে দেশের অনেক বাজার থেকে উধাও হয়ে যায় থানকুনিপাতা। করোনাভাইরাসের সংক্রমণের হাত থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে—এমন গুঞ্জনে এক লাফে ১০ টাকার থানকুনিপাতা ওঠে ১৫০–২০০ টাকায়। এই হচ্ছি আমরা।

বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছোট ভাই মৌলভীবাজার থেকে ফোন দিয়ে বলল, রাত একটায় নাকি ভূমিকম্প হবে, তাই এলাকার সবাই বাইরে অবস্থান করছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত নয় কি? আধুনিক বিশ্বে বসবাস করলেও চিন্তা আর মননে আধুনিকতার ছোঁয়া আমাদের স্পর্শ করেনি। একের পর এক গুজব ছড়িয়ে পড়ছে দেশে। এ দেশের গ্রামাঞ্চলের অশিক্ষিত মানুষকে যেখানে গুজব সম্পর্কে সচেতন করবে এ দেশের শিক্ষিত সমাজ, সেখানে শিক্ষিত সমাজও উঠেপড়ে লেগেছে গুজবের পেছনে। বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া থেকে শুরু করে বড় চাকরিজীবীরাও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়াচ্ছেন। আর এদিকে সরকারবিরোধী অপশক্তি তো আছেই। কিছুদিন আগে এই গুজবের কারণে আকাশচুম্বী বেড়ে গিয়েছিল পেঁয়াজ আর লবণের দাম। লাভটা হয়েছে কাদের? গুজবে লাভবান হয়েছে ব্যবসায়ী আর সমাজের বিত্তশালীরা আর আপনি দ্বিগুণ দামে পণ্য ক্রয় করেছেন। ক্ষতি কিন্তু আপনারই।

প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের প্রভাব পড়েছে ধানের দামেও। এক লাফে এর দাম বেড়ে প্রায় দ্বিগুণ হয়েছে। অনেকে আবার ধান বিক্রিও করছেন না। বেড়ে গেছে চালের দামও। গুজবের কারণে পণ্যের কৃত্রিম সংকট তৈরি হচ্ছে ধান-চালের।। শুধু কি সাধারণ মানুষই গুজব ছড়াচ্ছে? সম্প্রতি চট্টগ্রামে করোনা নিয়ে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে এক চিকিৎসককে আটক করা হয়। করোনাভাইরাসে চট্টগ্রামে কয়েকজন মারা গেছেন, এমন গুজব ছড়ানোর অভিযোগে ওই চিকিৎসককে আটক করে পুলিশ।

করোনা নিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে খুলনায় একজনকে গ্রেপ্তার করে র‌্যাব-৬। চীনফেরত শিক্ষার্থীও গুজবের কবল থেকে রক্ষা পাননি। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার উপসর্গ নিয়ে চীন থেকে এক মেডিকেল শিক্ষার্থী সাতক্ষীরার তালা সদরের বাড়িতে এসেছেন বলে গুজব ছড়ানো হয়। করোনা নিয়ে ফেসবুকে গুজব ছড়ানো হয়েছিল গাজীপুরের শ্রীপুর উপজেলায় প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষিকা করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছেন। পরে ওই যুবককে আটক করা হয়। চট্টগ্রাম নগরীর হালিশহর ক্যান্টনমেন্ট স্কুলের চার শিক্ষার্থী করোনাভাইরাসে আক্রান্ত—এমন গুজব ছড়িয়েছিলেন এক ব্যবসায়ী। পরে তাকে আটক করেছে র‌্যাব। ফেসবুকে গুজব ছড়ানো হয়েছে ফেসবুকে আট মাসের ওষুধ মজুত নিয়ে। ফেসবুক, মেসেঞ্জারসহ সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোতে ঘুরেফিরে একটি বার্তা সবাই ফরোয়ার্ড করে ফলে জনমনে নানা জল্পনাকল্পনার সৃষ্টি হয়।

ডিজেল–সংকটের খবরকে গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল দেশে। পরে ডিজেল–সংকটের খবরকে গুজব বলছে বিপিসি দেশের বিভিন্ন এলাকায় ডিজেল–সংকটের খবরকে গুজব বলে জানিয়ছিল বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম করপোরেশন। বাদ যাননি কণ্ঠশিল্পী এন্ড্রু কিশোরও। গত বছরের ডিসেম্বরে এন্ড্রু কিশোরের মৃত্যুর গুজব ছড়িয়ে পড়েছিল দেশে। জীবিত মানুষকেও আমরা গুজব ছড়িয়ে মেরে ফেলছি।

পুরো বিশ্বে বিভীষিকাময় পরিস্থিতি। উন্নত দেশগুলো আজ চিন্তিত। সবাই প্রাণঘাতী ভাইরাস থেকে বাঁচতে সচেতন হচ্ছে। সেখানে আমাদের দেশের মানুষ গুজব রটিয়ে গুজব খাচ্ছে। বাংলাদেশকে গুজবের দেশ বললেও ভুল হবে না। দেশের মানুষের চিন্তাভাবনা দিনের পর দিন এমন কেন হচ্ছে? গণমাধ্যমকর্মী ও বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া একজন শিক্ষার্থী হিসেবে আমার মাথায় ঘুরপাক খাচ্ছে এ প্রশ্ন। এ প্রশ্নের উত্তর দেবে কে? সরকারের প্রতি আকুল আবেদন থাকবে, প্রতিটি জেলায়-উপজেলা, ইউনিয়ন এমনকি ওয়ার্ড পর্যায়ে গুজববিরোধী সেল গঠনের জন্য। যারা এসব অপপ্রচার সঙ্গে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নিলে দেশের অন্যতম সমস্যা ‘গুজব’র সমাধান হবে। সরকার গুজব প্রতিরোধে কঠোর না হলে সামনের দিনুগলোতে কঠিন মাশুল দিতে হবে।

*লেখক: শিক্ষার্থী, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়।