আমরা জাগলেই আসবে নতুন ভোর

মুক্তির পর হাসপাতাল থেকে বাসার পথে খালেদা জিয়া। ছবি: হাসান রাজা
মুক্তির পর হাসপাতাল থেকে বাসার পথে খালেদা জিয়া। ছবি: হাসান রাজা

‘আমি হব সকালবেলার পাখি
সবার আগে কুসুমবাগে উঠব আমি ডাকি’

ছেলেবেলায় কে না পড়েছি বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুলের এই অসাধারণ কবিতাটি। সকালবেলার পাখি বলতে জাতীয় কবি এক নতুন ভোরের কথা বলেছেন, নতুন সভ্যতার কথা বলেছেন। ছোটবেলায় ভাবতাম, বাহ্, পাখি হয়ে গাছের ডালে ডালে বসে মিষ্টি সুরে ডাকব আর মা চমকে যাবে! ইশ, কী মজা হবে!

হয়তো সেই মিষ্টি পাখি হতে পারিনি, কিন্তু এটুকু উপলব্ধি করার বোধ হয়েছে, কেন কবি ‘সকালবেলার পাখি’ হওয়ার কথা বলেছিলেন।

দিন বদলের কথা, নতুন এক সম্ভাবনাময় আধুনিক সভ্যতার কথা বলেছেন। বর্বরতা, গোলামি, দাসত্ব, হানাহানি, অভাব, অনাচার, দারিদ্র্য, অন্যায়—এসবের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে অন্ধকার যুগের অবসান ঘটিয়ে এক শুভ সকালের আগমনী বার্তার কথা বলেছেন।

সকালের পাখি যেমন ঘুম থেকে মানুষকে জাগায়, তেমনি আমরাও আমাদের বিবেক দিয়ে বুদ্ধি দিয়ে এ সমাজটাকে যেন জাগ্রত রাখতে পারি, দিন বদলের অভিনব পদ্ধতি অবলম্বন করতে পারি, মানুষের কল্যাণে সেটাই এ কবিতার ভেতর দিয়ে আমরা শিখেছি।

কিন্তু সত্যিই কি আমরা জেগেছি? বয়ে আনতে পেরেছি নতুন দিনের আলোকবর্তিকা? গোলামি, চামচামি, দাসত্ব, অনাচার কিছুই কি ছাড়তে পেরেছি? পারিনি।

লেখাপড়া শিখে শিক্ষিত জাতি হয়ে বিশ্বের দরবারে নিজেদের এক রোল মডেল হিসেবে দাঁড় করিয়েছি। আদৌ কি আমরা প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাটুকু ছাড়া স্বশিক্ষিত ও সুশিক্ষিত মানুষ হতে পারছি? ঘুচাতে পেরেছি কি সমাজের কুসংস্কারাচ্ছন্ন যুক্তিবোধহীন সব অন্ধকার?

সম্ভবত পারছি না। শুধু শিক্ষিত নামের তালিকাটাই লম্বা হচ্ছে, বাড়ছে পার্সেন্টেজ।

দেশ আজ মহাসংকটে। পুরো পৃথিবী আজ পার করছে ক্রান্তিকাল। মহামারি আকার ধারণ করেছে কোভিড–১৯ বা করোনাভাইরাস। প্রতিটি মানুষ আতঙ্কিত। মৃত্যুর সঙ্গে লুকোচুরি খেলছে যেন। মানুষ নিরুপায় হয়ে, স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে আছে এক বুক শূন্যতা নিয়ে ওই আকাশের দিকে।

সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসান বয়স্ক দুই ব্যক্তিকে কান ধরে ওঠবস করাচ্ছেন। ছবি: সংগৃহীত
সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসান বয়স্ক দুই ব্যক্তিকে কান ধরে ওঠবস করাচ্ছেন। ছবি: সংগৃহীত

আমাদের প্রশাসন তৎপর, তবে খানিকটা যেন অসময়ে। একটু একটু করে লকডাউন করা হচ্ছে রাস্তাঘাট, পাড়ামহল্লা, হাটবাজার, যানবাহন, এমনকি পরিবারের ভেতরেও চলছে একটা দূরত্ব এই ছোঁয়াচে রোগ থেকে সাবধানতা অবলম্বন করতে। যে যেমন করে পারছে, মাস্ক ব্যবহার করছে, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন থাকার চেষ্টা করছে।

কিন্তু খেটে খাওয়া মানুষগুলো, যাঁরা দিন এনে দিন খান, তাঁদের রাস্তায় বের হতেই হচ্ছে। কিন্তু জীবন রক্ষার স্বার্থে সরকার থেকে ঘোষণা এসেছে, সব মানুষকে ঘরে থাকতে হবে। কিন্তু ঘরে থাকার আগে তাঁদের মতো গরিব–দুস্থদের অন্নের কোনো জোগান করা হয়নি। কিছু মানবিক মানুষ ও মিডিয়ার কল্যাণে আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে বিত্তবান শ্রেণির মানুষেরা আর বিভিন্ন সংস্থা। কিন্তু বলতে হবে কেন, লিখতে হবে কেন, এটা তো যেকোনো রাষ্ট্রের প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব। তা ছাড়া দেশ বা রাষ্ট্রের দুঃসময়ে সরকার একা নয়, সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে সমানভাবে মানবিকতার হাত বাড়িয়ে।

যা–ই হোক, সরকারের নিষেধ অমান্য করে কেউ কেউ রাস্তায় নামছে। বাঙালি আমরা সারা জীবনই অবাধ্য জাতি, বড্ড বেপরোয়া! কিন্তু সময়টা তো বুঝতে হবে, বুঝতে হবে নিজের ভালো। সব সময় গায়ের জোরে কি চলে? এখানে একটা প্রশ্ন থেকে যায়, সরকার যোগাযোগব্যবস্থা লকডাউন না করে সাধারণ ছুটি কেন ঘোষণা করল? তাহলে কি এত বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হতো বাড়ি যাওয়ার জন্য? হতো না।

পোশাককর্মীদের সাধারণ ছুটি দিল, সে ক্ষেত্রেও অনেকটা সময় পার করে, জানি না কেন? বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিলেন, সেখানেও ছিল না কোনো বিশেষ ব্যবস্থা। বিএনপির শত শত সমর্থকের ভিড়, সেই সঙ্গে গণমাধ্যমকর্মীদের দায়িত্বশীল ভূমিকা পালনের সময়ও এক অর্থে বলতে গেলে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে বৈ কমায়নি। কই সেদিন তো কোনো প্রশাসনিক কর্তাব্যক্তিকে দেখলাম না কাউকে কানে ধরে উঠবস করাতে! সেদিন কি করোনার জীবাণু তবে বাক্সবন্দী ছিল?

তাই যদি হয়, তাহলে পেটের দায়ে রাস্তায় বেরোনো বাবার বয়সী বৃদ্ধদের কোন ক্ষমতার বলে যশোর মনিরামপুর উপজেলার সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসান কানে ধরে উঠবস করালেন। উনি তো সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ালেখা করেছেন। কিছুদিন শিক্ষকতার মতো মহান পেশাতেও জড়িত ছিলেন। শুধু তাই নয়, বিসিএস পরীক্ষায় বিশেষ স্থানও অর্জন করেছিলেন।

কিন্তু হায়, এত এত বইয়ের পাতা মুখস্থ করতে করতে সাইয়েমা হাসানের আর সকালবেলার পাখি হওয়া হয়ে ওঠেনি, হয়েছেন গ্রীষ্মের দাবদাহ দুপুরের এক কর্কশ কাক।

সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসান।
সহকারী কমিশনার (ভূমি) সাইয়েমা হাসান।

সাইয়েমা হাসানের আর দোষ কী বলুন, আজকালকার অধিকাংশ মা–বাবা চান সন্তানের প্রথম হওয়ার রেজাল্ট কার্ড। ডাক্তার ইঞ্জিনিয়ার যেন হতেই হবে যেকোনো মূল্যে। শতকরা ২০ শতাংশ মা–বাবা হয়তো বলেন, সবার আগে তুমি ভালো মানুষ হও। ম্যাডাম সাইয়েমা হাসান সম্ভবত সেই অভাগা ৮০% অভিভাবকের সন্তানের তালিকায় পড়ে গেছেন। এর ভয়ংকর পরিণাম গোটা জাতি দেখতে পেল। কোন সে ক্ষমতা, যার পরিপ্রেক্ষিতে একজন সরকারি কর্মকর্তা এতটা ধৃষ্টতা দেখাতে পারেন। সত্যি কথা বলতে এমন গোলামিতেই দেশটা আলোকিত হতে পারছে না। বরং ডুবে যাচ্ছে অন্ধকারের গহীন অতলে। যেখানে আমাদের উচিত এসব গরিব–অসহায়দের বাড়িতে খাবার পৌঁছে দেওয়া, তা না করে উল্টো পেটের তাগিদে রাস্তায় বসার জন্য এই বৃদ্ধ বয়সে জনমানুষের সামনে কানে ধরতে হয়। ইশ, কী লজ্জার! ভাবুন তো একবার খোলা রাস্তায় আমার বাবা, আপনার বাবা কানে ধরে উঠবস করছেন! ছি, কী অপমান!

‘আমরা যদি না জাগি মা কেমনে সকাল হবে
তোমার ছেলে জাগলে মাগো
রাত পোহাবে তবে’

এখানেও কবির অভিমান মেশানো সুর। মা বলতে জীর্ণ ঘুণে ধরা এ সমাজটাকে বোঝানো হয়েছে। সত্যিই যদি আমরা না জাগি, তবে কী করে নবদিগন্তের সূচনা হবে, উন্মোচিত হবে এক নতুন সম্ভাবনাময় স্বর্ণ যুগের।

অন্যায়, অবিচার, অশান্তি—এ সবকিছু সমাজ থেকে, দেশ থেকে দূরীভূত করতে হলে এই আমাদেরই ন্যায় ও শান্তির মশাল হাতে এগিয়ে যেতে হবে দৃপ্ত পায়ে। জাগতে হবে নিজের, সেই সঙ্গে জাগাতে হবে পুরো জাতিকে।

কিন্তু হায়, এ কোন সমাজ, কোনো জাতি, কোনো দেশ! জাতি হিসেবে যে অহংকার আমাদের ছিল, তা নিজেদের কৃতকর্মের জন্যই হারাতে বসেছি। এই তো কয়েক দিন আগে কুড়িগ্রামের সাবেক জেলা প্রশাসক সুলতানা পারভীন নিজের ক্ষমতাকে প্রয়োগ করে দুর্ধর্ষ এক গল্পের জন্ম দিলেন। এক সাংবাদিককে অপহরণ করলেন পুরো তামিল সিনেমার স্টাইলে। শুধু অপহরণ করেই ক্ষান্ত হননি, ওই সাংবাদিকের এমন কিছু ছবি তোলা হয়েছে, যা অযাচিত।

আমরা বলব না, একজন নারী হয়ে, মায়ের বয়সী হয়ে কী করে তিনি পারলেন এমন কাজ করতে, বরং বলতে পারি, সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়ে এমন আচরণ কীভাবে করতে পারলেন? এমন দুঃসাহস আর চরম ক্ষমতার উৎস কে বা কোথায়?

গ্রামের ভাষায় একটা কথা বলে, ‘মেওয়া ছাড়া মলন ঘোরে না’, মানে কৃষক ছাড়া যেমন হালচাষ হয় না, তেমনি কোনো পদস্থ কর্মকর্তার ইশারা ছাড়া একজন সামান্য বেতনভুক্ত কর্মকর্তার এত দুঃসাহস হয় কী করে! সামান্য তো বটেই, কারণ, তাঁরা যদিও বড় বড় ডিগ্রি অর্জন করেছেন, কিন্তু আদতে তাঁরা তো সরকারি গোলাম, কেবল আমজনতাই দেশের মালিক।

ভাবতে অবাক লাগে, এত বড় অন্যায়ের পরও বাংলা ট্রিবিউনের স্থানীয় প্রতিনিধি আরিফুল ইসলাম অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে ‘স্যার’ সম্বোধন করে বাক্যালাপ করেছেন।

তাহলে আমরা এ ক্ষেত্রে বলতেই পারি, ‘তুমি অধম, তাই বলিয়া আমি উত্তম হইব না কেন?’

সাইয়েমা হাসান ও সুলতানা পারভীনদের সাময়িক প্রত্যাহার কি একমাত্র শাস্তি?

শামিমা নূর পাপিয়া।
শামিমা নূর পাপিয়া।

কথা প্রসঙ্গে শামীমা নূর পাপিয়ার কথা না বললেই নয়। যে অপরাধ পাপিয়া করেছেন, তা কি এক দিনে করেছেন, নিশ্চয় নয়? এসব তথ্য কেবল গণমাধ্যমকর্মীরাই আবিষ্কার করতে পারবেন, যদি না তারা বাধার সম্মুখীন হন।

এ ধরনের মানুষ সমাজ তথা গোটা জাতির জন্য কলঙ্ক। তাঁদের এখনই থামাতে না পারলে এ সমাজ এ দেশ একদিন নষ্টদের দখলে চলে যাবে। পৃথিবী কলুষিত হবে অপকর্মে।

কাজেই আমরা আশা করব, দেশ তার সংকট কাটিয়ে উঠলে প্রশাসন এসব সন্ত্রাসীদের আইনের আওতায় এনে উপযুক্ত শাস্তির ব্যবস্থা করবে।

কাজেই আর ঘুম পাড়ানি গান নয়, এবার হবে মুক্তির গান। তবেই না আসবে সুপ্রভাত, আসবে নতুন ভোর।