ব্যাকটেরিয়াজনিত মহামারিও দেখা দিতে পারে

প্রতীকী ছবি (এএফপি)
প্রতীকী ছবি (এএফপি)

অ্যান্টিবায়োটিকের অপব্যবহারের ফলে করোনাভাইরাসের মতো ব্যাকটেরিয়াল মহামারিও দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার অনেকটা অনিয়ন্ত্রিত। যেকোনো ওষুধের দোকানে গেলেই অনায়াসে অ্যান্টিবায়োটিক পাওয়া যায়। এই অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারে নেই কোনো সতর্কতা, জানানো হয় না কোন মাত্রায় (ডোজ) কত দিন খেতে হবে বা পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া কী। অপ্রয়োজনে অনিয়ন্ত্রিতভাবে প্রয়োগ করা হচ্ছে অ্যান্টিবায়োটিক। গ্রামের ‘হাতুড়ে ডাক্তারদের’ সর্ব রোগের ওষুধে পরিণত হয়েছে অ্যান্টিবায়োটিক। 

ব্যাকটেরিয়াজনিত রোগের বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করা হয়। আর মানবদেহে ঢুকে পড়া ভাইরাস মারার সরাসরি কোনো ওষুধ আজও আবিষ্কার হয়নি।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, অ্যান্টিবায়োটিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহারে সমস্যা কোথায়? অসুস্থ হলে তো ওষুধ খেতেই হবে। হ্যাঁ, ওষুধ খাবেন। তবে সঠিক রোগ নির্ণয়ের মাধ্যমে সঠিক ওষুধ সঠিক মাত্রায় খেতে হবে।

আমাদের একটু ঠান্ডা বা একটু জ্বর কিংবা একটু হাঁচি-কাশি হলেই অনেক ক্ষেত্রে ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়াই ওষুধের দোকানে গিয়ে অ্যান্টিবায়োটিক চাই। ওষুধের দোকানদারও অ্যান্টিবায়োটিক দিয়ে থাকেন নিজের ইচ্ছেমতো। কিন্তু এসব বেশির ভাগ সাধারণ রোগের জন্য অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার প্রয়োজন হয় না। এ ধরনের বেশির ভাগ অসুস্থতা থেকে ওষুধ ছাড়াই মানুষ সুস্থ হয়ে যায়।

অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার করলে ও সঠিক রোগের জন্য সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে না পারলে, মানবদেহে জীবাণু না মরে আরও শক্তিশালী হয়ে বাসা বাঁধে। এখন প্রশ্ন হচ্ছে, জীবাণু না মরলে না মরবে, আরও শক্তিশালী হবে কীভাবে? এই ব্যাখ্যাটা হলো: রোগ সৃষ্টিকারী ক্ষতিকর জীবাণু মানবদেহে ঢুকলে মানুষ অসুস্থ হয়ে পড়ে। সুস্থ হওয়ার জন্য ক্ষতিকর জীবাণু মারা প্রয়োজন হয়ে পড়ে, তাই জীবাণু (ব্যাকটেরিয়া) মারার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হয়। কিন্তু সঠিক জীবাণু মারার জন্য সঠিক অ্যান্টিবায়োটিক সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করতে না পারলে জীবাণু মারা যায় না; বরং জীবাণু ওই অ্যান্টিবায়োটিকটাকে নিজের জন্য ক্ষতিকর হিসেবে চিনে ফেলে। এর ফলে জীবাণুর শরীরে ওই অ্যান্টিবায়োটিকের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি হয়। যে কারণে পরবর্তী সময়ে ওই সঠিক ওষুধ সঠিক মাত্রায় প্রয়োগ করলেও আর জীবাণু মরে না।


বিষয়টি বুঝতে আরেকটু সহজ হবে, যদি বুঝতে পারি ভ্যাকসিন বা টিকা মানবদেহে কীভাবে কাজ করে। মানবদেহে ঢুকে পড়া ভাইরাস মারার সরাসরি কোনো ওষুধ আবিষ্কার হয়নি। কিন্তু প্রাণীর শরীরে প্রকৃতিগতভাবে থাকা রোগ প্রতিরোধক্ষমতাকে জাগ্রত করা হয় ভ্যাকসিনের মাধ্যমে। ভ্যাকসিন হচ্ছে, যে ভাইরাস আমাদের শরীরে অসুখ সৃষ্টি করে, সেই ভাইরাসের অকার্যকর অবস্থা অথবা ওই ভাইরাসেরই টক্সিন অথবা ওই ভাইরাসের বাহ্যিক প্রোটিন। ভাইরাসেরই টক্সিন অথবা ওই ভাইরাসের বাহ্যিক প্রোটিনের মাধ্যমে ভ্যাকসিন তৈরি করা হয়। তার মানে হচ্ছে, শরীরের ভেতরের জীবিত ভাইরাস মারার জন্য ওই ভাইরাসকেই মৃত অথবা অকার্যকর অবস্থায় মানবদেহে প্রবেশ করানো হয়, যাতে আমাদের শরীর ওই ক্ষতিকর জীবাণুটাকে চিনতে পারে এবং ওই ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি করতে পারে। তাই ভ্যাকসিন নির্দিষ্ট সময়ের ব্যবধানে সাধারণত তিনটি মাত্রায় (ডোজ) শরীরে প্রবেশ করানো হয়। তখন আমাদের শরীর ওই অপরিচিত ক্ষতিকর জীবাণুটার বিরুদ্ধে অ্যান্টিবডি বা রোগ প্রতিরোধক্ষমতা তৈরি করতে পারে। পরবর্তী সময়ে ওই জীবিত ভাইরাস শরীরে প্রবেশ করলে নতুন তৈরি হওয়া অ্যান্টিবডি ওই ভাইরাসকে মেরে ফেলে।

অপর্যাপ্ত মাত্রায় ও অপ্রয়োজনে অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ফলে জীবাণু ব্যাকটেরিয়াগুলো অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধগুলোকে চিনে ফেলছে প্রতিনিয়ত। এবং জীবাণু ব্যাকটেরিয়ার শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বা অ্যান্টিবডি তৈরি হচ্ছে। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন করে ও অপ্রয়োজনীয় অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করে ব্যাকটেরিয়ার শরীরে রোগ প্রতিরোধক্ষমতা বা অ্যান্টিবডি তৈরি করতে সাহায্য করছি আমরা নিজেরাই।
অ্যান্টিবায়োটিক সেবনের নিয়ম হচ্ছে, সঠিক রোগ নির্ণয় করে ওই রোগের জন্য যে জীবাণুটা দায়ী, সেই জীবাণুটা মারার জন্য যেই অ্যান্টিবায়োটিকটি অধিকতর কার্যকর, ঠিক সেই অ্যান্টিবায়োটিকটি প্রয়োগ করা। সেটা না হলে ওই জীবাণু মানবদেহে আরও শক্তিশালী আকার ধারণ করবে। কমে যাবে মানুষের রোগ প্রতিরোধক্ষমতা।

সেই ১৯২৮ সালে আলেকজান্ডার ফ্লেমিং প্রথম অ্যান্টিবায়োটিক পেনিসিলিন আবিষ্কার করেছিলেন। সেই থেকে অনেক গ্রুপের অ্যান্টিবায়োটিক আবিষ্কৃত হয়েছে। কিন্তু নতুন গ্রুপের চাইতে একই গ্রুপের নতুন জেনারেশন বেশি আপগ্রেডেশন হয়েছে।

কিন্তু খুব ভয়ের বিষয় হচ্ছে, অনিয়ন্ত্রিতভাবে ব্যবহার করার ফলে অনেক অ্যান্টিবায়োটিকে এখন আর জীবাণু মারা যাচ্ছে না।
এই অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজন হসপিটাল ফার্মাসিস্ট। প্রতিটি হাসপাতালে হসপিটাল গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট থাকা প্রয়োজন। ফার্মাসিস্ট অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারবেন, রোগীদের অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার সম্পর্কে বিস্তারিত ধারণা দেবেন, এর পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া জানাবেন। তখনই নিশ্চিত হবে অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক ব্যবহার। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও হসপিটাল ফার্মাসিস্ট বাধ্যতামূলক করতে হবে। এবং প্রেসক্রিপশন ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক বিক্রি বন্ধে কঠোর আইন প্রয়োগ করতে হবে।
পাশাপাশি আমাদের নিজেদের সচেতন হতে হবে। অ্যান্টিবায়োটিকের প্রয়োজনীয়তা ও এর গুরুত্ব অনুধাবন করতে হবে। রেজিস্টার্ড চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করা যাবে না। অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। অন্যথায় অদূর ভবিষ্যতে ব্যাকটেরিয়াজনিত মহামারির মুখেও পড়তে হতে পারে আমাদের।

লেখক : জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি, বাংলাদেশ ফার্মাসিস্ট ফোরাম
ই-মেইল: [email protected]