করোনা বিরতি, সময় কীভাবে কাটছে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের

মহামারি করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে বিশ্বের চাকা নিয়ন্ত্রণহীন। ছোট্ট একটি ভাইরাসের কবলে পড়ে লাগাম হারিয়েছে গণমানুষের স্বাভাবিক জীবনযাপন। বাংলাদেশও এই দুর্যোগের বাইরে নয়। সাধারণ জীবনব্যবস্থা এখন হুমকির মুখে। এই অবস্থায় রাষ্ট্রের এমন কোনো খাত নেই যা আজ ক্ষতিগ্রস্ত নয়। অন্য সবকিছুর মতো শিক্ষাব্যবস্থাও অনেকটা ঝুঁকির মুখে। অঘোষিত লকডাউনের ফলে বাংলাদেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো কবে নাগাদ খুলবে, এখনো চূড়ান্ত কোনো সিদ্ধান্ত দেয়নি শিক্ষা মন্ত্রণালয়।


দীর্ঘ ছুটিতে অবসর সময়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা কি করছেন—এসব নিয়ে এবারের লেখা।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী শাহীন আলম বলেন, অতিরিক্ত কিছু মানেই নেতিবাচক একটি দিক থাকবে অবশ্যই। তেমনই অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে আনন্দ আজ ম্লান হয়ে অবসাদের বিরান ভূমিতে রূপ নিয়েছে। অবসর কাটাতে বাধ্য হয়েই অধিকাংশ সময় ব্যয় করা হচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়ার ভার্চ্যুয়াল জগতে। যার দরুন একটি ভার্চ্যুয়াল ভাইরাসের সংক্রমণ ঘটে যাচ্ছে বৈশ্বিক মহামারি করোনার মতোই। এ যেন ঠিক মরণ ঠেকাতে ইচ্ছাকৃত বিষপান। মানুষ স্বভাবজাত প্রাণী। হঠাৎ করেই এক দিনে তার কোনো অভ্যাস সে পরিবর্তন করতে পারে না। আর পারলেও মস্তিষ্কের ওপর প্রচণ্ড চাপের সঞ্চার হয়। তেমনই সাময়িক ছুটি আজ অফুরন্ত অবসরে রূপ নেওয়ার ফলে নিজের পরিচিত ক্লাস, পরীক্ষা, আড্ডা, গল্প ইত্যাদির ব্যস্ততা ছেড়ে চার দেয়ালের বন্দী জীবনে এখন নিজের কাছেই নিজেকে অসম্ভব বিরক্তিকর বলে মনে হয়। তা ছাড়া প্রতিটি পাবলিকিয়ানের কাছেই সেশনজট মোটামুটি কম আর বেশি পরিচিত একটি অভিশপ্ত শব্দ। আমাদের পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেই তবে সিজিপিএ তুলতে হয়। আর এই ভাবনা সর্বক্ষণই মাথায় উইপোকার মতো নাড়াচাড়া করে। তাই সৃষ্টিকর্তার কাছে এখন শুধু একটাই প্রার্থনা, নীরস অবসর কাটিয়ে যেন অতি দ্রুত ফিরতে পারি নিজের পরিচিত অঙ্গনে। যেন আবার ব্যস্ততার ফাঁকে ক্যাম্পাসের কোনো এক জায়গায় বসে মেতে উঠতে পারি বন্ধুত্বের আড্ডায়।

নাজমুল হোসেন পড়াশোনা করছেন রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। তিনি বলেন, দুই মাস ধরে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ছুটি কাটাচ্ছি। কথায় আছে মানুষ অভ্যাসের দাস। আর পাঁচ বছর ধরে, বছরের প্রায় পুরো সময়টুকুই বাড়ির বাইরে, শহরে থাকার অভ্যাস। ক্লাস, টিউশন এগুলোর কারণে একাডেমিক ক্যালেন্ডারের বড় বড় ছুটির বেশির ভাগ সময় বাড়ির বাইরেই কাটানো। হঠাৎ করে এই অনির্দিষ্টকালের ছুটিতে বাড়িতে এসে প্রথম প্রথম ভালো লাগলেও পরে একটু কেমনই যেন লাগছিল। যারা বাড়ির বাইরে থেকে পড়াশোনা করে, প্রায় সবারই পরিস্থিতি ঠিক এমনটাই। কিন্তু বিশ্ব আজ অসুস্থ, ঘরবন্দী হয়েই কাটাতে হবে পুরো ছুটি। ভাবলাম ছুটিকে কাজে লাগানো যাক। নতুন কিছু শেখা আমার কাছে নেশার মতো। তাই রোজ চেষ্টা করছি নতুন কিছু শেখার, জানার। বাসায় বসে বিশ্ব ইতিহাসকে কাছে থেকে জানারও উত্তম সময় এটা। সাধ্যমতো বই পড়ে আর ভিনদেশি ভাষা শিখে কাটিয়ে দিচ্ছি অনাকাঙ্ক্ষিত এই ছুটি।

জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী জারিন তাসনিম অর্নি। তিনি বলেন, অন্য দিনের সকালটা শুরু হতো সাড়ে ৬টায়, কিন্তু এখন সেটা কোনো রুটিনের মধ্যে ফেলা যায় না। না রাতে ঘুমানোর জন্য কোনো সময় বাধা আছে, না সকালে ওঠার জন্য। দীর্ঘ ৪৭ দিন প্রাণের শহর ঢাকাতে ঘরবন্দী থাকার পর নিজেকে অসুস্থ মস্তিষ্কের মনে হয়েছিল। কিন্তু নিজ জন্মভূমিতে ফেরার পর এবার নিজেকে নতুন করে আবিষ্কার করতে পারছি। আমার যৌথ পরিবার হওয়ায় সময়টা অনেক আনন্দে কাটছে। ছোট ভাইবোনদের নতুন নতুন রান্না করে খাওয়াই। চাচা–চাচি, চাচাতো ভাইবোন, সবাইকে নিয়ে ভালোই কাটছে সময়টা। মাঝেমধ্যে বাংলা সাহিত্যের অঙ্গনে উঁকি মারার সুযোগ বেড়েছে। বেশ কিছু গল্প–উপন্যাস পড়ে ফেলার সুযোগ হয়েছে। আমার মনে হয় এমন একটা সময় মানুষের জীবনে আসা উচিত, যেটা মানুষকে পরিবারকেন্দ্রিক হতে সহায়তা করে, কারণ সচরাচর আমরা পরিবারের সঙ্গে এত সময় কাটানোর সময়–সুযোগ কোনোটাই পাই না। নিজেকে উপলব্ধি করারও একটা সুযোগ পেয়েছি এই সময়টিতে, যেটা প্রত্যেক মানুষের জন্য অপরিহার্য।

ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের সোহান সিদ্দিকী বলেন, করোনাভাইরাসের আতঙ্কে ক্যাম্পাস বন্ধের পর থেকে দুই মাস যাবৎ ছুটিতে বাসায় আছি। তবে এবারের বন্ধে ছুটি কম, বন্দিত্ব বেশি। প্রতিবার এই সময়ে বাসায় এলে পুরোনো বন্ধুদের সঙ্গে আড্ডা, ঘোরাঘুরি, রমজানে ইফতার পার্টিসহ নানা কাজে মেতে থাকতাম আর এবার তার কিছুই হচ্ছে না। তবে অঘোষিত লকডাউনে এ সময় হেলায় নষ্ট না করে চেষ্টা করেছি নতুন কিছু শেখার। একুশে বইমেলায় কিছু বই কিনেছিলাম, সেগুলো সব একটা একটা করে শেষ করছি‌। এ ছাড়া অনলাইনে পছন্দের বিষয়ে কোর্স করছি। সোশ্যাল মিডিয়ায় ডুবে না থেকে বাসাতেই সময় দিচ্ছি পরিবারের সবাইকে। এভাবেই পার হচ্ছে দিন আর মাস, কারণ সে তো সময়, কারও জন্য থেমে থাকে না। আর অপেক্ষা করছি নতুন সূর্যোদয়ের, যখন সবকিছু আবার ঠিক হয়ে যাবে এবং ফিরে যেতে পারব প্রিয় ক্যাম্পাসে।

যশোর বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সজীবুর রহমান বলেন, প্রায় দুই মাস হতে যাচ্ছে বাসায় অনেকটা কয়েদিদের মতোই আটকে রয়েছি। লকডাউনের প্রতিটি মুহূর্তই যেন মনে করিয়ে দিচ্ছে বিশ্ববিদ্যালয় নামক পরিবারের প্রত্যেক সদস্যের কথা। এখন বাসায় বসে দিনের বেশির ভাগ সময় কাটে বিভিন্ন ইতিহাসের বই পড়ে আর লেখালেখির মাধ্যমে। বাকি সময়টা মুভি, গেমস ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের মধ্য দিয়েই কেটে যাচ্ছে। এই দুই মাস গৃহবন্দী থাকলেও নিজের সামাজিক দায়বদ্ধতা থেকে কাজ করে যাচ্ছি। নিজের সাধ্যমতো করোনায় অসহায় হয়ে পড়া মানুষদের সাহায্য করছি এবং এ বিষয়ে অন্যদেরও উদ্বুদ্ধ করছি। এ ছাড়া একজন সাংবাদিক হিসেবে বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীদের বিভিন্ন সমস্যা এবং করণীয় বিষয়গুলো নিজের লেখার মাধ্যমে তুলে ধরার চেষ্টা করছি। এভাবেই অতিবাহিত হচ্ছে আমার কোয়ারেন্টিনের সময়, যেখানে অন্যদের মতো নিজেকে ঘরের মধ্যে বন্দী রেখে পৃথিবীকে বাঁচানোর প্রচেষ্টায় আছি।


রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের আশিক ইসলাম বলেন, করোনাভাইরাসে পুরো পৃথিবী আজ স্তব্ধ। এর ভয়াবহতা থেকে দেশকে রক্ষার জন্য চলছে লকডাউন প্রক্রিয়া। মেনে চলতে হচ্ছে সামাজিক দূরত্ব। ফলে গ্রামের মানুষগুলো কর্মহীন হয়ে পড়েছে। একজন সচেতন নাগরিক হিসেবে কর্মহীন অসহায়, অসচ্ছল পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি। ফুলবাড়িয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার কর্তৃক গঠিত ইউনিয়ন পর্যায়ে করোনা সচেতনতায় স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করছি। ‘অগ্রগামী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন’–এর পক্ষ থেকে এলাকার বিত্তবান, চাকরিজীবীদের থেকে ফান্ড সংগ্রহ করে ৯৩টি অসহায়, অসচ্ছল পরিবারের কাছে রমজানের উপহারসামগ্রী পৌঁছে দিয়েছি। পরে বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের করা অভিযাত্রী স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন থেকে প্রাথমিক পর্যায়ে ইউনিয়নের ১০টি পরিবারের পাশে দাঁড়িয়েছি। পরে উপজেলা নির্বাহী অফিসারের সহযোগিতায় ২১টি শিশু ত্রাণ বিতরণ করেছি। ভবিষ্যতেও অসহায়, অসচ্ছল পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা অব্যাহত থাকবে ইনশা আল্লাহ। অবসর সময়টা নাটক, সিনেমা, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যয় করছি। প্রিয়জনকে সময় দিচ্ছি।