এই ক্রান্তিকালেও এই চুরি

পৃথিবীটা আজ বিপন্ন। অসহায় মানুষ। এসব সবার জানা কথা। যে বিষয়ে লিখছি, সেটাও সবার জানা কথা। এই অসময়ে এ দেশের কিছু মানুষের চুরির গল্প। সবকিছু সবার জানা, তবু এসব চলছে একটানা। নেই কোনো গতিরোধ, আজ তাঁরা হারিয়ে ফেলেছেন মানবতাবোধ।

করোনাভাইরাসের ভয়াল মহামারিতে গোটা বিশ্ব আক্রান্ত। অদৃশ্য এই প্রাণঘাতী ভাইরাস মোকাবিলায় অসহায় আত্মসমর্পণ করেছে বিশ্ববাসী। এই ক্রান্তিকালে জরুরি ভিত্তিতে নাগরিকদের জন্য বিভিন্ন ধরনের সাহায্য-সহযোগিতার ব্যবস্থা নিচ্ছে সরকার। আর এই সুযোগে সক্রিয় হয়ে উঠেছে দুর্নীতিবাজ ও মধ্যস্বত্বভোগীরা। তাদের কারণে করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলায় সরকারের গৃহীত পদক্ষেপ বাধাগ্রস্ত ও সমালোচনার শিকার হচ্ছে। সেই সঙ্গে মূল সমস্যা সমাধানে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে দেশের বিদ্যমান সমাজকাঠামো।

সব দেশেই করোনা পরিস্থিতিতে, বিশেষ করে প্রয়োজনীয় খাদ্যসামগ্রীর জোগান দিতে হচ্ছে জরুরি ভিত্তিতে। ফলে সাধারণ নিয়ম থেকে বেরিয়ে নির্দিষ্ট ব্যক্তিদের ওই সব মাল সরবরাহের সুযোগ ও অর্ডার দেওয়া হচ্ছে। এখানে সুযোগ নিচ্ছে দুর্নীতিবাজ ও মধ্যস্বত্বভোগীরা। দুর্নীতির মাধ্যমে জনগণের কষ্টার্জিত অর্থ পকেটে ভরছে তারা। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সংবাদমাধ্যম ‘দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট’ বাংলাদেশসহ কয়েকটি দেশের করোনা মোকাবিলার ক্ষেত্রে দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে সংবাদ প্রকাশ করেছে। ‘দুর্নীতির মহামারি...’ শিরোনামে এই প্রতিবেদনের মধ্যে আছে বাংলাদেশ, রোমানিয়া, আর্জেন্টিনা, কলম্বিয়ার কথা। প্রতিবেদনে বাংলাদেশের চাল কেলেঙ্কারি পরিস্থিতি তুলে ধরা হয়েছে। বলা হয়েছে, কোভিড-১৯ প্রতিরোধে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশেও লকডাউন চলছে। লকডাউনের ফলে কর্মহীন মানুষ ক্ষতির মুখে পড়েছেন। লকডাউনে ঘরে আটকা পড়া মানুষজনের জন্য খাদ্যসহায়তা কর্মসূচি চালু করেছে বাংলাদেশ সরকার। সবচেয়ে ঝুঁকিতে থাকা মানুষজনের জন্য ওই খাদ্যসহায়তা কর্মসূচি হাতে নেওয়া হলেও ৬ লাখ পাউন্ড বা ৬ কোটি ৩০ লাখ টাকার (২ লাখ ৭২ হাজার কেজি) চালের হদিস পাওয়া যাচ্ছে না। প্রায় ৪০ জন স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও কয়েকজন আমলার বিরুদ্ধে ত্রাণের চাল আত্মসাতের অভিযোগ পাওয়া গেছে। তাঁদের বিরুদ্ধে রয়েছে বেশি দামে পুনরায় চাল বিক্রির অভিযোগ। ফলে সরকার তাঁদের বাইপাস করে ত্রাণ পরিকল্পনা ঢেলে সাজিয়েছে। ইতিমধ্যে সরকারি চাল বাজারে বিক্রির অভিযোগে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের অন্তত ৫০ জনকে আটক করা হয়েছে। এর মধ্যে জনপ্রতিনিধিরাও রয়েছেন।

এই চুরির ফলে যাঁরা দিনমজুর রয়েছেন, তাঁদের কষ্টের সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছে। যাঁদের ত্রাণ প্রয়োজন, তাঁরা বঞ্চিত হচ্ছেন। বিভিন্ন গণমাধ্যমের খবরে বলা হয়েছে, বিভিন্ন বেসরকারি হিসাবে, রাজধানীতে কমপক্ষে লাখো দিনমজুর এখন তীব্র সংকটে আছেন খাদ্যের পর্যাপ্ত সহায়তার অভাবে।

বিশ্লেষকেরা বলছেন, ঘোষিত বরাদ্দ পাঁচ কোটির বেশি শ্রমজীবী মানুষের মধ্যে ভাগ করলে মাথাপিছু মাত্র ১৫০ টাকা করে পড়ে, যা তাঁদের জীবনধারণের জন্য অপ্রতুল।

উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, সরকারি ছুটি বা সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার নির্দেশনার কারণে ৭২ শতাংশ মানুষ কাজ হারিয়েছেন বা তাঁদের কাজ কমে গেছে। মাত্র ৮ শতাংশ মানুষের কাজ থাকলেও এখনো তাঁরা বেতন পাননি। এর মধ্যে ৬২ শতাংশ দিনমজুরের আয় শূন্যের কোঠায় নেমে এসেছে। ১৪ শতাংশ মানুষের ঘরে কোনো খাবারই নেই। ২৯ শতাংশের ঘরে আছে এক থেকে তিন দিনের খাবার।

একদিকে ঘরে খাবার নেই, অন্যদিকে চুরি। এই যখন পরিস্থিতি, তখন দেশ কোথায় গিয়ে দাঁড়াবে, সেটা নিয়েই শঙ্কিত দেশের মানুষ। সবাই যে চুরি করছে, তা কিন্তু নয়। আবার সবাই যে হৃদয় থেকে দান করছে, তাও কিন্তু নয়। যাহোক এ বিষয় নিয়ে অন্য একদিন আলোচনা করব। আজ এ বিষয়টি নিয়ে এগিয়ে যাই।

গত ৮ এপ্রিল বেশ কয়েকটি দৈনিকে পত্রিকার প্রতিবেদনে দেখলাম, ত্রাণ বিতরণের কথা বলে ডেকে নিয়ে ছবি তোলার পর সেই ত্রাণ কেড়ে নিয়েছেন হাটহাজারীর এক ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান। ৬ এপ্রিল দুপুরে হাটহাজারী উপজেলার মির্জাপুর ইউনিয়নে ত্রাণ বিতরণ করার জন্য ২৬ পরিবারকে ডেকে নেন হাটহাজারীর ৩ নম্বর মির্জাপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান নুরুল আবছার। পরে ২৬ জনকে ত্রাণ দিয়ে ছবি তুলে তাঁদের ত্রাণ কেড়ে নেন চেয়ারম্যান ও তাঁর লোকজন। এর প্রতিবাদ শুরু করলে তাঁদের মারধর করেছেন বলে অভিযোগ করেন তাঁরা। এই যখন একটি সভ্য স্বাধীন দেশের দৃশ্য, তখন মানবতা নামক শব্দটিকে প্রশ্ন করতে ইচ্ছা করে, তুমি কি বেঁচে আছ?

আসলেই বড্ড জানতে ইচ্ছা করে মানবতা বেঁচে আছে? থাকার কথা। না থাকলে হয়তো পৃথিবীতে গুটি কয়েক মানুষ বেঁচে থাকত। আর বাকি সবাই হারিয়ে যেত অমানুষদের পদতলে। তবে আফসোস হয়, যাদের মানুষের পাশে দাঁড়ানোর প্রয়োজন, তারা দাঁড়ায় না। আবার অবাক হই যাদের দাঁড়ানোর জন্য কেউ বলে না, তারা স্বেচ্ছায় মানুষের পাশে দাঁড়ায় এবং মানুষের উপকারে নিজের সবটুকু বিলিয়ে দেয়।

তবে কি পৃথিবীতে এই দুই প্রজাতির মানুষ থাকবেই? কিন্তু কেন? কেন এই পৃথিবী সুন্দর এবং সৎ মানুষের হতে পারে না। অমানুষদের হৃদয়ে কেন মনুষ্যত্ব সৃষ্টি হয় না। জানি এসব কেন–এর উত্তর পাওয়া সহজ নয়। তবু এই প্রশ্নগুলো প্রতিটি মানুষের কাছে ছুড়ে গেলাম। আর সেই সব চাল, তেল, ত্রাণচোরকে জানিয়ে গেলাম, পরের জীবন তোমার জন্য হবে একটি দুঃস্বপ্ন। যেখানে সীমাহীন কষ্ট অপেক্ষা করছে তোমার জন্য।

*লেখক: শিক্ষার্থী, হিসাববিজ্ঞান বিভাগ (তৃতীয় বর্ষ), ওমর গনি এমইএস কলেজ, চট্টগ্রাম।