বাংলাদেশি চলচ্চিত্রে শহীদুল ইসলাম খোকনের বেশি প্রয়োজন ছিল

শহীদুল ইসলাম খোকন। ছবি: সংগৃহীত
শহীদুল ইসলাম খোকন। ছবি: সংগৃহীত

একজন সিনেমা পরিচালক, যিনি বাংলাদেশি কোনো এক বাণিজ্যিক চলচ্চিত্রের পোস্টারে কোনো অভিনেতা অথবা নায়ক-নায়িকার ছবি রাখেননি, শুধু রেখেছেন পরিচালকের নাম; ছবিটি সেই সময় ব্যবসায়িক সফলতা লাভ করেছিল।

ছবিটির নাম ‘যোদ্ধা’। পরিচালনা করেন প্রয়াত শহীদুল ইসলাম খোকন। ২০০০ সালে মুক্তি পাওয়া ‘যোদ্ধা’ ছবিতে অভিনয় করেন রুবেল, পূর্ণিমা, রাজীব, হুমায়ুন ফরীদি, মিজু আহমেদ, খলিল, আনিসসহ আরও অনেকে। পরিচালক সিনেমায় অশ্লীলতার বিরুদ্ধে এভাবেই প্রতিবাদ করেছিলেন।

‘রক্তের বন্দী’ চলচ্চিত্রের মাধ্যমে খোকন তাঁর পরিচালনার অধ্যায় শুরু করেন। কিন্তু ছবিটি ব্যবসায়িকভাবে সফলতা পায়নি। খোকনের পরিচালনায় নির্মিত দ্বিতীয় ছবিটিও ব্যবসায়িকভাবে ব্যর্থ হয়। পরে রুবেলকে নিয়ে খোকন তৈরি করেন ‘লড়াকু’। এই ছবিটি ব্যবসায়িক সফলতা পায়। এরপর তাঁকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি।

শহীদুল ইসলাম খোকন ৪০টির মতো বাণিজ্যিক ছবি নির্মাণ করেন। তাঁর ছবি মানেই দর্শকদের কাছে একটা নতুন কিছু, একটা ভিন্ন কিছু। তিনি বাণিজ্যিক ছবিতে মৌলিক গল্প, দুর্দান্ত মার্শাল আর্ট আর জনপ্রিয় গানের সন্নিবেশ ঘটিয়েছেন। রুবেল, হুমায়ুন ফরীদি, আলেকজান্ডার বো, শিমলা, তামান্না, ড্যানি সিডাক, ইলিয়াচ কোবরা, কবির খাঁ মূলত তাঁর ছবিতে অভিনয় করেই দর্শকনন্দিত হয়েছেন।

শহীদুল ইসলাম খোকন এই ইন্ডাস্ট্রিতে পরিচালক হিসেবে সর্বোচ্চ টাকা পারিশ্রমিক হাঁকিয়েছে আবার পরিচালনার পাশাপাশি অভিনয়ও করেছেন দাপটে। নির্মাণ করেছেন বাংলাদেশের প্রথম সিক্যুয়েল মুভি ‘চেহারা’, দর্শকদের উপহার দিয়েছেন ডান্সিং কুংফু, ফুটবল কুংফু, আর্থ কুংফুসহ নিত্যনতুন সব মার্শাল আর্ট, যা বাংলাদেশের দর্শকেরা আগে পরে কখনো দেখেনি।

দেশি চলচ্চিত্রের গল্পের একঘেয়ে ভাব দূর করা এবং গল্পের ভিন্নতা আনতে শহীদুল ইসলাম খোকনই প্রথম মৌলিক গল্প নিয়ে বিনোদন ছবি নির্মাণ করেন। ‘ভণ্ড’, ‘অপহরণ’, ‘পাগলা ঘণ্টা’, ‘পালাবি কোথায়’, ‘ভেজা বেড়াল’, ‘ম্যাডাম ফুলি’ ছবিগুলো দেখলেই বোঝা যায় ব্যাপারটি। তিনি শুধু বিনোদন-বাণিজ্যিক সিনেমাই নির্মাণ করেছেন কি? মুক্তিযুদ্ধের গল্পকে আশ্রয় করে নির্মাণ করেন ‘কমান্ডার’, ‘ঘাতক’, ‘বিপ্লব’। এ ছাড়া আহমেদ ছফার ‘ওঙ্কার’ উপন্যাসকে বাংলা চলচ্চিত্রে রূপ দেন। আবার দেশপ্রেমের গল্প নিয়ে তৈরি করেন ‘লাল–সবুজ’।

‘যোদ্ধা’ ছবির পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত
‘যোদ্ধা’ ছবির পোস্টার। ছবি: সংগৃহীত

শহীদুল ইসলাম খোকনের আরও উল্লেখযোগ্য সিনেমা হলো ‘বীরপুরুষ’, ‘বজ্রমুষ্টি’, ‘বিপ্লব’, ‘অকর্মা’, ‘সতর্ক শয়তান’, ‘বিষদাঁত’, ‘টপ রংবাজ’, ‘উত্থান-পতন’। ১৯৯২ সালে ‘উত্থান-পতন’ চলচ্চিত্রে খোকন অভিনয়ও করেন। পরবর্তী সময়ে পরিচালনায় প্রতিষ্ঠা লাভ করলে আর অভিনয়ে ফিরে যাওয়া হয়নি তাঁর। শহিদুল ইসলাম সাচ্চু পরিচালিত ‘মেগাবন্ড’, সৌরজয় চৌধুরী পরিচালিত ‘অবশেষে নাটকে পরিণত হলো’ নাটকে অভিনয় করেন।

শহীদুল ইসলাম খোকন মানবাধিকার বিষয় নিয়ে বাস্তবভিত্তিক সিরিয়াস গল্প নিয়ে নির্মাণ করেন ‘স্বপ্নপূরণ’। বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের জীবন্ত কিংবদন্তি নায়ক-পরিচালক-প্রযোজক মাসুদ পারভেজ ওরফে সোহেল রানার হাত ধরে আসা এই গুণী পরিচালক তাঁর ‘লড়াকু’ মুভিতে এ দেশের দর্শকদের চিনিয়েছেন রুবেল এবং মার্শাল আর্টকে।

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সাংবাদিক সমিতির পুরস্কারপ্রাপ্ত এই তারকা পরিচালক নায়ক-পরিচালক-ভিলেনকে (রুবেল-শহীদুল ইসলাম খোকন-হুমায়ুন ফরীদি) একসঙ্গে জুটি বেঁধে মুভি নির্মাণ করতেন এবং ছবি হতো সুপার-ডুপার হিট।

বরিশালে জন্ম নেওয়া ক্ষণজন্মা সিনেমা পরিচালক শহীদুল ইসলাম খোকন চলচ্চিত্র পরিচালক সমিতির সভাপতিও ছিলেন। তিনি ২০১৬ সালের ৪ এপ্রিল না–ফেরার দেশে চলে যান এই গুণী নির্মাতা। আজ তাঁর চলে যাওয়ার চার বছর। আমরা হারিয়েছি একজন দেশপ্রেমিক মুভিমেকারকে। আজ বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের দুরবস্থায় তাঁর মতো একজন মেধাবী এবং সাহসী সিনেমা পরিচালকের বড় প্রয়োজন ছিল।

লেখক: রাষ্ট্রায়ত্ত কোম্পানিতে কর্মরত। [email protected]