অবিভক্ত ভারতে ভৌগলিক ও প্রশাসনিক কারণে থানা ও মহকুমার আন্তঃসমন্বয় ঘটেছে বারবার। ডব্লিউ ডব্লিউ হান্টার কর্তৃক ১৮৭৭ সালে প্রকাশিত 'অ্যা স্ট্যাটিস্টিক্যাল একাউন্ট অফ বেঙ্গল (ভলিউম-৫)' পর্যালোচনায় দেখা যায়, ফরিদপুর সদর ও গোয়ালন্দ মহকুমা দুটির সমন্বয়ে ছিল ফরিদপুর জেলা এবং গোয়ালন্দ, বেলগাছি ও পাংশা এই তিনটি থানার সমন্বয়ে ছিল গোয়ালন্দ মহকুমা (সাব-ডিভিশন)।
১৯২৩ সালে প্রকাশিত বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার (ফরিদপুর) অনুসন্ধানে দেখা যায়, ফরিদপুর সদর, গোয়ালন্দ, গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুর—এই চারটি মহকুমার (সাব-ডিভিশন) সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে ফরিদপুর জেলা। আর গোয়ালন্দ ঘাট, পাংশা, বালিয়াকান্দি ও গোয়ালন্দ—এই চারটি থানার (উপজেলা) সমন্বয়ে গঠিত হয়েছে গোয়ালন্দ মহকুমা (সাব-ডিভিশন)। গোয়ালন্দ মহকুমার সর্বমোট আয়তন ছিল তখন ৪৪৩ বর্গ মাইল এবং জনসংখ্যা ৩,২৮,২১৯ জন। আর গোয়ালন্দ ঘাটের আয়তন তখন ৫০ বর্গমাইল এবং জনসংখ্যা ৪৩,২৮৬ জন। মহকুমা সদর দপ্তর ছিল গোয়ালন্দ থানা।
বিদ্যমান প্রশাসনিক কাঠামো অনুযায়ী ব্রিটিশ আমলে কয়েকটি থানা নিয়ে একটি মহকুমা গঠিত হত এবং কয়েকটি মহকুমা নিয়ে একটি জেলা গঠিত হত। মহকুমা হিসেবে গোয়ালন্দের মর্যাদা লাভ ১৮৭১ সালে। কলকাতা হতে যে প্রধান লাইনটি গোয়ালন্দ ঘাটে এসে শেষ হয় তা ছিল পদ্মা নদীর টার্মিনাল স্টেশন। তবে এটি কখনই স্থায়ী ঘাট হিসেবে গণ্য হয়নি। কেননা নদীর গতিপথ পরিবর্তনের কারণে প্রায়ই ঘাট পরিবর্তন করতে হত। উদ্বোধনের প্রায় ৩০ বছরের মধ্যে ১০ বার এর স্থান পরিবর্তন করতে হয়। ১৯১৩ সালে প্রকাশিত 'ফ্রম দ্যা হুগলী টু দ্য হিমালয়েজ' হতে জানা যায়, 'ফরমারলি গোয়ালন্দ ওয়াজ সিচুয়েটেড এক্সেক্টলি অ্যাট দ্য জাংশন অফ দ্য রিভার্স পদ্মা এন্ড ব্রম্মপুত্র, এন্ড লার্জ সামস ওয়্যার স্প্যান্ট ইন প্রটেক্টিং দ্য সাইট ফ্রম ইরোসন; বাট ইন এইটিন সেভেন্টিফাইভ দ্য স্পার ওয়াজ ওয়াসড অ্যাওয়ে, এন্ড সিন্স দ্যাট ডেইট দ্য টার্মিনাস হ্যাজ কন্সটেন্টলি বীন অন দ্য মোভ, উইথ দ্য রেজাল্ট দ্যাট ইট ইজ নাও টু বি ফাউন্ড এবাউট সেভেন মাইলস সাউথ অফ ইটস ফরমার পজিশন। দিস বিং দ্য কেইস দেয়ার আর নো পার্মানেন্ট ল্যান্ডিং স্টেইজেস'। ঘাটের ভাঙ্গন এবং ঘাট রাজবাড়ি শহরের অদূরে অবস্থিত হওয়ায় রেলের সকল স্থাপনা রাজবাড়িতে গড়ে উঠে। গোয়ালন্দ মহকুমা ও থানার প্রশাসনিক কাজ সম্পাদিত হত রাজবাড়ি থেকে।
কালের পরিক্রমায় একদিকে পলি জমে সংকুচিত হয়েছে নদীপথ, অন্যদিকে বিস্তৃত হয়েছে রেলের নেটওয়ার্ক। ইস্টার্ণ বেঙ্গল রেলওয়ে এবং আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের পাশাপাশি এগুলোকে সংযুক্ত করে গড়ে ওঠে ঢাকা-ময়মনসিংহ স্টেট রেলওয়ে, বেঙ্গল সেন্ট্রাল রেলওয়ে, নর্দার্ন বেঙ্গল স্টেট রেলওয়ে, বেঙ্গল ডুয়ার্স রেলওয়ে কোম্পানী। শিয়ালদহ থেকে চট্টগ্রাম মেইল ছাড়ত সকালবেলায়। কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের লোকেরা সাধারণত চট্টগ্রাম মেইলে যাতায়াত করতেন। অনেকে চাঁদপুর থেকে আবার আসাম মেইল ধরতেন।
কমরেড মুজফফর আহমদ এর লেখা 'কাজী নজরুল ইসলামঃ স্মৃতিকথা' তে ঢাকা মেইলের বর্ণনা মিলে। তিনি উল্লেখ করেছেন-'১৯২১ সালে রেলওয়ে ও স্টীমারের ভাড়া অত্যন্ত কম ছিল। তাছাড়া আমরা থার্ড ক্লাসের হিসাব করছিলাম। কলকাতা হতে আমি রাত্রের ঢাকা মেইলে রওয়ানা হয়েছিলেম। কারণ সকালের চাটগাঁ মেইলে গেলে চালু স্টীমারখানা পাওয়া যেত না।' পশ্চিমবঙ্গ সরকারের নিয়ন্ত্রণাধীন 'ঢাকা মেইল' এর বগিগুলো ছিল লাল রঙের। নারায়নগঞ্জ থেকে মেইল স্টিমার ভোর ছয়টা-সাড়ে ছয়টার মধ্যে গোয়ালন্দে পৌঁছে যেত। স্টিমারের যাত্রী এবং মাছের বগি নিয়ে সকাল সাতটায় ঢাকা মেইল গোয়ালন্দ থেকে শিয়ালদহের উদ্দেশ্য ছেড়ে যেত। দর্শনায় কাষ্টম চেকিং হত। শিয়ালদহ স্টেশন পৌঁছে যেত দুপুর দেড়টা-দুটোর মধ্যেই। আবার শিয়ালদহ থেকে ছেড়ে আসা ঢাকা মেইলটি গোয়ালন্দ এসে পৌঁছাত রাত নয়টার মধ্যে। পূর্ব পাকিস্তান রেলওয়ের বগিগুলো ছিল সবুজ রঙের। বগিগুলোর গায়ে লেখা থাকত ইবিআর।
১৯৬১ সালের ১ ফেব্রুয়ারি হতে লেখা হত ইস্ট পাকিস্তান রেলওয়ে (ইপিআর)। বগিগুলো ছিল চার শ্রেণীর। ফার্স্ট ক্লাশ, সেকেন্ড ক্লাশ, ইন্টার ক্লাশ এবং থার্ড ক্লাশ। শুধু নারীদের বসার জন্য ভিন্ন বগির ব্যবস্থা ছিল। সেখানে উর্দুতে লেখা থাকত 'জেনানা'। ইন্টার এবং থার্ড ক্লাশের বগিতে চার সারিতে বসার বেঞ্চ থাকত। দুই দিকে জানালার পাশে দুই সারি এবং মাঝখানে পিঠাপিঠি দুই সারি। সব বগি সমান আকারের হত না। কোন কোন বগি আকারে বড় হত। বগির ভেতরে '৪০ জন বসিবেক', '২৮ জন বসিবেক', এরূপ সব নির্দেশনা থাকত।
'দুই দশকের গোয়ালন্দ' শীর্ষক নিবন্ধে ভারত ভাগ পরবর্তী সময়ের কথা বলতে গিয়ে জালাল মিঞা এভাবেই স্মৃতিচারণ করেছেন। ব্রিটিশ ভারতে গোয়ালন্দ ছিল ইউরোপীয় মানের প্রথম শ্রেণীর রেল স্টেশন। বাঙালি তো নয়ই, এমনকি কোন ভারতীয়কেও স্টেশন মাস্টারের দায়িত্ব দেওয়া হয়নি। ভারত ভাগের আগ পর্যন্ত মাস্টারের দায়িত্বে বরাবরই ছিলেন একজন ইংরেজ। ১৯৬৫ সাল পর্যন্ত ইস্ট বেঙ্গল এক্সপ্রেস নামের ট্রেনটি শিয়ালদহ হতে গেদে-দর্শনা হয়ে গোয়ালন্দ ঘাট পর্যন্ত চলাচল করত। ফিরত আবার একই পথে। আর বরিশাল এক্সপ্রেস শিয়ালদহ হতে পেট্টোপোল-বেনাপোল হয়ে খুলনা পৌঁছাত এবং সেখান থেকে পুনরায় শিয়ালদহ ফিরে আসত। আসাম মেইলের আসা যাওয়া ছিল সান্তাহার থেকে গৌহাটি পর্যন্ত। দার্জিলিং মেইল শিয়ালদহ-রানাঘাট-হার্ডিঞ্জব্রীজ-ঈশ্বরদী-সান্তাহার-পার্বতীপুর-হলদিবাড়ি-জলপাইগুড়ি-শিলিগুড়ি পথে আসা-যাওয়া করতো। কত বিস্তৃত ছিল সেকালের রেলের সীমা! আজ চিন্তা করতেই হিমসিম খেতে হয়।
এতদঞ্চলে চলাচলরত বিশ শতকের চারটি প্যাডেল স্টিমার সচল আছে এখনো। বিআইডব্লিউটিসির তত্ত্বাবধানে রয়েছে এগুলো । স্কটিশ শিপবিল্ডের ওয়েবসাইট (ডব্লিউ.ডব্লিউ.ডব্লিউ.ক্লাইডেশিপস.সিও.ইউকে) হতে প্রাপ্ত তথ্য মোতাবেক দেখা যায়, 'টার্ণ' (১৯৪৯) ও 'অস্ট্রিচ' (১৯২৯) ছিল ইন্ডিয়া জেনারেল নেভিগেশন কোম্পানির। আর 'মাহসুদ' (১৯২৯) ও 'লেপচা' (১৯৩৭) ছিল রিভার্স স্টিম নেভিগেশন কোম্পানির। সবগুলো প্যাডেল স্টিমারই স্কটল্যান্ডের 'উইলিয়াম ড্যানি এন্ড ব্রাদার্স' শিপইয়ার্ডে প্রস্তুতকৃত। ১৯৫৯ সালে এগুলো পাকিস্তান রিভার স্টিমার্স লিমিটেডের মালিকানায় আসে। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে এগুলোর মালিকানা পায় বাংলাদেশ রিভার স্টির্মাস লিঃ এবং সর্বশেষ বিআইডব্লিউটিসি। 'অস্ট্রিচ' বাদে অন্য তিনটি স্টিমার বর্তমানে বিভিন্ন রুটে চলাচল করছে। প্যাডেল স্টিমার বিধায় এদের নামের আগে পিএস সংযুক্ত করে ডাকা হয় পিএস টার্ণ, পিএস অস্ট্রিচ, পিএস মাহসুদ ও পিএস ল্যাপচা। ইতিমধ্যে বিআইডব্লিউটিসি স্টিমার চারটিকে রাষ্ট্রীয় ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করেছে। 'অস্ট্রিচ' কে ২০১৯ সালে অ্যাকর্ট রিসোর্সেস নামের একটি প্রতিষ্ঠানের নিকট পাঁচ বছর মেয়াদে ইজারা দেয়া হয়েছে। প্যাডেল স্টীমারগুলো 'রকেট' নামেও পরিচিত। সময়ের আবর্তনে এগুলোকে স্টিম ইঞ্জিন থেকে ডিজেল ইঞ্জিনে রূপান্তর করা হয়েছে।
যেই পদ্মাকে ঘিরে গোয়ালন্দের এত অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিকাশ; কালের পরিক্রমায় প্রমত্ত পদ্মার সেই যৌবন আর নেই। ঢেউ আছড়ে পড়ে না স্টিমারের বাজুতে। পদ্মার এমন দশায় গোয়ালন্দের সেই নাম আর জৌলুসও নেই। ১৯৮৪ সালের ১ মার্চ সকল মহকুমাকে জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয়। কিন্তু গোয়ালন্দকে জেলা হিসেবে ঘোষণা না করে জেলা হিসেবে ঘোষণা করা হয় রাজবাড়িকে! আর গোয়ালন্দ পরিণত হয় রাজবাড়ি জেলার অন্তর্ভুক্ত একটি উপজেলায়! বর্তমানে রাজবাড়ি জেলার আওতাধীন পাঁচটি উপজেলার মধ্যে আয়তনের দিক থেকে গোয়ালন্দ ক্ষুদ্রতম (৪৭ বর্গমাইল)। শতাধিক বছরের খ্যাতি হারিয়েছে গোয়ালন্দ রেল স্টেশন। বন্ধ হয়ে গেছে গোয়ালন্দগামী বেশ কিছু রেল লাইন। গোয়ালন্দ এখন শুধুই এক সাধারণ রেল স্টেশন। ক্ষয়ে যাওয়া লাল ইটের ভবনগুলো কালের সাক্ষী হয়ে রয়ে গেছে। পাল্টে গেছে ইলিশ যাত্রার পথও। আগে গোয়ালন্দে অন্ধ মালগাড়ির যাত্রী হতো ইলিশ। আর এখন বেনাপোল কিংবা আগরতলার পথে ট্রাকের যাত্রী হয় ইলিশ। টিকেট কাটা ঘরের পরিত্যক্ত জানালা, টাকা রাখার লকার, ট্রেনকে সিগন্যাল দেয়ার জন্য লকারের ওপরে বসানো ল্যাম্প, অন্যান্য যাত্রীদের সাথে স্টিমারের ডেকে চাদর বিছিয়ে স্থান করে নেয়া, রাতের নদী, গোয়ালন্দ ঘাটে নেমে হুড়াহুড়ি করে ট্রেনে ওঠা—সবই এখন সোনালী অতীতের ধূসর স্মৃতি।
আরও পড়ুন