মা, তোমার মতো যেন হতে পারি

ছোটবেলায় মামার বাড়ির দুর্গাপূজায় যেতাম। পূজার কয় দিন বেশ আনন্দ করতাম। দুর্গাপ্রতিমায় ১০ হাতে বিভিন্ন রকমের অস্ত্র থাকত। তখন এর অর্থ বুঝতাম না। যখন বড় হয়ে একটু বোঝার চেষ্টা করলাম, দুর্গা প্রতীকী অর্থে একজন সংগ্রামী নারীকে বোঝাচ্ছে, যিনি কি না একাই ১০ হাতে সব দিক সামলাচ্ছেন। যা কি না দুই হাতে কখনোই সম্ভব নয়।

এই প্রতীকীর বাস্তব রূপের তো আমি চাক্ষুষ সাক্ষী। সে যে আমার মা। কীভাবে ভোরবেলা থেকে গভীর রাত অবধি একটানা পরিশ্রম করে সব দিক সামলিয়েছেন। তিনি কখন ঘুমাতেন, কখন জাগতেন বুঝতাম না। মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান নিম্নমধ্যবিত্তের ঘরে বউ হয়ে এলেন। এসেই জুতা পরিষ্কার থেকে চণ্ডীপাঠ—কোনোটাই বাদ পড়ল না।

বাবা বেসরকারি স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। সামান্য মাইনে দিয়ে ছয় সন্তানের ভরণপোষণসহ পড়ালেখা চালু রাখা, ঘরের কাজ, মাঠের কাজ কোনোটাই বাদ যায়নি। রান্নাঘর থেকে ধানখেত সব জায়গায় তিনি। আবার সন্তানের পড়ালেখায় তীক্ষ্ণ নজর। এর ফাঁকে নিয়মিত পত্রিকা পড়া, বিবিসির খবর শোনা, বিভিন্ন বই পড়া। সন্তানদের পাঠ্যসূচির বাইরেও যে আলাদা একটা জগৎ আছে তার সঙ্গে পরিচিত করানো, সর্বোপরি একজন সৎ ও আদর্শ মানুষ হিসেবে বড় করা।

ঈশ্বর প্রদত্ত সময়টাকে সর্বোচ্চ ব্যবহার করতেন মা। আমরা যখন বলি সময় পাই না, তখন চোখের সামনে মায়ের সেই সময়কার দিনগুলো ভেসে ওঠে। সত্যিকারের দশভুজা তো মা তুমিই। মায়ের কথা মনে পড়লেই আমি অনেক শক্তি ও সাহস পাই, কখনো ক্লান্ত–হতাশ হই না।

মা কখনো হারতে শেখাননি। তিনি একসময় দারিদ্র্যের সঙ্গে সন্তানদের শিক্ষিত করতে, শেষ সময়ে অসুস্থ স্বামীকে সুস্থ রাখতে অবিরাম যুদ্ধ করেছেন। সর্বশেষ গত ১৭ বছর দুরারোগ্য ক্যানসারের সঙ্গে যুদ্ধ করছেন। বারবার দেশে–বিদেশে ডাক্তারের ছুরি–কাঁচির নিচে নিজেকে সঁপে দিয়েছেন। কেমোথেরাপি, রেডিওথেরাপি নিয়েছেন। আমরা অসহায়ের মতো আর্তনাদ করেছি, কিন্তু তিনি এতটুকুও বিচলিত হননি, এমনকি হাসপাতালের বেডে শুয়ে খাদ্যনালির ক্যানসারের ঝুঁকিপূর্ণ অপারেশনের আগের দিন বিদেশ থেকে আমাকে দেশে পাঠিয়ে দিয়েছেন, আমার এফসিপিএস পরীক্ষা ছিল বলে, অন্যথায় তিনি অস্ত্রোপচার করাবেন না।

স্রষ্টার অপার মহিমায় আমি ওই পরীক্ষায় পাস করেছিলাম, যথাযথ প্রস্তুতি ছাড়াই শুধু মায়ের আশীর্বাদে আর মা সুস্থ হয়েছিলেন ঈশ্বরের কৃপায়। এক এক করে ছয় সন্তানকে মাস্টার্স পাস করিয়েছেন সীমিত আয় ও সম্পদের মধ্য দিয়ে।

আমি সহযোগী অধ্যাপক ও বিভাগীয় প্রধান (নাক, কান, গলা), বড় বোন হাইস্কুলের সহকারী প্রধান শিক্ষক, ছোট বোন কানাডাপ্রবাসী, অন্য ভাইয়েরা নিজস্ব ব্যবসায় নিজ নিজ স্থানে প্রতিষ্ঠিত। আমরা তোমার পরিশ্রমের যথার্থ মূল্য দিতে পারিনি। সবার কাছে তোমার পরিচয় কী, তা জানি না, তবে আমাদের কাছে তুমি দশভুজা গরবিনী মা। তুমি আমাদের আশ্রয়–প্রশ্রয়, স্বপ্ন, স্বস্তি ও প্রেরণা। শুধু এটুকুই প্রার্থনা, তোমার সততা, ন্যায়পরায়ণতা ও আদর্শের পতাকা যেন বাকি জীবন বইতে পারি।

*লেখক: সহযোগী অধ্যাপক (নাক, কান, গলা বিভাগ), সার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ। [email protected]