আমার মা, আমার পৃথিবী

পড়াশোনার জন্য বাসা ছেড়েছি ২০০৮ সালে। তখন পঞ্চম শ্রেণি পাস করেছি মাত্র। আব্বুর হাত ধরে বেরিয়ে আসা। প্রথম দিকে বেশ কষ্ট হতো। আম্মু ছাড়া বাড়ির বাইরে মানিয়ে নেওয়াটা বেশ কষ্টকর ছিল। তবুও আব্বু সঙ্গে থাকায় তিনি পুষিয়ে দিতেন বাকিটুকু।

প্রথম দিকে মাসে দু–তিনবার বাসায় যাওয়া হতো। সময় যত গড়াতে থাকে, সেই ব্যবধান ধীরে ধীরে বাড়তে থাকে। দেড় মাস, দুই মাস, তিন মাস, এমনকি পাঁচ মাসও হয় অনেক সময় বাসায় যাওয়া হয়নি।

প্রতিবার বাসায় গিয়ে আম্মুকে সালাম দেওয়াটা পৃথিবীর সবচেয়ে আনন্দের মুহূর্তের একটি। আর ছুটি শেষে বাসা থেকে ফেরার সময়টা বোধ হয় আমার জন্য পৃথিবীর সবচেয়ে কষ্টের একটি মুহূর্ত। ছুটি শেষে বাসা থেকে চলে আসার সময় পরিবারের সবার সঙ্গে আম্মুও অনেক পথ এগিয়ে দিতে আসেন। কিন্তু সে সময়ে আমি আম্মুর চোখে চোখ রাখতে পারি না। আম্মুর চোখ টলমল পানি দেখে নিজেকে ধরে রাখা অনেক কঠিন হয়ে যায়। নিজের বুকটাকে পাথরের মতো কঠিন করে সালাম দিয়ে বিদায় নিতে হয়। আম্মু যখন শেষ বিদায়ে কপালে চুমু খেয়ে মাথায় হাত বুলিয়ে দেন, সে সময় কেমনে যে নিজেকে সংযত রাখি, চোখের পানি কেমনে যে আটকে রাখি পরে ভেবে অবাক হই। চলে আসার পর এই মুহূর্তগুলো যখন মনে পড়ে, তখন অঝোরে চোখ দিয়ে পানি পড়ে। এই লেখা লেখার সময়ও অনবরত পানি পড়ছে চোখ দিয়ে।

২.
এইচএসসি পরীক্ষা শেষ। বিশ্ববিদ্যালয়ের ভর্তি পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে ভর্তি হয়েছিলাম একটি কোচিং সেন্টারে। দীর্ঘ চার মাসের ঘামঝরা পরিশ্রমে অবশেষে চান্স পেয়েও গেলাম চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। প্রতিদিন বিকেলে আম্মুর সঙ্গে কথা বলতাম ফোনে। কোনো দিন এমন হতো, চার-পাঁচ মিনিট কথা বলার জন্য কল দিয়ে আধা ঘণ্টাও কথা বলা হয়ে যেত বেখেয়ালে। পৃথিবীর এই একটা ফোন কল, যেটাতে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বললেও বিরক্তি আসে না কখনো। চান্স পেয়ে যাওয়ায় প্রজাপতির মতো মনটা সারাক্ষণ ওড়াউড়ি করতে থাকে। দীর্ঘ চার মাসের বন্দিদশা থেকে মুক্তি পেয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছি শহরজুড়ে। লেখালেখির অভ্যাস থাকায় ফ্রি এই সময়ে শহরের বিভিন্ন সাহিত্য আড্ডায় যাতায়াত বাড়তে থাকে।

সিলেটের কেন্দ্রীয় মুসলিম সাহিত্য সংসদের (কেমুসাস) সাহিত্য আড্ডায় তখন নিয়মিত যাতায়াত। এক সন্ধ্যায় সাহিত্য আড্ডা শেষ করে বাসায় ফিরি। বাসায় ফিরে খুব ক্লান্তি অনুভব হলো, মনে হলো কী একটি কাজ অপূর্ণ রয়ে গেছে। শোয়ার পরও সেই একটি অপূর্ণতা কাজ করে। অনেক চেষ্টার পরও ঘুম আসছে না। অনেকক্ষণ ভেবে অবশেষে অসুখটা ধরতে পারি। আজ আম্মুর সঙ্গে কথা বলা হয়নি। এই বড় কাজটা বাকি। তাড়াতাড়ি মুঠোফোনটা হাতে নিই। ঘড়ির কাঁটায় তখন রাত ১২টা ছুঁই ছুঁই। মুঠোফোন হাতে নিয়ে আম্মুকে কল দেব কি দেব না ভাবছি। অবশেষে কল দিয়েই দিলাম। দুবার রিং করার পর ঘুমজড়ানো চোখে ও পাশ থেকে আম্মুর কণ্ঠ। সালাম দিয়েই আবেগপ্রবণ হয়ে পড়ি। চোখ দিয়ে ঝরঝর করে পানি পড়ে। আম্মু বুঝে যান যে আমি কাঁদছি। প্রশ্ন করেন, আমি কাঁদছি কেন? এত রাতে কল দেওয়ায় উনাকে একটু বিচলিতই মনে হলো। নিজেকে অনেক কষ্টে সামলে নিয়ে বললাম, আরে না, আমি কাঁদছি না। এমনিই কল দিলাম। দিনে কথা বলিনি তাই আরকি। আসলে তখন আবার নতুন করে অনুভব করলাম আম্মুকে। প্রতিটি সন্তানের কাছেই তার মা বেশ প্রিয়। সত্যিই পৃথিবীতে অনেক খারাপ নারী থাকতে পারেন, কিন্তু একটাও খারাপ মা নেই। প্রতিটি সন্তানের কাছেই তার মা সর্বোচ্চ সম্মানের পাত্র। আমার আম্মু, আমার পৃথিবী।

*লেখক: শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়