ফিরে আসছে সবুজ, ফিরে আসছে সুর

প্রকৃতিকে রাঙিয়ে গাছে গাছে ফোটা পলাশের মাঝে চন্দনা। ছবি: লেখক
প্রকৃতিকে রাঙিয়ে গাছে গাছে ফোটা পলাশের মাঝে চন্দনা। ছবি: লেখক

সকালে পাখির ডাকে ঘুম ভাঙ্গার সুখটা যে ঠিক কি রকম, তা ভাষায় প্রকাশ করা সুকঠিন। প্রিয় টুনটুনি, চড়ুই, দোয়েল, বুলবুলি আর শালিকের মধুর ডাকাডাকিতে ঘুম ভাঙ্গছে করোনার এই দিনগুলোতে। জানালার পর্দাটা সরাতেই চোখে পড়ে গভীর নীল আকাশ আর চকচকে সবুজ পাতা। অনিন্দ্য সুন্দর প্রকৃতির এক সমারোহ। বহুকাল ধরেই যা থেকে বঞ্চিত ঢাকাবাসী। করোনাকালে প্রকৃতির এই মোহনীয় রূপটা তাই সহজেই চোখে পড়ছে। কয়দিনের ছুটিতে প্রকৃতি ধীরে ধীরে আবার ফিরে আসছে আগের রঙে, আগের রূপে। বায়ু দুষণ আর কালো ধোঁয়া না থাকায় এখন গাছের পাতাগুলো অনেক বেশী সবুজ আর সতেজ।

রমনা কালি মন্দিরের পুকুরে কচ্ছপ পরিবার। ছবি: লেখক
রমনা কালি মন্দিরের পুকুরে কচ্ছপ পরিবার। ছবি: লেখক

সামাজিক দূরত্ব বজায় রেখে আর সার্জিক্যাল মাস্কে নিজেকে সুরক্ষিত করে যখনই সুযোগ পেয়েছি ক্যামেরা কাঁধে বেরিয়ে পড়েছি। গত দুই সপ্তাহ ধরে প্রায় প্রতিদিনই। দিনমান উপভোগ করেছি প্রকৃতির রূপ-রস-বর্ণ-গন্ধ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শহীদুল্লাহ ও ফজলুল হক হলের মধ্যবর্তী পুকুর পাড় থেকে শুরু করে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান, রমনা লেক, কালি মন্দির পুকুর পাড়, বাংলা একাডেমী, দোয়েল চত্বর, কার্জন হল আর কলা ভবন ঘুরে বেড়িয়েছি। অসাধারণ এক ভালো লাগা আর ভালোবাসায় ভরে গেছে এই দেহ, মন ও প্রাণ। সময়-সুযোগ বুঝে নিসর্গগুলোকে ক্যামেরাবন্দী করার প্রয়াস পেয়েছি।

রমনা কালি মন্দিরের পুকুরে ডাহুক যুগল। ছবি: লেখক
রমনা কালি মন্দিরের পুকুরে ডাহুক যুগল। ছবি: লেখক

প্রায় পঞ্চাশ ধরনের পাখি দেখেছি এই কদিনে! দেখেছি চার ধরনের সাপ আর নানা রঙের প্রজাপতি। আরও দেখেছি কাছিম, কচ্ছপ আর দৃষ্টিনন্দন সব কাঠবিড়ালি। গাছে গাছে মৌমাছির বাসা। যখন থেকে ছবি তুলতে শিখেছি, তখন থেকেই শব্দকে বাঁধতে শিখেছি নিঃশব্দের মাঝে। গুরুজনরা শিখিয়েছিলেন প্রকৃতিকে বুঝতে হলে, জানতে হলে, ধারণ করতে হলে নিঃশব্দের কোনো বিকল্প নেই। তাই তো ইচ্ছে করেই অনেক পাখির ছবি তুলিনি। পাছে ওরা না আবার ক্যামেরা দেখে আতংকিত হয়ে ফিরে চলে যায়। অনেকটা সময় দু চোখ ভরে দেখেছি শুধুই হিজল আর ইস্টিকুটুম, চন্দনা আর পলাশ। এক মনোমুগ্ধকর স্বর্গীয় পরিবেশ!

সোনালী ডানার শঙ্খ চিল। ছবি: লেখক
সোনালী ডানার শঙ্খ চিল। ছবি: লেখক

দেখার সুযোগ হলো, মিষ্টি চেহারার মায়াবী ডাগর চোখের তিন ডোরা কাঠবিড়ালি। এই কাঠবিড়ালিগুলো মজার মজার ঘটনা ঘটাতে ওস্তাদ। বড়সড় পাকা কোনো বাতাবি লেবুর মুখ কেটে সুড়ুৎ করে ভেতরে সেঁধিয়ে যায় লেজ গুটিয়ে। ভেতরে বসে আপনমনে খেতে থাকে, আর বাইরে থেকে বাতাবি লেবু নড়ে। অনভিজ্ঞ মানুষ বাতাবি লেবুর অমন হঠাৎ নড়াচড়ায় হতবাক হয়। ভৌতিক কিছু ভেবে ভয়ও পায় কেউ কেউ। সেই কাঠবিড়ালি যে হঠাৎ করে এভাবে আমার পায়ের ওপর এসে বসে যাবে সেটা কল্পনাও করতে পারিনি। মূর্তির মতো ঠায় বসেছিলাম। নড়ার চেষ্টা করিনি। প্রাণিকূলের এমন নিখাদ মমতা-ভালবাসা ছুঁড়ে ফেলি কেমন করে!

পায়ের ওপর তিন ডোরা কাঠবিড়ালি। ছবি: লেখক
পায়ের ওপর তিন ডোরা কাঠবিড়ালি। ছবি: লেখক

কলাগাছে মোচা এসে গেছে। সারিবদ্ধভাবে সাজানো লালচে ফুলগুলো দেখতে বেশ লাগছে। ভিউ ফাইন্ডারে চোখ রেখে ছোট কলা ও ফুলসমেত কলার মোচায় ক্লিক করছি। এমন সময় ক্যামেরার ফ্রেমের ভেতর লাল খোপওয়ালা সোনালি পিঠের এক পাখির প্রবেশ ঘটল। এমন দৃশ্য ফ্রেমবন্দী করার ইচ্ছা ছিল অনেক দিনের। কিন্তু ভাবতে পারিনি, এটাই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ। বিচিত্র সব পাখির মধ্যে এটাই সেই পাখি, যা কাঠ ঠোকরাতে পটু। এভাবে কাঠ ঠোকরানোর ফলে এরা খুঁজে পায় গাছের বাকলের খাঁজের মধ্যে লুকিয়ে থাকা পোকামাকড়দের। এই পোকাগুলো এদের খাবার। গাছের গায়ে গর্ত করে বাসাও তৈরি করে এরা। সেই বাসায় থাকে এদের ডিম।

কলার মোচায় কাঠঠোকরা। ছবি: লেখক
কলার মোচায় কাঠঠোকরা। ছবি: লেখক

“আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে-এই বাংলায়/হয়তো মানুষ নয়-হয়তো বা শঙ্খ চিল শালিখের বেশে” কবি জীবনানন্দের সোনালি ডানার সেই চিলকে খুঁজে পেলাম সোহরাওয়ার্দী উদ্যানেই। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে বিশ্রাম নিলাম কদম গাছের নীচে। গা ছমছম শব্দে কোথায় যেন ডেকে উঠল। উপরে তাকিয়ে দেখি এক গাছে খয়ড়া শিখড়ে আর অন্যটাতে খুড়ুল প্যাঁচা। কিছু দূর যেতে না যেতেই খুঁজে পেলাম অনন্য সুন্দর চোখ জুড়ানো হুদহুদ পাখি। এটি ইজরায়েলের জাতীয় পাখি। রমনা মন্দিরের পুকুরে দেখা পেলাম প্রণয়াবদ্ধ ডাহুক যুগলের। বিকেলের শেষ আলোতে নিশি বকের দেখা মিলল। দেখে মনে হলো যেনো তার সারা দিনের কর্মপরিকল্পনা সেরে নিচ্ছে!

সাঁঝের বেলায় নিশি বক। ছবি: লেখক
সাঁঝের বেলায় নিশি বক। ছবি: লেখক

উদ্যানের নির্মল বাতাসে বসে বসে ভাবছিলাম, উন্নয়নের ছোবল নয়। আমাদের চাই উন্নয়নের ছোঁয়া। প্রকৃতি বাঁচলে মানুষ বাঁচবে। প্রাণ ভরে শ্বাস নিতে পারবে। রোগ-শোক থেকে মুক্ত থাকবে। সুন্দরবন আর সংরক্ষিত বনভূমি উজাড় নয়। যে কোন মূল্যে এদের সঠিক পরিচর্যা ও সংরক্ষণ করতে হবে। আর একটিও বৃক্ষনিধন নয় অকালে। সামাজিক বনায়নের ধারা চালু রেখে পাখির বংশ বিস্তার, জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এগিয়ে আসতে হবে আমাদের সবাইকেই। পরবর্তী প্রজন্মকে দূষণমুক্ত পরিবেশ উপহার দেয়াই হোক করোনাকালীন সময়ে আমাদের দৃঢ় অঙ্গীকার।

*লেখক: নিসর্গপ্রেমী ও বন্যপ্রাণী আলোকচিত্রী