সাধারণ এক মেয়ে বলছি

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

‘কাঁচের চুড়ি ভাঙার মতন মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে দুটো চারটে নিয়ম কানুন ভেঙে ফেলি’—সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সুখ্যাত কবি। কবিরা কখনো রাজনীতি, দুর্নীতি—এসবের কাছ দিয়েও ঘেঁষেন না। কবিদের কোনো দোষ লেখা হয় না। তাই কেবল কাচের চুড়ি নয়, কবিরা হৃদয়ও ভাঙেন অহরহ। 

তবে হ্যাঁ, আমি কবি নই, খুব সাধারণ এক মানবী। ভোরের ভিড়ঠেলা লোকাল বাসে শুরু হয় আমার রোজকার জীবন। মধ্যদুপুরে তপ্তরোদে ভ্যাপসা গরম উপেক্ষা করে ফেরা হয় ঘরে। রোজ রোজ চোখে পড়ে কত অনিয়ম–অনাচার।
অফিস টাইমে রোজ দেখি পাবলিক ট্রান্সপোর্টের দরজার মুখে উপচে পড়া ভিড়। নারী–পুরুষের তুমুল যুদ্ধ কর্মস্থলে পৌঁছাবার। ওই দেখে পিছিয়ে আসি। ভয় হয় যদি ওভাবে উঠতে গিয়ে হুমড়ি খেয়ে পড়ি। আরও ভয় হয় যদি অমন ভিড়ে শরীরে লাগে কোনো নোংরা লোকের স্পর্শ, আজকাল তো এসবই হচ্ছে হরহামেশা। তাই এড়িয়ে যাই। দাঁড়িয়ে থাকি পরের আসা বাসের অপেক্ষায়। এবারও একই চিত্র। আবারও অপেক্ষা। কানে আসে বাসে বসে থাকা যাত্রীদের উপেক্ষিত বাক্য, এই কনডাক্টর, মহিলা তুইলো না, সিট নাই। অথবা বাসচালকের সহকারী বলবে, ওস্তাদ, চালু করেন, মহিলা তুলুম না, খালি নাই। মনে মনে ভাবি, মহিলারা কি তবে অফিস যাবে না, কাজ করবে না? ততক্ষণে অফিসে দেরি হবার চিন্তায় বুকের ভেতর একধরনের চাপা উত্তেজনা কাজ করে।
দীর্ঘ অপেক্ষার পর একটা হালকা ভিড়ের বাসে চেপে বসি। কখনো কখনো পাশে বসা লোকটিকে বলি, ভাই, একটু সরে বসবেন? রগরগে চোখে উল্টো বলে বসে, আর কত সরব, আপনি চেপে বসুন প্রয়োজন হলে। নিজেকে সামলে নিই। আবারও বলি, একটু সরে বসুন, প্লিজ। তেড়ে উঠে বলেন, দেখেন, আপনি খুব বিরক্ত করছেন। এত অসুবিধা হলে পাবলিক বাসে কেন, নিজের গাড়ি কিনে চড়ুন। মেজাজ সামলে নিয়ে বলি, দেখুন, আপনার আগেও এখানে কিন্তু একজন পুরুষ মানুষই বসেছিলেন। দয়া করে সংযত হয়ে বসুন।
আশপাশ থেকে দু–চারজনের উচ্চ এবং কৌতূহলী কণ্ঠ ভেসে আসে। কী হয়েছে ম্যাডাম, এত চেঁচামেচি কিসের? কেউ কেউ বলেন, আরেহ ভাই, পাবলিক বাসে যাতায়াত করতে হলে একটু–আধটু অসুবিধা তো হবেই, এসব মেনে নিয়েই চলতে হবে ম্যাডাম। চোয়াল শক্ত করে উনাদের কথাগুলো হজম করি আর মনে মনে বলি, এসব অসভ্য লোকের সঙ্গে কথা বলে নিজেকে ওদের পর্যায়ে নামিয়ে কী লাভ? তবু সাপের মতো ফোঁস করি আর সুনীল বাবুর কবিতা বিড়বিড় করে আওড়াই,
‘কাঁচের চুড়ি ভাঙার মতন মাঝে মাঝেই ইচ্ছে করে দুটো চারটে নিয়ম কানুন ভেঙে ফেলি’।

কিন্তু কী করে ভাঙি বলুন, আমি তো কবি নই, লেখক নই, নই উচ্চমার্গীয় কোনো ব্লগার। আমি নিতান্তই এক সাধারণ মেয়ে।
সেই সাধারণ মেয়ে হয়ে একটা প্রশ্ন করতে চাই। কোভিড-১৯ তো সব থামিয়ে দিয়েছে। এখন আর অফিস যাবার তাড়া নেই, বাসের মুখে প্রচণ্ড ভিড় নেই, পাশে বসা মেয়েদের গায়ে ইচ্ছাকৃত স্পর্শও নেই, এমনকি নেই অফিসে লেট হবার মানসিক চাপ। আছে শুধু বেঁচে থাকবার তাড়না। আমার কথা, সেই সব মানুষ কি বেঁচে ওঠার বা বেঁচে যাওয়ার আনন্দ থেকে বদলে গিয়ে এক নতুন মানুষ হয়ে আবার রাস্তায় নামবে? নাকি আবারও বলবে, এই মহিলা তুইলো না, সিট নাই। নাকি আবারও অসভ্যতা করবে ওরা বাসের নারী যাত্রীদের সঙ্গে? পাশে নারী যাত্রীদের দাঁড়িয়ে থাকতে দেখেও দিব্যি আরামে বসে থাকবে। এতটুকু বিবেক কি জাগ্রত হবে না করোনাভাইরাসের এমন বীভৎসতা দেখেও? জন্ম নেবে কি মানবিকতা নতুন করে?
ঢাকা শহরে প্রায়ই কোনো না কোনো মিটিং–মিছিল–অবরোধ–আন্দোলন লেগেই থাকে। সেই দিনগুলোতে অফিস বাস ধরা প্রায় দুষ্কর। সিএনজিচালিত অটোরিকশা বা ট্যাক্সি ডাকতে হয় নিরুপায় হয়ে। যেমন ধরুন,
এই সিএনজি, ইকবাল রোড যাবেন?
জি আপা, যাব।
কত ভাড়া?
আড়াই শ টাকা দিয়েন।
কী বলেন, এত টাকা? আজ তো রাস্তা পুরো ফাঁকা। ২০ মিনিটও লাগবে না।
তাইলে আপা অন্য সিএনজি দেখেন।
কেন, মিটারে চলেন?
মিটারে যাইতে পারি, তয় ভাড়ার সঙ্গে ২০ টাকা বাড়ায়ে দেওন লাগবে।
আশ্চর্য! এদিকে অফিসে আজ জরুরি মিটিং। বাসও নেই। বাধ্য হয়ে সিএনজিতে উঠে বসি। ঠিক আছে, চলেন, ২০০ টাকা নিয়েন।
না আপা, ২২০ টাকার নিচে যামু না।
ঠিক আছে, চলুন। সময় আর পরিস্থিতির কাছে হেরে যাই। সিএনজিওয়ালার দাবি তাতেও মেটে না। বলে, আপা, ট্রাফিক ধরলে কইয়েন, মিটারে যাচ্ছেন।
এবার আর একটু আশ্চর্য হই। হালকা রেগে গিয়ে বলি, কেন ভাই, আমি ডাবল টাকা ভাড়া দিয়ে যাব, আবার আমিই মিথ্যা বলব? এ কোন নিয়ম, কোন আইন? তা ছাড়া সরকার তো আইন করেছে, মিটারে যেতে হবে। নিয়ম তো আপনি ভাঙছেন, তাহলে আমি কেন মিথ্যা বলব?
সিএনজিওয়ালা ডান পাশের লোহার গ্রিল দিয়ে ফিক করে পানের পিক ফেলে ঠোঁট বাকিয়ে হেসে বলে, আপা, সরকারের সব কথা শুনলে কি আমাগো পেট চলব? দিন শেষে মহাজনরে ১৫০০ টাকা জমা দেওয়া লাগে। রাস্তাঘাটে টাকা খাওয়ানের লাইগা আজাইরা মামলা দেয় ট্রাফিক আর আপনি কন ট্রাফিক পুলিশ ধরব। তারাই তো বড় চোর। আইন তো তারাই মানে না আইনের পোশাক পইরা।
আমি চুপ করে থাকি, তারপর বলি, কিন্তু আমি তো মিথ্যা বলি না; বরং সত্য বলা শেখাই। এটা আমার কাজ। সিএনজিওয়ালা বলেন, তাতে লাভ কী আপা? ‘তাতে লাভ কী’ কথাটা মাথায় আটকে যায়, আমি নিরুত্তর রয়ে যাই।
আজ যখন পৃথিবীব্যাপী করোনার মহামারি, তখন কেবলই মনে হচ্ছে এসব কি তবে অনিয়ম, মিথ্যাচার আর আইন ভাঙার অপরাধে প্রাপ্য সাজা? সরকারের সব কথা শুনলে পেট চলবে না বলেই কি আমরা লকডাউন অমান্য করে নিজেদের বিপদ নিজেরাই ডেকে আনছি? নাকি সরকার ব্যর্থ আমাদের নিরাপত্তা দিতে আমাদের খাদ্য সংকুলানে তাই পোশাক কারখানার মালিকেরা তাঁদের কর্মীদের নিয়ে এমন ছেলেখেলা করছেন? ভীষণ অসহায় বোধ হয়। উদাস দৃস্টিতে মেঘে ঢাকা আকাশের দিকে চেয়ে বলি,
‘ইচ্ছে করে অফিস যাবার নাম করে যাই বেলুড় মাঠে, ইচ্ছে করে ধর্মাধর্ম নিলাম করি মুর্গীহাটায়। বেলুন কিনি বেলুন ফাটাই, কাঁচের চুড়ি দেখলে ভাঙি...’
কিন্তু আমি ভীষণই সাধারণ এক মেয়ে। যেখানে ভাঙতে পারি না একরত্তি আইন সেখানে কী করে সমাজের ওপরতলার লোকেদের দিকে আঙুল তুলি? আমার বলা হয় না কিছুই।
তখনো দেশে করোনা আসেনি। স্বাভাবিক নিয়মেই চলছিল জীবন। কিন্তু সেই স্বাভাবিক জীবনেই রোজ রোজ খবরের কাগজে টিভি চ্যানেলে আসতে থাকে একই নিউজ। বাসের চাকায় পিষ্ট হয়ে পথচারীর মৃত্যু। রাস্তা পার হতে গিয়ে মাসহ স্কুলছাত্র নিহত। অথবা আরও হৃদয়বিদারক খবর হয়ে কাগজের প্রথম পাতায় আসে, দুই বাসের মাঝখানে আটকে কাটা পড়ল বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী ছাত্রের হাত। কিংবা কলেজ বাসের জন্য অপেক্ষায় ফুটপাতে দাঁড়ানো দুই বন্ধুর মর্মান্তিক মৃত্যু। টিভিতে সারা দিন ব্রেকিং নিউজ দেখানো হয়, ডাক্তার মেয়ে পাঠাও থেকে ছিটকে পড়ে নিহত। অথবা গভীর রাতে উবারচালককে গলা গেটে হত্যা। সড়ক দুর্ঘটনা, মৃত্যু হাত-পা কাটা পড়া যেন রোজকার নিয়মে পরিণত হয়ে গেল। বাসের চালক হেলপার সুপারভাইজার বেপরোয়া হয়ে দানবে পরিণত হতে লাগল। কোনো বাধাই তাদের রুখতে পারছিল না। বাসমালিক সড়ক পরিবহনমন্ত্রী থেকে শুরু করে সরকারের কোনো পক্ষই যেন পেরে উঠছিল না এসব নেশাগ্রস্ত অদক্ষ বেপরোয়া বাসচালকের সঙ্গে। প্রতিদিন সড়কে মহাসড়কে দুর্ঘটনায় অকালে ঝরে পড়ছিল তাজা প্রাণ। কোনো দায় কর্তৃপক্ষ তো নেয়ইনি, বরং নিজেদের অক্ষমতাটুকু স্বীকার করে সমর্পণ করেনি এসব সন্তানহারা স্বজনহারা পরিবারের কাছে। হয়তো সেসব জীবনের বিনিময়ে অনুদান হিসেবে প্রতিদান ঘোষণা করা হতো কয়েক লাখ টাকা। তারপর সময়ের ব্যবধানে সব মিলিয়ে যায় মেঘে ঢাকা তারার মতো। কিন্তু মানুষ নিশ্চুপ থাকলেও প্রকৃতি কখনো কখনো নীরবে প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। করোনাভাইরাস তবে কি তেমন এক প্রতিবাদ?

আচ্ছা, টাকার বিনিময়ে কি জীবন পাওয়া যায়! যে দেশে নিয়মনীতির বালাই পর্যন্ত নেই, সেই দেশে লকডাউনের নামে কানামাছি খেলা শুরু হয়েছে। আজব দেশ। ক্ষমতা, লোভ-লালসা—এসব আসলে কিছু মানুষকে পরিণত করেছে না–মানুষে।
আমি আবারও বলছি, খুব সাধারণ মেয়ে আমি। কত অনিয়মের জালে আটকা পড়ে আছি আমরা। কই পারছি না তো এতটুকু অনিয়মের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে? কোভিড–১৯ এসে সব অনিয়ম অনাচার মুহূর্তে ধুলোয় মিশিয়ে দিয়েছে যেন। হ্যাঁ, তার বিনিময়ে কেড়েও নিচ্ছে অনেক প্রাণ কিন্তু কারও হাত, কারও পা কাটা পড়ছে না তো! বাসের চিপায় আটকে থাকছে না তো কোনো টগবগে তরুণের কনুই অব্দি। রাস্তায় ছিটকে পড়ে নেই কোনো মাসুম শিশুর সদ্য বেড়ে ওঠা মগজ? সব থামিয়ে দিয়েছে কোভিড–১৯ আর পৃথিবীসুদ্ধ মানুষকে দাঁড় করিয়েছে এক কাতারে। এখন সড়ক দুর্ঘটনার নিউজ ব্রেকিং হয় না, ব্রেকিং হয় ২৪ ঘণ্টার নমুনা পরীক্ষার ফলাফল আর তার জন্য বেলা ২.৩০ বাজতেই চাতক পাখির মতো আমরা বসে থাকি টিভি সেটের সামনে। আহা, কী অলৌকিক এক পরিবর্তন নিমেষেই।
সত্যি, এপিজে আবদুল কালাম যথার্থই বলেছেন, ‘পরিস্থিতি যেকোনো সময় পরিবর্তন হতে পারে, জীবনে কাউকে কষ্ট দিয়ো না। আজ হয়তো তুমি শক্তিশালী, কিন্তু সময় তোমার থেকেও বেশি শক্তিশালী।’
এই যে অন্ধকার সময় আমরা পার করছি, তাতে মানসিক পরিবর্তন আদৌ আমাদের হবে কি, ভালো মানুষ হয়ে ফিরব কি? কেউ কি আমায় বলতে পারেন? জানি, পারবেন না। কারণ, সাধারণ মেয়েরা এসব প্রশ্নের জবাব আশাই করে না।
তবে সুনীল বাবুর কবিতার কথা আবারও মনে পড়ে যায় আর ঘেন্নায় গা রি রি করে বলতে ইচ্ছে করে,
‘পায়ের তলায় আছড়ে ফেলি মাথার মুকুট,
যাদের পায়ের তলায় আছি, তাদের মাথায় চড়ে বসি।’

যারা বলে, সমাজটা বদলে দেব, পরিবর্তনের হাওয়া লাগাব, তারা আসলে ভয়ংকর এক কারাগার আমাদের চারপাশে তৈরি করেছে। কেমন করে? তবে বলছি শুনুন।
এই তো করোনা আসবার কদিন আগেও দেশের সব খবরের কাগজে শিরোনাম হতো, ‘মাত্র দুই বছরের শিশুকে ধর্ষণের পর হত্যা করে ডোবায় ফেলে গেছে দুর্বৃত্তরা’। ‘ধর্ষণের পর কিশোরীর লাশ ঝুলিয়ে রাখা হয়েছে গাছের ডালে’। ‘বন্ধুরা মিলে তরুণী প্রেমিকাকে রাতভর গণধর্ষণ হোটেল কক্ষে’। ‘প্রেমিক প্রেমিকার লাশ উদ্ধার শহরের সস্তা এক হোটেল রুম থেকে, আশঙ্কা অতিরিক্ত যৌন উত্তেজক ওষুধ সেবন’। ‘রাতভর পাশবিক নির্যাতন করে এক শিশুকে হত্যা করে ফজরের নামাজ আদায় ইমামের’। ‘চলন্ত বাসে একা তরুণীকে ধর্ষণের পর লাশ জঙ্গলে ফেলে পালিয়েছে কয়েকজন দুর্বৃত্ত’। ‘পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রী হলের ট্রাংক থেকে নবজাতক উদ্ধার’। একের পর এক এমন হাজারো শিরোনাম ভোঁতা করে দেয় আমাদের মনুষ্য অনুভূতি।
এবার বলি নুসরাতের কথা। সারা দেশ জানে কী ঘটেছিল ওর সঙ্গে। কারা ঘটিয়েছিল অমন নৃশংস হত্যাকাণ্ড। কত কত নুসরাত এমন করে হারিয়ে যাচ্ছে প্রতিদিন এসব হায়েনার হিংস্রতায়।
আপনাদের নিশ্চয় তনুর কথাও মনে আছে। তনু হত্যার বিচার কবে হবে বা আদৌ হবে কি না, তা কি আমরা বলতে পারব? সত্যি, আমি থমকে যাই এত এত অন্যায়ের মাথা চাড়া দেখে।

প্রথম আলো ফাইল ছবি
প্রথম আলো ফাইল ছবি

আজও আমরা নারীরা জাগরণের গান গাই, মুক্তির কথা বলি, সভা–সেমিনারে উঁচু গলায় বক্তৃতা দিই, কিন্তু আদতে কি আমরা মুক্ত? আমাদের এ ঘুণেধরা সমাজ কি এখনো নারীদের জাগরণে বন্ধুর হাত বাড়ায়;বরং উল্টো বাঁকা চোখে তাকায়।
নইলে সর্বোচ্চ বিদ্যাপীঠ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানকার একজন শিক্ষার্থীকেও লাঞ্ছিত হতে হয় তার নিজেরই শহরে, নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের ব্যবহৃত গাড়িও যাকে নিরাপত্তা দিতে ব্যর্থ হয়। তাহলেও কি আমি বলতে পারি না যে আমি এক বর্বর সমাজ, অনিরাপদ দেশের নাগরিক। যে সমাজ যে দেশ নিরাপত্তা দিতে পারে না, সে দেশের ভবিষ্যৎ প্রজন্ম থেকে শুরু করে কিশোরী মেয়েটিকে অব্দি, সেই দেশ কী করে কোভিড–১৯–এর মতো ভয়াবহ ভাইরাসকে মোকাবিলা করবে, দেশের নাগরিকের সুস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে। আমার মতো অতি নগণ্য এক মেয়ের এসব ভাবনা তবে কি বৃথা?
আমরা এতটাই দারিদ্র্যের ভেতর দিয়ে যাই যে মাত্র এক মাস দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর দায়িত্ব নিতে পারি না। তাই যদি হতো, তাহলে দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে এভাবে করোনার সবচেয়ে ভয়াবহ মুহূর্তে পোশাক কারখানা খোলার সিদ্ধান্ত মালিকপক্ষ নিতে পারত না বা সরকারও সহমত পোষণ করত না। ইতিমধ্যে পরিবহনশ্রমিক ও ব্যবসায়ীরা সরকারের কাছে আবেদন করেছেন গণপরিবহন এবং দোকানপাট খুলের দেবার। সরকারও সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে । একদিকে সামনে পবিত্র ঈদুল ফিতর। সব মিলিয়ে এক কঠিন সময়। কিন্তু জীবনের চেয়ে মূল্যবান আর কিছু হতে পারে না। যেখানে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা বারবার বলছে, যে দেশ এখন লকডাউন খুলে দেবে, তাকেই চরম মূল্য দিতে হবে। জনগণকে এটা বুঝতে হবে। শুধু সাবান–পানি দিয়ে হাত পরিষ্কার করলেই হবে না, নিয়ম মেনে ঘরেও থাকতে হবে।
সরকারের কাছে জোর দাবি থাকবে, অনেক তো হলো। দেশের দরিদ্র লোকগুলোর দায়িত্ব নিন না আরও কিছুদিন। একবার চলে গেলে তো আর কেউ ফিরে আসে না, তাহলে কেন এই সিদ্ধান্তহীনতা। বরং আরও কঠোর, আরও দায়িত্বশীল হওয়া জরুরি, সেটাই আমরা আশা করি।

সুনীলবাবু লন্ডভন্ড করতে চেয়েছিল পৃথিবীটাকে, দাঁড়িয়ে কবির বলতে ইচ্ছে করেছিল, ‘আমার কিছু ভাল্লাগে না’।
ভালো আমাদের কারোরই লাগছে না জানি। আমরা সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচারের মূলমন্ত্রে বিশ্বাসী এক জাতি। আমরা জানি, এ আঁধার কেটে যাবে। ভোরের আলো আসবেই। তার জন্য সহযোগিতা, সহমর্মিতা; সর্বোপরি ধৈর্য অনিবার্য।