বিপণিবিতানে করোনার চাষ

প্রতীকী ছবি
প্রতীকী ছবি

নতুন পোশাক না কিনে, না পরলে, মানুষ কি মারা যাবে? কোভিড-১৯ তো বাড়ছে হু হু করে! সরকারি নির্দেশনায় মনে হচ্ছে, আমরা করোনাকে পরাস্ত করে ফেলেছি! ডিসিশন আপনারাই নিচ্ছেন, আবার আশঙ্কাও আপনাদের!

ইতিমধ্যে স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেছেন, ‘পোশাক কারখানা খোলায় ও দোকানপাটে আনাগোনা বাড়ায় সংক্রমণ বাড়তে পারে।’ মন্ত্রীর কাজ আশঙ্কা প্রকাশ করা নয়, বরং যথাযথ ব্যবস্থা নেওয়া।

আমরা মানছি, দেশে শিল্পের উৎপাদন গতিশীল রাখা, অর্থনীতি সচল রাখার স্বার্থেই এমন প্রয়োজন। কিন্তু তা কখনোই মানুষের জীবন সংশয়ের মধ্যে ফেলে নয়। স্বাস্থ্যমন্ত্রী আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। কিন্তু এখানে তো আশঙ্কা বা সম্ভাবনার কিছু নেই। এটা তো দিনের আলোর মতো পরিষ্কার। সবকিছু খুলে দিয়ে করোনার চাষ করলে ফল তো ঘরে আসবেই! ঈদকে বাহানা করে বিপণিবিতান খুলে দেওয়া সঠিক সিদ্ধান্ত নয়।


বড় বিভ্রান্তিতে আছি আমরা! গত দুই মাসের অভিজ্ঞতা ও বহির্বিশ্বের অবস্থাদৃষ্টে বিভ্রান্ত হতে হচ্ছে আমাদের। যখন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সামনে আরও কঠিন দিন আসছে। যেখানে মে মাসটাতে কঠোর হওয়ার কথা, সেখানে মার্কেট খোলা? ঈদের বাহানায় চলতি মাসটা পার করার একটু ধৈর্য না ধরে, দোকানপাট ও শপিং মল খোলার সিদ্ধান্ত, জেনেশুনে বিষ পান, না করোনার সঙ্গে ছেলেখেলা!


স্প্যানিশ ফ্লুর ইতিহাস আমরা জানি। স্প্যানিশ ফ্লু দীর্ঘায়িত হয়েছিল ১৯১৮ সালের জানুয়ারি থেকে ১৯২০ সালের ডিসেম্বর পর্যন্ত, প্রায় ৩৬ মাস। ৫০ কোটি মানুষ আক্রান্ত হয়েছিল, যা ওই সময়ের বিশ্বের জনগোষ্ঠীর প্রায় তিন ভাগের এক ভাগ। মৃত্যুর সংখ্যা ধরা হয় দুই থেকে পাঁচ কোটি। বলা হয়, সমসাময়িক কালের সবচেয়ে ভয়াবহ মহামারি ছিল সেটা। যদিও বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোভিড-১৯ স্প্যানিশ ফ্লুর মতো দীর্ঘায়িত হওয়ার আশঙ্কা নেই। কিন্তু আমরা ধৈর্যহীন হলে ক্ষয়ক্ষতি সামাল দেওয়া সম্ভব হবে না। করোনা ঠেকাতে যদি অফিসে সাধারণ ছুটি থাকে, জানাজা পড়া বন্ধ থাকে, তাহলে মার্কেট কেন খোলা থাকবে? ঈদের বাজারে মানুষ যখন করোনার জীবাণুর মতোই গিজগিজ করবে, তাতে করোনার বাম্পার (ফলন) বিস্তার ও ঘরে ঘরে এই ফসলের সুফল (!) পৌঁছে যাবে না তো? কেননা, আমরা যখন করোনার চাষ করব, ফল তো ঘরে আসবেই!

মহামারি বিস্তারের শত পথ খুলে দেওয়া হলো
যখন করোনায় আক্রান্ত ১০০-এর ঘরে ছিল, তখন প্রচারণা ও পুলিশি তৎপরতা যে রকম দেখা গিয়েছিল, বর্তমানে আক্রান্তের সংখ্যা প্রতিদিন হাজারের কাছাকাছি হলেও তৎপরতা কমে গেল! মহামারি বিস্তারের শত পথ খুলে দেওয়া হলো? অন্যান্য দেশের তুলনায় দেশের সংক্রমণ বা মৃত্যুর হিসাব দেখে শান্ত থাকার কোনো কারণ নেই।

সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত দোকানপাট ও শপিং মল খোলা থাকবে বলে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের প্রজ্ঞাপনে জানানো হয়েছে। আগে-পরে বাদ দিয়ে এ ছয় ঘণ্টা কোভিড-১৯ সাহেব কি ঘুমিয়ে থাকবেন! বিপণিবিতান খোলাই যদি রাখতে হবে, তাহলে সময় বাড়ালে ক্ষতি কী? এতে জনসমাগম কম হবে। অল্প সময় খোলা রাখলে মানুষ হুমড়ি খেয়ে পড়লে সামাজিক দূরত্ব বলে কিছু থাকবে না। এ জন্য ১০টা-৪টা বিপণিবিতান খোলার সময়সূচি নিয়েও সংশ্নিষ্ট ব্যক্তিদের ভাবতে হবে। কারণ, সময় যত সীমিত হবে, ভিড় বৃদ্ধির ঝুঁকির সঙ্গে ততই বাড়বে সংক্রমণের শঙ্কা। যখন ২০ জনের কম আক্রান্ত ছিল, তখন লকডাউন ছিল। এখন আক্রান্তের সংখ্যা ১০ হাজার ছাড়িয়ে গেলে লকডাউন শিথিল! অর্থনীতি রক্ষার দোহাই দিয়ে অপরিণামদর্শী সিদ্ধান্ত নেওয়া হচ্ছে কি না, তা আরেকবার পর্যালোচনা করা উচিত। চীন, ইতালি, আমেরিকার মতো একবার যদি দেশে মহামারি ছড়িয়ে যায়, তখন অর্থনীতির ভিত নড়বড়ে হয়ে যাবে কি না, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা একবার ভাবুন।

প্রশাসনের নজরদারি ও নিয়মরীতি শ্লথ
অন্যান্য দেশেও লকডাউন শিথিল হচ্ছে; কিন্তু কোনো পরিস্থিতিতে? আমরা কি সেই পরিস্থিতি অর্জন করতে পেরেছি? সরকারের নির্দেশনায় সীমিত পরিসরে ‘কয়েকটি শর্ত মেনে’ ঈদ উপলক্ষে বিপণিবিতান খোলার কথা বলা হয়েছে। কয়েকটি শর্তের ‘বজ্র আঁটুনি, ফসকা গেরো’র রূপ ধারণ করবে না, এ কথা কে না বুঝে? আসলে আমরা যাচ্ছি কোথায়, আমরাই জানি না। বাঙালিদের স্বভাবও বুঝতে হবে। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলেছিলেন, বাঙালি করেছ, মানুষ করোনি। এটাই যে শতভাগ সত্য হবে, সন্দেহ আছে কি? রবীন্দ্রনাথের বাঙালিরা দোকান-শপিং মলে যাবে এবং ভাইরাসকে ডেকে এনে ঘরে ঢোকাবে না, এর নিশ্চয়তাই কে দেবে?
গণপরিবহন ছাড়া প্রায় সব গাড়িঘোড়া রাস্তায় নেমেছে। রিকশা, ভ্যান, অটো পাওয়ার, বাইকের জটলা সৃষ্টি হচ্ছে। জমজমাট হচ্ছে বাজার। একটি একটি করে মিল-কারখানা খুলে যাচ্ছে। দেখে মনে হচ্ছে, বাংলাদেশকে বোধ হয় অচিরেই করোনামুক্ত দেশ হিসেবে ঘোষণা করা হবে। আমরা যদি সতর্ক না হই, তাহলে করোনায় আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেড়ে যাবে। মৃত্যুর সংখ্যাও বাড়বে লাফিয়ে লাফিয়ে। অথচ যত দিন যাচ্ছে, মানুষের নিয়মরীতি মানা কমে যাচ্ছে। প্রশাসনও নজরদারি শ্লথ করে দিচ্ছে।

ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র লোকদের তালিকায় সমস্যা

পৃথিবীতে এর আগেও এমন অনেক সংকট এসেছে। কিন্তু মানুষ থেমে থাকেনি। কৌশল আর পরিকল্পনার মাধ্যমে এগিয়ে গেছে। এখন দরকার সততা ও দেশপ্রেমের পরীক্ষায় সবাইকে উত্তীর্ণ হয়ে এই সংকটকে রোধ করা। বিশ্বজনীন সংকট করোনাভাইরাসের দাপটে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে সারা পৃথিবীর অর্থনীতি। কর্মহীন হয়ে পড়েছ অগণিত মানুষ। সচ্ছল অনেক পরিবারও আজ সংকটে পড়েছে। বাংলাদেশও এর বাইরে নেই। আশার কথা যে স্থানীয় প্রশাসন ইতিমধ্যে সহায়তা প্রয়োজন, এমন ব্যক্তিদের তালিকা প্রস্তুত করছে। তবে বিদ্যমান সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচির যে তালিকা, তাতে ত্রুটি লক্ষণীয়। অর্থাৎ যাঁদের সহায়তা দরকার নেই, এমন অনেকে তালিকায় রয়েছেন। আবার যাঁদের সহায়তার দরকার, তাঁরা তালিকায় নেই। তা ছাড়া শহরে বসবাসরত দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য এ-জাতীয় কোনো তালিকা নেই। সুতরাং, কোভিড-১৯-এর কারণে ক্ষতিগ্রস্ত দরিদ্র লোকদের তালিকা করার প্রক্রিয়াটি অবশ্যই যথাযথ ও পূর্ণাঙ্গ হতে হবে। সরকারের এই কার্যক্রমকে সার্থক করতে হলে দলমত-নির্বিশেষে সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। প্রস্তাবিত কর্মসূচি বাস্তবায়নে এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করা উচিত, যেখানে আর্থিকভাবে দুর্বল ও প্রান্তিক ব্যক্তিরা তাঁদের অন্তর্ভুক্তির জন্য নিজেরাই আবেদন করতে পারেন। কয়েকটি হটলাইন নম্বর বরাদ্দ করা উচিত, যাতে বাদ পড়া নাগরিকেরা সহায়তা কর্মসূচিতে অন্তর্ভুক্তির জন্য ফোন করে আবেদন করতে পারেন।

পিক টাইম মে মাস
বিশেষজ্ঞরা অবিরাম বলে চলেছেন, বাংলাদেশ এখনো করোনাভাইরাসের সংক্রমণের সর্বোচ্চ মাত্রায় পৌঁছায়নি; সেটা আমাদের সামনে রয়েছে। তাঁরা বলছেন, পুরো মে মাস আমাদের জন্য অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ সময়। কিন্তু লকডাউনের ব্যাপারে শিথিল বা গা-ছাড়া ভাব হলে এর নেতিবাচক প্রভাব হবে সুদূরপ্রসারী। প্রকৃতপক্ষে আমরা পূর্ণ মাত্রায় লকডাউনে ছিলাম কখন? তারপরও বলতে হয়, এখনো লকডাউন শিথিল করার উপযোগী সময়ে পৌঁছায়নি। পিক সময় বা সর্বোচ্চ মাত্রায় সংক্রমিত হওয়ার সময় পেরিয়ে যখন সংক্রমণ কমতে শুরু করবে, শুধু তখনই লকডাউন শিথিল করা এবং পর্যায়ক্রমে তুলে নেওয়ার কথা বিবেচনা করা যাবে।


বিদ্যমান অর্থনৈতিক বাস্তবতা আমরা অস্বীকার করি না। কিন্তু একই সঙ্গে করোনার প্রাণঘাতী ক্ষমতাও বিবেচনা করতে হবে। অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড যেমন জরুরি, তেমনই জরুরি স্বাস্থ্যগত সুরক্ষা। কেবল সতর্কতাই পারে এই দুইয়ের মধ্যে ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করতে। যেসব কারখানা খুলে রাখা হয়েছে, সেসবের কর্তৃপক্ষ যাতে স্বাস্থ্যবিধি মানে, তা নিশ্চিত করতে হবে; না মানলে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে। বিপণিবিতান ও শপিং মলের ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি মানা খুব জরুরি। স্বাস্থ্যবিধি রক্ষায় সরকার যথেষ্ট দক্ষতার পরিচয় দিতে পারেনি। মানুষের সচেতনতার ঘাটতিও রয়েছে।

এ কথা সত্য, অর্থনীতির চাকা গতিশীল রাখা দরকার। কিন্তু মহামারির মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয়কে অস্বীকার করে নয়। করোনা মহামারি মহাসংক্রামক ব্যাধি। একজন আক্রান্ত হওয়ার অর্থ একজন নন। একেকজনের মাধ্যমে আক্রান্তের সংখ্যা লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়বে। অনেক দেশের তুলনায় আমাদের দেশে সংক্রমণ ও মৃত্যুহার কম। কথাটি যে সঠিক নয়, তা ইতিমধ্যে বিশ্লেষণ প্রকাশিত হয়েছে, সংক্রমণের হার অনেক বেশি এ দেশে।