আম্পান রুখতে প্রয়োজন আগাম জনসচেতনতা

ভৌগোলিক দিক বিবেচনায় বাংলাদেশ একটি দুর্যোগপ্রবণ দেশ। প্রতিবছর এ দেশে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হানা দেয়। এসব দুর্যোগের মধ্যে সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় অন্যতম।

সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে উপকূল অঞ্চলের অনেক মানুষের জীবন হারাতে হয়। অনেক মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়ে। আবারও সেই রকম একটা প্রাকৃতিক দুর্যোগের সামনে প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ। সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় ‘আম্পান’ বঙ্গোপসাগরে চোখ রাঙাচ্ছে।

আবহাওয়াবিদদের ভাষ্যমতে, ২০ মে নাগাদ অতি প্রবল রূপ নিয়ে খুলনা ও চট্টগ্রামের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ উপকূল অতিক্রম করতে পারে আম্পান। বাতাসের গতিবেগ তখন থাকবে ১৬০ কিলোমিটারের ওপরে। যেটাকে অতি প্রবল ঘূর্ণিঝড় বলে অভিহিত করে আবহাওয়া অধিদপ্তর থেকে সতর্কতা জারি করা হয়েছে। ইতিমধ্যে মোংলা ও পায়রা সমুদ্রবন্দরে ৭ নম্বর বিপৎসংকেত দেখাতে বলা হয়েছে। কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম সমুদ্রবন্দরে ৬ নম্বর বিপৎসংকেত দেখিয়ে যেতে বলা হয়েছে।

খুলনার উপকূলবর্তী এলাকায় জন্ম হওয়ায় ছোটবেলা থেকেই এসব সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে খুব ভালোভাবেই পরিচিত। এসব সংকেত আমাদের কাছে খুবই চেনাপরিচিত। খুব ছোটবেলায় ১৯৮৮ সালে এক প্রলয়ংকরী হারিকেন গতিসম্পন্ন ঘূর্ণিঝড় আমাদের বাড়িঘর তছনছ করে উড়িয়ে নিয়ে যায়। আমার বোন ও আমাকে কোলে নিয়ে আমার মা–বাবা সে সময় কোনোরকমে প্রতিবেশীর বাড়িতে গিয়ে আশ্রয় নিয়ে আমাদের আবার নতুন জীবন দান করেছিলেন। তারপর প্রায় প্রতিবছর ছোটখাটো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে লড়াই করে আমাদের বড় হতে হয়েছে। কিছু কিছু ঝড় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম, কক্সবাজারের উপকূলে আঘাত হেনে তার ভয়ংকর তাণ্ডব চালিয়েছে। তার মধ্যে ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঝড়টি অন্যতম। তার ভয়ংকর রূপ এখনো উপকূলের মানুষকে তাড়া করে ফেরে।

প্রায় প্রতিবছর এ রকম ছোট ও মাঝারি আকারের ঘূর্ণিঝড়ের কবলে পড়ে আমাদের উপকূলবর্তী এলাকার মানুষ। অনেক ঝড় আবার প্রবল বর্ষণের ফলে স্থলভাগে ওঠার আগেই গতিবেগ হারিয়ে দুর্বল হয়ে পড়ে। এ রকম একটা সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় ১৯৯৮ সালে উৎপন্ন হয়ে সেটা স্থলভাগে পৌঁছানোর আগেই অতিবর্ষণের ফলে গতি হারিয়ে দুর্বল হয়ে গিয়েছিল। আমার এখনো স্পষ্ট মনে আছে, সেবারও মোংলা সমুদ্রবন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপৎসংকেত দেখানো হয়েছিল।

তারপর স্মরণকালের মধ্যে ২০০৭ সালের সিডর ও ২০০৯ সালের সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড় আইলার কথা আমাদের সবারই জানা। তুলনামূলকভাবে সিডরের গতিবেগ (২২০ কিলোমিটার) আইলার গতিবেগের (১২০ কিলোমিটার) চেয়ে অনেক বেশি থাকলেও ক্ষয়ক্ষতির দিক দিয়ে আইলার ক্ষতির পরিমাণ অনেক বেশি ছিল। এর একটা কারণ হলো আইলার সময় সৃষ্টি হওয়া জলোচ্ছ্বাস। আইলা যখন উপকূল অঞ্চলে আঘাত হানে, তখন ভরা জোয়ারের সময়। এর ফলে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসে মানুষের ক্ষয়ক্ষতি, প্রাণহানি তুলনামূলক বেশি হয়েছিল। আইলার তাণ্ডব আমি নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করেছি। আইলা অনেক মানুষকে গৃহহীন করেছে আবার অনেক মানুষের মূল্যবান জীবন কেড়ে নিয়েছে। শুকিয়ে ফেটে কাঠ হওয়া নদী কয়েক ঘণ্টার মধ্যে আইলার প্রভাবে সৃষ্ট জলোচ্ছ্বাসের ফলে ভরা পানিতে টইটম্বুর হতে দেখেছি। তারপর কয়েক বছর ছোটখাটো অনেক ঝড় আমাদের ভালোই ভুগিয়েছে। মহাসেন, বিজলি এবং বুলবুল অন্যতম। আবার অনেক ঝড় গতি পরিবর্তন করে পার্শ্ববর্তী দেশগুলোতে আঘাত হেনেছে।

তবে একটা কথা না বললে নয়, সে হলো আমাদের পরম বন্ধু সুন্দরবন। প্রত্যেক ঘূর্ণিঝড়ের সময় বুক চিতিয়ে লড়ে যায় আমাদের দেশের আশীর্বাদ পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন। নিজের হাজারো ক্ষতি মেনে নিয়ে সে আমাদের মানবজাতির জন্য মহাবীরের বেশে যুদ্ধ করে যায় এসব সামুদ্রিক ঘূর্ণিঝড়ের সঙ্গে। তা ছাড়া আমাদের সরকারও উপকূলবাসীর জন্য অনেক আশ্রয়কেন্দ্র সাইক্লোন সেল্টার নির্মাণ করেছেন। সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ ও প্রচারণার কারণে আগের চেয়ে এখন ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ অনেক কমে এসেছে।

এবারও সরকারের পক্ষ থেকে ঘূর্ণিঝড় আম্পান মোকাবিলায় কার্যকরী অনেক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। আগামী মঙ্গলবার থেকে সবাইকে আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। কিন্তু এবারের পরিস্থিতি অন্য বছরগুলোর চেয়ে অনেক ভিন্ন। এই সময় দেশে করোনাভাইরাসের প্রকোপ চলছে। তাই সামাজিক দূরত্ব বজার রেখে আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করা বাস্তবিক পক্ষে কতটা সম্ভব, এটা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। আর একটা ব্যাপার যেটা আমি ছোটবেলা থেকে দেখে এসেছি, সেটা হলো মানুষের উদাসীনতা ও ঘরবাড়ির প্রতি টান। উপকূলবর্তী অনেক মানুষ বারবার আহ্বান করা সত্ত্বেও আপন ভিটামাটি ছেড়ে সহজে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে চান না। অনেকে একদম শেষ সময়ে যাওয়ার জন্য বের হন। তখন অনেক দেরি হয়ে যায়।

তাই এবার আর কাউকে সেই ভুল করলে চলবে না। সবাইকে সরকারি নির্দেশনা মোতাবেক ঘূর্ণিঝড় শুরুর আগেই নিরাপদ আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থান করা অতি জরুরি। যাওয়ার আগে শুকনা খাবার, পানি সঙ্গে নিয়ে যেতে হবে। গবাদিপশু থাকলে তাদেরও নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে যেতে হবে। সেটা সম্ভব না হলে তাদের দড়ি খুলে দিতে হবে। তবে করোনাভাইরাসের কারণে এবার আমাদের মানুষেরও বিশেষ সতর্কতা ও সচেতনতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। আমরা এটাও জানি, এবারও বুক চিতিয়ে শেষ বিন্দু দিয়ে হলেও আমাদের পক্ষে লড়বে অকৃত্রিম বন্ধু সুন্দরবন। তবু সরকারি নির্দেশনা মেনে আমাদের সবার সচেতনতাই পারে এই প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে আমাদের রক্ষা করতে।

*লেখক: ব্যাংকার