কৃষকদের কী হবে করোনাকালে
যত ঝড় বিপদ যা–ই হোক না কেন, কৃষকদের তো আর ছুটি নেই। তাঁদের কাজের শেষ নেই। শেষ নেই তাঁদের বিড়ম্বনার। বর্তমানে করোনা পরিস্থিতি দিনের পর দিন খারাপের দিকেই যাচ্ছে। কোথাও কোনো আশার আলো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। এমন অবস্থায় দেশ একধরনের অচলাবস্থার দিকে যাবে। কিন্তু এই অচলাবস্থা কবে ফিরে আসবে, তা কেউ বলতে পারে না। কিন্তু অচলাবস্থা ফিরে না এলেও চলে এসেছে কৃষকদের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়।
কিছুদিন বাদেই বোরো ধান ঘরে তুলতে হবে। এই বোরো মৌসুম হচ্ছে কৃষকদের জন্য সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মৌসুম। এই সময়ে সাধারণত হরেক রকমের ধান উঠে থাকে। ভাত খাওয়ার জন্য সাধারণত আমরা যেসব চাল পছন্দ করি, তার অধিকাংশই এ মৌসুমে চাষ হয়ে থাকে। আমাদের সবার প্রিয় মিনিকেট, জিরাশাইল, বাংলামতি, বিরি ধান-২৮, ২৯ চাষ হয় এই মৌসুমে। ভাতের চালের জন্য এই মৌসুম অনেক গুরুত্বপূর্ণ।
ভাতের চালের জন্য বাহারি রকমের ধান চাষ হয় এই সময়। কিন্তু দুঃখের বিষয় হচ্ছে, ইতিমধ্যে কিন্তু ধান তোলার সময় হয়ে গেছে। বিশেষ করে সিলেট, হবিগঞ্জ, সুনামগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের হাওর এলাকায় ধান অনেক আগেই পেকে যায়। সেসব এলাকার ধান ওঠে অন্যান্য এলাকার প্রায় এক মাস আগে। সেখানে এখনই ধান উঠে গেছে। অনেকের জায়গায় ধান মাটিতে পড়ে যাচ্ছে। সাধারণত ৮০ ভাগ ধান পাকার পরেই ধান কেটে ফেলতে হবে। না হলে পুরোপুরি পেকে গেলে সেই ধান আর কাটা সম্ভব হয় না। শিষ থেকে ধান ঝরে পড়ে মাটিতে। তখন কাটতে গেলে বিশাল ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়। অর্থাৎ এখনই হাওর এলাকায় ধান কাটার উপযুক্ত সময়। কিন্তু করোনার কারণে তো কৃষকেরা বের হতে পারছেন না।
কৃষক বের হতে পারছেন না, পাশাপাশি বের হতে পারছেন না শ্রমিকেরাও, আর তাঁরা বের না হতে পারলে কীভাবে এই ধান কাটা সম্ভব হবে।
গত বছর বোরো মৌসুমে কৃষকেরা বিপাকে পড়েছিলেন মূল্যের কারণে। এমন অবস্থা হয়েছে যে শ্রমিকের মূল্য পর্যন্ত ওঠেনি ধান বিক্রির টাকায়। অনেক কৃষককেই দেখা গেছে ধান কাটেননি। তাঁরা জমিতেই ফেলে রেখেছেন ধান। অনেকে তো রাগ, ক্ষোভ আর অভিমানে জমিতেই পুড়িয়ে ফেলেছেন। কৃষকেরা দাম না পেলেও সেই ধান দুই চার হাত ঘুরে ভোক্তা পর্যায়ে এলে তখন দাম হয়ে যায় চড়া। বিশেষ কিছু সিন্ডিকেট আঁকড়ে ধরে আছে এই বাণিজ্য। এদের বলয় ভাঙতে না পারলে আমাদের দেশের কৃষক আর বাঁচতে পারবেন না।
জাপান দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর একটি বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল যে কোনোদিন যেন কৃষক ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিত না হন। কারণ, কৃষক যদি চাষাবাদ বন্ধ করে দেন, তাহলে খাদ্যের অভাব পড়বে। খাদ্যের অভাব কাকে বলে, সেটা তারা টের পেয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়। একদিকে আমার দেশের কৃষকেরা দাম পান না, অন্যদিকে বাইরে থেকে চাল এনে সয়লাব করে ফেলা হয় দেশের মার্কেট। সেসব চাল বিক্রি করা হয় আমাদের দেশে উৎপাদিত চালের চেয়েও বহুগুণ কম মূল্যে। সাধারণ ভোক্তা পর্যায়ে তখন আমাদের দেশের উৎপাদিত চালের আর চাহিদা থাকে না।
দেশের দক্ষিণাঞ্চলের কিছু এলাকা, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, টেকনাফসহ বিভিন্ন জায়গায় এখন তরমুজ, বাঙ্গি ওঠার সময়। এই তরমুজ ও বাঙ্গি ইতিমধ্যে খাওয়ার যোগ্য হয়ে গেছে। আর করোনার কারণে সবকিছু লকডাউন হওয়ার ফলে এসব ফসল খেত থেকে তোলার সুযোগ পাচ্ছেন না কৃষক। আবার এরই মধ্যে ঝড়, বৃষ্টিবাদল এমনকি শিলাবৃষ্টিও শুরু হয়ে গেছে। এমন অবস্থায় ক্ষতিগ্রস্ত হবে মাঠের তরমুজ এ বাঙ্গি। আমরা সাধারণত জেনে থাকি, তরমুজ অনেক লাভবান একটি ফসল। সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে তরমুজ চাষে দ্বিগুণ, তিন গুণ পর্যন্ত লাভ করা সম্ভব। কিন্তু এসবের সবকিছুই এখন কৃষকের কাছে অমাবস্যার চাঁদ মনে হবে। কারণ, এখন এসব ফসল তোলা অনেকটাই অসম্ভব কাজ হয়ে যাবে।
এসব ফসল ছাড়াও এখন ক্ষেতে রয়েছে নানান ধরনের সবজি। এগুলো তোলার জন্য অবশ্যই ব্যবস্থা গ্রহণ করা উচিত। একদিকে আমরা যেমন খাদ্যের সংকটে পড়ব অন্যদিকে আমাদের কৃষকেরা মাঠে মারা যাবে। এমনিতেই করোনা–পরবর্তী পরিস্থিতি দেশে কী হয়, তা বোঝা কঠিন। তার মধ্যে যদি খাদ্যের সংকট দেখা দেয়, তাহলে অবস্থা শোচনীয় হবেই। তাই উপায় খুঁজতে হবে ফসল তোলার।
কৃষকদের জন্য তো কোনো ব্যবস্থা এমনিতেও নেই। সাধারণত সবকিছুর জন্য ইনস্যুরেন্স ব্যবস্থা থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ফসলের জন্যও বিমার ব্যবস্থা আছে। এক বছর যদি ফসল নষ্ট হয়ে যায়, তাহলে কৃষক কীভাবে বাঁচবে, এটা তো আমাদের ভাবতে হবে। বড় বড় ইন্ডাস্ট্রির জন্য যদি প্রণোদনা ব্যবস্থা থাকে, তাহলে অবশ্যই কৃষকের জন্য করোনার জন্য প্রণোদনা ব্যবস্থা থাকতে হবে। কৃষকদের জন্য অবশ্য পাঁচ হাজার কোটি টাকার প্রণোদনা ঋণ প্রস্তাব ঘোষণা করা হয়েছে। তবে সেটা যেন সঠিকভাবে ব্যবহার হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে। তবে যাঁদের ক্ষতি হবে তাঁদের সরাসরি অনুদানের ব্যবস্থা করতে হবে।
এখন যেসব ফসল মাঠে আছে এগুলোকে অবিলম্বে তোলার ব্যবস্থা করতে হবে। এ জন্য কৃষি মন্ত্রণালয়, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরসহ যাঁরা যাঁরা দায়িত্বে আছেন, তাঁদের কাজ করতে হবে। কৃষকদের আধুনিক যন্ত্রপাতির প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি কৃষকদের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে, যাতে কৃষকেরাও করোনা থেকে সাবধানে থাকতে পারেন, সেই ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে হবে। মনে রাখতে হবে, কৃষকেরা আমাদের প্রাণ, আমাদের সঞ্জীবনী শক্তি। কৃষক বাঁচলে বাঁচবে দেশ।
* লেখক: বিএসসি, অনার্স (কৃষি) ও মাস্টার্স (কৃষিতত্ত্ব), পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়