পদবির বেড়াজাল থেকে মুক্ত হব কবে

আমাদের অনেকের নামের সঙ্গে বিভিন্ন ধরনের পদবি যুক্ত থাকে। বংশপরম্পরায় চলে আসা নামের সঙ্গে পদবির ব্যবহার থেকে আমরা পারি না নিজেকে মুক্ত রাখতে। আমিও পারিনি একই বলয় ভেঙে বের হতে। আমার প্রয়াত পিতা পদবি ছাড়া ওনার নাম লিখতেন। তিনি বলতেন, পদবি জরুরি না, জরুরি হচ্ছে মানুষের শিক্ষা, কর্ম, আচার-আচরণ, চলাফেরা ও কথাবার্তার ধরনধারণ।

পদবি নিয়ে আমাদের অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি দেখে বাবা লিখেছিলেন ‘আভিজাত্যে সিলেটি সমাজ’ নামে একটি বই। তাঁর মতে, জাত–বংশের বড়াই খুবই স্বল্পমেয়াদি। সাম্য, ভ্রাতৃত্ব, মনুষ্যত্ব ও মানবতা সমাজের মৌলিক দর্শন। জাত–বংশ নয়, ব্যক্তি চরিত্রই মানুষকে অভিজাত করে তোলে।

ইতিহাসবিদদের মতে, বাঙালির নামের সঙ্গে পদবিগুলো মূলত সৃষ্টি হয়েছে বর্ণ, ধর্ম, গোত্র, পেশা ও অঞ্চলের ওপর ভিত্তি করে। কর্মগুণে পাওয়া কিছু খেতাবি পদবিও আছে। আবার হিন্দুদের যেমন আলাদা কিছু পদবি আছে, তেমনি মুসলমানদেরও আলাদা কিছু পদবি আছে। আবার ধর্মনিরপেক্ষ কিছু পদবি আছে, যা হিন্দু–মুসলমান সবার নামের সঙ্গেই যুক্ত দেখা যায়। একটি জিনিস এখানে লক্ষণীয় যে আমাদের পদবিগুলোর বেশির ভাগই এসেছে জমিজমাসংক্রান্ত ইতিহাস ঐতিহ্য থেকে। পদবিগুলোর আরেক বিরাট অংশজুড়ে রয়েছে পেশাভিত্তিক পদবি।

নামের সঙ্গে এসব পদবির ব্যবহার আসলেই কি জরুরি? বছর বছর ধরে আমরা এসব পদবিকে আভিজাত্যের বা অনভিজাত্যের মাপকাঠি হিসেবে বিবেচনা করে আসছি। জড়িয়ে পড়ছি অসুস্থ প্রতিযোগিতায়। পদবি ব্যবহারের এই রীতি আসলে মানুষে-মানুষে বৈষম্য, অহমিকা, হিংসা ও দূরত্ব রচনা ছাড়া আর কিছুই করছে না। হিন্দু-মুসলিম সব সম্প্রদায়ে এ সমস্যা রয়েছে। অথচ ইতিহাস ঘাঁটালে বা গভীরভাবে চিন্তা করলে মনে হবে আমাদের অনেকের পূর্বপুরুষ যিনি হয়তো তাঁর পেশা বা কর্মগুণে তার জন্য যে পদবি পেয়েছিলেন, সেটা বংশপরম্পরায় বয়ে নিয়ে য়াওয়া কি যৌক্তিক? এইগুলো কি মানুষকে মূল্যায়নের মাপকাঠি হওয়া উচিত? কর্মগুণে সফল মানুষের এসব পদবির কি খুব প্রয়োজন আছে? আচার–আচরণ আর কাজ দিয়ে যিনি মানুষকে মুগ্ধ করতে পারেন, তাঁর পদবি কি খুবই গুরুত্বপূর্ণ?

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের কাছে আমাদের নামের সঙ্গে পদবি ব্যবহারের বিষয়টি ভালো লাগেনি। তাই তিনি প্রস্তাব করেছিলেন ব্যক্তিগত নামটাকে রেখে আর সবকিছু বাদ দিতে। তিনি লিখেছিলেন, ‘ব্যাঙাচি পরিণত বয়সে যেমন ল্যাজ খসিয়ে দেয়, বাঙালির নামও যদি তেমনি পদবী বর্জন করে আমার মতে তাতে নামের গাম্ভীর্য বাড়ে বৈ কমে না।' ( নামের পদবী, ১৯৩১)।

প্রায় শত বছর আগে ‘আবদুল্লাহ’ নামের একটি উপন্যাস লিখেছিলেন কাজী ইমদাদুল হক। এই উপন্যাসে তৎকালীন মুসলিম সমাজের নানা দোষত্রুটি অতিশয় দক্ষতার সঙ্গে তিনি তুলে ধরেছিলেন। তাতেও ওই সময়ে সমাজে পদবির কারণে সৃষ্ট বৈষম্যের ক্ষতিকারক প্রভাবের কথা বাদ পড়েনি। বেসরকারি অফিসের এক উচ্চমাধ্যমিক পাস কেরানি বিয়ের জন্য পাত্রী খুঁজছিলেন। তিনি ছিলেন খন্দকার বংশের। জাত–বংশ মেলাতে গিয়ে পঞ্চাশের অধিক পাত্রী দেখার পরও কোনো সিদ্ধান্তে আসতে পারেননি। শেষমেশ উচ্চ বংশ–জাত নয়, কিন্তু এমএ পাস এ রকম এক পাত্রীর বাবা শুধু পাত্রের উচ্চবংশ বিবেচনা করে প্রস্তাব দিলেন। কিন্তু খন্দকার পদবিধারী কেরানি বাবুটি দাম্ভিকতার সঙ্গে বলে উঠলেন, ‘খুনকার (খন্দকারের আঞ্চলিক উচ্চারণ) বংশে প্রবেশ করতে হলে শুধু এমএ পাসই যথেষ্ট নয়।’

কিন্তু মজার ব্যাপার হলো তাঁরা কেউ নিজের নামের সঙ্গে পদবির ব্যবহার বাদ দিতে পারেননি। রবীন্দ্রনাথ নামের সাথে যে ‘ঠাকুর’ পদবি ব্যবহার করতেন, তা তাঁর পূর্বপুরুষ নীলমণি কুশারিকে দিয়েছিলেন কলকাতা বন্দরের শ্রমিকেরা। ব্যবসার প্রয়োজনে তিনি প্রায়ই কলকাতা বন্দরে যাতায়াত করতেন। তখন সেখানকার শ্রমিকেরা ব্রাহ্মণ নীলমণি কুশারীকে ‘ঠাকুর’ বলে ডাকতেন। ব্রিটিশরা দেশের ক্ষমতা অধিগ্রহণের পর ‘ঠাকুর’ তাদের পারিবারিক পদবীতে রূপান্তরিত হয়। (সোমেন দে, বাঙালি পদবীর সৃষ্টিমূল সন্ধান, ২০১৭) 

একইভাবে, কাজী ইমদাদুল হকের পদবি ‘কাজী’ও পারিবারিক সূত্রে পাওয়া। ওনার পিতার নাম ছিল কাজী আতাউল হক। তিনি আসামের জরিপ বিভাগে চাকরি করতে করতেন এবং পরে খুলনার ফৌজদারি আদালতের মোক্তার নিযুক্ত হন।

আধুনিক এই যুগে এসেও পদবির বেড়াজাল থেকে আমরা এখনো সম্পূর্ণ রূপে বের হতে পারিনি। এখন পদবির অপব্যবহার জাত–পাতের বলয় ভেঙে ভিন্ন রূপ ধারণ করেছে। এতেও অনেক সময় সৃষ্টি হচ্ছে জটিলতা ও বিভ্রান্তি। সাম্প্রতিক কালে এই রকম একটি কারণেই আমাদের মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ বেসরকারি, আধা-সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় ‘সচিব’ পদবি ব্যবহার বন্ধের নির্দেশ দিয়েছে। বিভাগের মতে, বিভিন্ন বেসরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থা বা প্রতিষ্ঠানে সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপসচিব ও সহকারী সচিবের ‘নিজস্ব’ পদ রয়েছে, যাঁরা ক্যাডার কর্মকর্তা নন। এসব পদ সরকারের সিনিয়র সচিব, সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব, উপসচিবের সমমর্যাদা ও সমতুল্য নয়। কিন্ত ওই সব কর্মকর্তা ও কর্মী ভিজিটিং কার্ড ছেপে বিতরণ করেন। অনেকে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মতো পরিচয় দিচ্ছেন। এতে পদবির অপব্যবহার ও জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি হচ্ছে। এ বিভ্রান্তি নিরসনের জন্যই ২০১৯ সালের ২৩ অক্টোবর ‘মন্ত্রণালয়/বিভাগে ব্যবহৃত সরকারের বিভিন্ন পদনাম ও পদবিসমূহের বিধিবহির্ভূত ব্যবহার’ শীর্ষক একটি পরিপত্র জারি করে উপরোক্ত নির্দেশনা দিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ।

পদবির ব্যবহার নিয়ে আমাদের দেশে সবচেয়ে বেশি বিভ্রান্তিতে আছেন মেয়েরা। বিয়ের আগে তাদের এক পদবি, বিয়ের পরে আরেক। পদবির এই বিভ্রান্তিতে পড়ে নারীরা তাদের নামের একটি অংশ বদলে ফেলছেন সাবলীলভাবে। অথচ আমাদের দেশে বিবাহিত স্ত্রীলোকের নামের সঙ্গে স্বামীর নাম পরিচয়যুক্ত করার প্রচলন অতীতে তেমন ছিল না। বরং আজকের আধুনিক বাংলাদেশে এ রীতি জনপ্রিয় হচ্ছে ধীরে ধীরে।

অবশ্য স্বামীর পদবি যে শুধু কেবল আমাদের দেশের নারীরা নিজেদের নামের সঙ্গে জুড়ে দিচ্ছেন তা কিন্তু নয়। অনেক দেশেই একই ঘটনা ঘটছে। অনেক বিখ্যাত মানুষের ক্ষেত্রেও এর উদাহরণ আছে। যেমন সাবেক মার্কিন ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটনের কথাই বলি। সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটনের সঙ্গে বিয়ের পর তাঁর নাম হিলারি ডিয়ান রডহাম থেকে বদলে হয়ে যায় হিলারি ক্লিনটন। যুক্তরাজ্যে স্বামীর পদবি নেওয়ার রীতি শুরু হয়েছিল পনেরো শতকের দিকে আর সতেরো শতকে এটির ব্যাপক প্রচলন শুরু হয়। জাপানে আবার নারীদের তাঁদের নামের পাশে স্বামীর পদবি যুক্ত করা বাধ্যতামূলক ১৮৯৮ সাল থেকে।

আমাদের দেশে নারীদের এই পদবি বদলের কারণে বিশেষ কোনো জটিলতা বা কোনো আইনি ঝামেলা পোহাতে হয়নি এত দিন। কিন্তু বছর দুয়েক আগে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের একটি সিদ্ধান্ত মেয়েদের নামের সঙ্গে স্বামীর পদবি ব্যবহার এর বিষয়টিকে এখন একটু জটিল করে তুলেছে। নির্বাচন কমিশন বলেছে, জাতীয় পরিচয়পত্রে নাম সংশোধনের জন্য চাইলেই নারীরা স্বামীর পদবি ব্যবহার করতে পারবেন না। শিক্ষাসনদ অনুযায়ী তাঁদের যে নাম, সেটাই জাতীয় পরিচয়পত্রে থাকবে। আর যাঁদের সনদ নেই, তাঁদের ক্ষেত্রে পিতা–মাতা যে নাম রেখেছেন, সেটি হবে। বিশেষ কোনো প্রয়োজনে কেউ নামের সঙ্গে স্বামীর নাম যুক্ত করতে চাইলে নির্বাচন কমিশনে প্রথমে আবেদন করতে হবে অনুমোদনের জন্য। কমিশন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে এ ব্যাপারে সিদ্ধান্ত দেবে।

আমাদের সমাজ ধীরে ধীরে বদলাচ্ছে। এখন আর নাপিতের ছেলে নাপিত হয় না, তাঁতির ছেলে তাঁতি হয় না। তাঁরাও এখন উপযুক্ত শিক্ষাদীক্ষা লাভ করে সম্মানজনক পেশায় প্রবেশ করছেন। নিজ মেধাগুণে আর অধ্যবসায়ের কারণে ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, সরকারি উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, শিক্ষক, ব্যবসাসহ আরও অনেক ধরনের পেশাতেই নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করছেন। আবার পদবিধারী অনেকেই নাপিতের পেশা বেছে নিচ্ছেন, যার আধুনিক নাম বিউটিশিয়ান কিংবা হেয়ার স্টাইলিস্ট। এখন ধোপার সন্তানদের একই পেশায় না থেকে বিসিএস অফিসার হতে যেমন বাধা নেই, তেমনি উচ্চবংশীয় বা পুত্র–কন্যাদের লন্ড্রি ইন্ডাস্ট্রিতে যুক্ত হলেও খারাপ ভাবার অবকাশ নেই। এভাবে যুগ যুগ ধরে সামাজিক মর্যাদা নির্ধারণের যে অঘোষিত রীতিনীতি আমরা তৈরি করেছিলাম সমাজে, তার কিছুটা করে পরিবর্তন হচ্ছে আজকাল। আর সেই সঙ্গে আধুনিক নতুন প্রজন্মকেও এসব জাত–পাত নিয়ে খুব বেশি উদ্বিগ্ন ও মনে হচ্ছে না। আশার কথা এটি।

মানুষের সৃষ্ট জাত ও পদবি একজন মানুষের সঙ্গে অন্য মানুষের অনেক দূরত্ব সৃষ্টি করেছে। একজন মানুষ তার কর্মগুণে স্বীকৃতি লাভ করুক, এটাই হোক নিয়ম। গর্ব, ধন, প্রভাব, প্রতিপত্তি, অর্জন এবং প্রতিষ্ঠা কিছুই যেন আমাদের অসংযত আর অসিহষ্ণু আচরণে অভ্যস্ত করে না তোলে। পদ, পদবি আর বংশগৌরব এসবের বেড়াজালে আবদ্ধ না হয়ে আমরা যেন সাম্যের এক সুন্দর সমাজ গড়ে তোলার চেষ্টা করি।


লেখক: বেসরকারি ব্যাংকে কর্মরত। [email protected]