শ্যামনগরের মানবতার ফেরিওয়ালা আলিমের গল্প

ছোটবেলায় প্রখ্যাত লেখক ইব্রাহিম খাঁর একটি অসাধারণ ছোটগল্প পড়েছিলাম। গল্পটির নাম ‘ভাঙ্গা কুলা’। যেকোনো প্রাকৃতিক দুর্যোগ এলে গল্পটির কথা মনে পড়ে। বিশেষ করে যখন দেখি কিছু নিবেদিতপ্রাণ লোক নিঃস্বার্থভাবে অন্যের সেবা করেন। গল্পটির সঙ্গে আমার আজকের গল্পের অনেকটা মিল আছে। গল্প বললে মনে হয় ভুল হবে। কারণ, আমি বাস্তব ঘটনা তুলে ধরছি। বর্তমানে ‘ভাঙ্গা কুলা’ গল্পটি পাঠ্যবইয়ে কোনো ক্লাসে পড়ানো হয় বলে আমার জানা নেই।
গল্পটির মূল বক্তব্য সংক্ষেপে তুলে ধরছি।
সারা দেশে প্রবল বন্যা। লেখকের ওপর অফিস থেকে আদেশ হলো টাঙ্গাইলের চরাঞ্চলের মানুষকে সাহায্য করার। লেখক এলাকাটা ঘুরে মানুষের মধ্যে রিলিফ বিতরণ শেষে ক্যাম্পে ফেরার পথে একটা ঘটনা শুনলেন। এক লোক অদ্ভুত উপায়ে ১০ জন মানুষকে বাঁচিয়েছেন। একটা ছনের চালার ওপর বাচ্চা নিয়ে ১০ জন মানুষ দুদিন ধরে উপোস ছিল। বাড়ির চারদিকে প্রবল পানির স্রোত থাকায় কেউ কাছে যেতে পারছিল না। একদল ভলান্টিয়ার সেখানে যায় নৌকা নিয়ে। ভলান্টিয়ারদের সরদারের অসীম সাহসিকতায় রক্ষা পায় তারা। লেখক ঘটনাস্থলে গিয়ে দেখেন ভলান্টিয়ার ক্যাম্পের কাছে মানুষের ভিড়। জানতে পারেন, সেখানে ভলান্টিয়ারদের সরদার শুয়ে আছেন। একটা নৌকা ডুবে গিয়েছিল, লোকটা কোথা থেকে ঝাঁপিয়ে পড়ে দুজনকে উদ্ধার করে, কিন্তু নিজে হয়রান হয়ে গেছেন। ভিড় ঠেলে কাছে গিয়ে লেখক দেখেন, শুয়ে থাকা লোকটা বড় মিঞা যিনি তাকে ৭ বছর আগে নৌকাতে করে নদী পার করে দিয়েছিলেন। ক্যাম্পের ডাক্তার বড় মিঞাকে দেখে মৃত ঘোষণা করলেন। লেখক তার বিদেহী আত্মার প্রতি সালাম জানিয়ে বললেন, ‘বন্ধু, দুনিয়ার দফতরে যারা মানুষের নাম লিখে রাখে তাদের নজরে পড়বে না জানি। কিন্তু আলিমুল গায়েব বলে যদি কেউ থেকে থাকে, তার দফতরে তোমার কীর্তি নিশ্চয় সোনার হরফে লেখা থাকবে।’
বিশ্ব্যাবপী করোনায় প্রতিদিন মানুষ মারা যাচ্ছে। সবাই আতঙ্কিত ও শঙ্কিত। এটা এমনই এক ভাইরাস, কেউ আক্রান্ত হলে বা মারা গেলে তার পাশে কেউ যাচ্ছে না। অত্যন্ত কাছের মানুষও পর হয়ে যাচ্ছে। এই দুর্যোগকালে লকডাউনের জন্য অনেকে বাড়ির বাইরে যেতে পারছে না। খেটে খাওয়া দিনমজুর ও অনেক মধ্যবিত্ত মানুষও খুব কষ্টের মধ্য দিয়ে অর্ধাহারে বা অনাহারে দিন অতিবাহিত করছে।
এসব অর্ধাহারে বা অনাহারে দিন অতিবাহিত করা মানুষের জন্য লোকজনকে বলে খাবারের ব্যবস্থা করা, বাড়িতে বাড়িতে খাদ্য পৌঁছে দেওয়া, অনলাইন ব্লাড ব্যাংকের মাধ্যমে জরুরি রক্তের প্রয়োজনে রক্তের ব্যবস্থা করা, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে সহযোগিতা করা, করোনায় মানুষকে সচেতন করে লিফলেট বিতরণ, বিনা মূল্যে গরিব মানুষের মধ্যে মাস্ক বিতরণ, মসজিদসহ বিভিন্ন অপরিষ্কার স্থান ব্লিচিং পাউডার দিয়ে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন করা, মসজিদে মসজিদে হাত ধোয়ার জন্য সাবান দেওয়া, লকডাউনে মানুষকে ঘরে থাকতে সচেতন করা—নিজের জীবন বাজি রেখে এমন অনেক কাজ নিঃস্বার্থভাবে করে যাচ্ছেন বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ উপজেলা সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার এক যুবক, যাঁর নাম আবদুল আলিম।

শুধু করোনাভাইরাসের সময় নয়, কলেজজীবন থেকেই নিঃস্বার্থভাবে নীরবে মানুষের সেবা করে আসছেন তিনি। মানুষের উপকার বা সেবা করাই তাঁর ধ্যানজ্ঞান। মানবসেবার পাশাপাশি এলাকার বেকার যুবকদের নিয়ে গড়ে তুলেছেন ব্যতিক্রমধর্মী ক্যাটারিং সার্ভিস। এই ক্যাটারিং সার্ভিসের নেই কোনো মালিক—যেখানে সবাই সমান। প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক হয়েও কোনো অতিরিক্ত অর্থ নেন না। ক্যাটারিং থেকে যে আয় হয়, তা সমানভাবে ভাগ করে নেন সবাই। নিজের সামান্য আয় ও অন্যের সহযোগিতায় রোজার সময় মসজিদে ইফতারির ব্যবস্থা ও মাদ্রাসায় গরিব ছাত্রদের কোরআন শরিফ দেন। বিভিন্ন জাতীয় দিবসে তৃষ্ণার্ত মানুষকে পানি পান করানো এবং কখনো ফুল দিয়ে বরণ করেন। ঈদের আগে এতিম শিশুদের পোশাক কিনে দেন, শীতার্ত মানুষের মধ্যে কম্বল বা শীতের পোশাক বিতরণ করেন।
ঘূর্ণিঝড় ফণী, বুলবুলসহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে মানুষকে নিরাপদ স্থানে যেতে সহযোগিতা করেন। যেকোনো বিপদে–আপদে ঝাঁপিয়ে পড়েন সবার আগে। অনেক অসহায় মানুষের আস্থার শেষ ঠিকানা আবদুল আলিম। এলাকার অসহায় গরিব মানুষের ক্যানসার, ব্রেন টিউমার, প্যারালাইসিস ও দুর্ঘটনায় বড় ধরনের কোনো ক্ষতি হলে তাদের জন্য মানুষের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ এবং প্রয়োজনে সুদূর ঢাকায় হাসপাতালে এসব মানুষকে নিয়ে যান। আবদুল আলিমের এই মহৎ কাজের জন্য দেশ–বিদেশের অনেক প্রবাসী তাঁর মাধ্যমে সহযোগিতা করে থাকেন।
সাতক্ষীরার শ্যামনগরের নকিপুর গ্রামে এক নিম্নবিত্ত পরিবারে জন্ম আবদুল আলিমের। বাবা অমেদ আলী ও মা জাহানারা বেগমের ৬ সন্তানের মধ্যে সবার ছোট আবদুল আলিম। বলতে পারেন ছোট খোকা। বয়স খুব বেশি হবে না, ২৬ বা ২৭। শ্যামনগর সরকারি মহসিন ডিগ্রি কলেজ থেকে ডিগ্রি পাস করেছেন।
বাবার আর্থিক অবস্থা ভালো না হওয়ায় ভালো করে লেখাপড়াও করতে পারেননি। শুধু পরিবারের মধ্যে নয়, তাঁর বংশের ৬০–৭০ জন সদস্যের মধ্যে তিনিই একমাত্র বিএ পাস। তাঁর বাবার প্যারালাইসিসের কারণে ভাইবোনদের লেখাপড়া বেশি দূর হয়নি। ভাইয়েরা নিজ নিজ জীবিকার পথ বেছে নেন আর বোনদের বিয়ে হয়ে যায়। ভাইয়েরা অনেক কষ্ট করে ছোট ভাইটিকে লেখাপড়া শিখিয়েছেন। মা অনেক কষ্টে ছোট ছেলেটিকে পড়িয়েছেন। সমাজে কাদের সঙ্গে মিশবেন, কীভাবে চলবেন—সব শিক্ষাই তাঁর মায়ের কাছ থেকে পেয়েছেন। তবে তাঁর মায়ের খুব দুঃখ, ছেলেটির একটি ভালো চাকরি না হওয়া। তাঁর মা আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করেন আর স্বপ্ন দেখেন, তাঁর ছোট খোকা একদিন ভালো একটি চাকরি পাবে।
চাকরি খুঁজছেন কিন্তু ভাগ্য এখনো সুপ্রসন্ন হয়নি। এখন তাঁর জীবনের একমাত্র চাওয়া ও পাওয়া একটি ভালো চাকরি। অসহায় মানুষের পাশে থেকে তাদের জন্য কিছু করতে পারলে আনন্দ খুঁজে পান তিনি। এলাকার অনেক বেকার যুবকের আদর্শ এখন আবদুল আলিম। দেশের দুর্যোগকালে সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার আবদুল আলিমের মতো নিঃস্বার্থ পরোপকারী উদ্যোমী যুবকের সারা দেশে খুব প্রয়োজন।
*লেখক: উন্নয়ন কর্মী