লকডাউনে বিরিশিরি ভ্রমণের স্মৃতিচারণা

নীল পানি ও চীনা মাটির পাহাড়। ছবি: লেখক
নীল পানি ও চীনা মাটির পাহাড়। ছবি: লেখক

‘ওহ! তোকে নিয়ে আর পারা গেল না, ক্লাসে তো প্রতিদিন লেট করিসই। আজও তোর জন্য ট্রেনটাও মিস করব। উঁচুনিচু নির্মল প্রকৃতি দেখে চোখ জুড়াব, প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাব, তা কী আর হবে...?’ কথাগুলো আমাকে বলা।

বেশ অনেক দিন হল বন্ধুরা মিলে কোথায় ঘুরতে যাওয়া হয় না। ক্লাস পরীক্ষা আর পড়াশোনার মাঝে জীবন অনেকটা একঘেয়েমি হয়ে যাচ্ছিল। তাই নয়ন ও ইব্রাহিমকে প্ল্যান করলাম মন ভালো রাখার জন্য ছোট পরিসরে হলেও একটু ঘুরতে যাওয়া দরকার। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী হওয়ায় কাছাকাছি স্থান হিসেবে নেত্রকোনার বিরিশিরিকে বেছে নেওয়া হলো।

১৬ ফেব্রুয়ারি ভোর সাড়ে চারটায় ইব্রাহিমের ফোনে ঘুম ভাঙল। সাড়ে পাঁচটার ট্রেন ধরে নেত্রকোনা যেতে হবে। একটা মজার বিষয় হলো ট্রেনে যাওয়া জন্য কোনো টাকা গুনতে হয় না।

সোমশ্বরী নদী থেকে তোলা হচ্ছে বালু। ছবি: লেখক
সোমশ্বরী নদী থেকে তোলা হচ্ছে বালু। ছবি: লেখক

ময়মনসিংহ রেলওয়ে স্টেশন থেকে যাত্রা শুরু, গন্তব্য নেত্রকোনা। ট্রেন থেকে নেমে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ধরে সোজা চলে আসলাম ক্ষুদ্র নৃ–গোষ্ঠী কালচারাল একাডেমি, বিরিশিরিতে। কালচারাল একাডেমি দেখে সত্যিই মুগ্ধ হয়ে গেলাম। এর পরের গন্তব্য দুর্গাপুর সীমান্তে। কিছুদূর পায়ে হাঁটা কাঁচা পথ, সামনে একটা বালুর চর আর মৃতপ্রায় নদী। আমি বললাম, এটা কি ব্রহ্মপুত্র? পাশ থেকে উত্তর এল, দোস্ত, তোর ভূগোলের জ্ঞান তো শূন্যের কোঠায়। এটা সোমেশ্বরী নদী। যার বুক চিরে বিকট শব্দে শত শত মেশিন তুলে আনছে বিপুল পরিমাণ বালু। এ যেন দেখার কেউ নেই। তারপরও সোমেশ্বরী নদীর তীরে কাশবন আর দূরের গারো পাহাড়ের সৌন্দর্য সবাইকে মুগ্ধ করবে।

সিএনজিচালিত অটোরিকশায় এগোতে থাকলাম দুর্গাপুর সীমান্তের দিকে। সামনে পড়ল সুউচ্চ টিলার ওপর দৃষ্টিনন্দন রানীখং গির্জা। এখানকার যিশুখ্রিষ্টের মূর্তিটি যে কারও দৃষ্টি কাড়বে। তারপর একটু সামনে এগিয়ে নৌকায় করে জিরো পয়েন্টের দিকে যাত্রা। একদিক কাচের মতো স্বচ্ছ জলরাশি, অন্যদিকে ভারতের মেঘালয়ের উঁচু উঁচু পাহাড়, সে এক অনিন্দ্যসুন্দর স্বর্গীয় অনুভূতি, যা লিখে প্রকাশ করা অসম্ভব। তারপর পাহাড়ে ওঠার পালা। পাহাড় টপকে ক্লান্ত শরীর নিয়ে গেলাম বিজয়পুরের বিখ্যাত চিনামাটির পাহাড়ের কাছে। দুচোখ ভরে দেখলাম পরতে পরতে সাজানো সৌন্দর্য।

বিরিশিরিতে লেখক ও তার বন্ধুরা। ছবি: সংগৃহীত
বিরিশিরিতে লেখক ও তার বন্ধুরা। ছবি: সংগৃহীত

শুধুকি চোখ আর মন ভরলে চলে? দেহ বলে তো কিছু একটা আছে। ক্লান্ত শরীর নিয়ে চিনামাটির পাহাড়ের পাদদেশের নীল পানিতে গা ভিজাতে কার না মন চায়। নীল পানিতে অবসাদ ঝেড়ে দিয়ে এবার ফেরার পালা।

সারা দিন প্রকৃতির মাঝে এতটাই বুঁদ হয়ে ছিলাম যে দুপুরের খাওয়ার কথা মনেই ছিল না। ও হ্যাঁ, দুর্গাপুর বাজারের নেত্রকোনার বিখ্যাত বালিশ মিষ্টির স্বাদ নিতে ভুল করবেন না। এবার ফেরার পালা, ট্রেনের সিটে শরীর এলিয়ে দিয়ে একরাশ পূর্ণ ভ্রমণতৃপ্তি নিয়ে, মনকে প্রফুল্ল করে আমাদের নীড়ে ফেরা।

ঘুরতে গিয়ে পানির বোতল, প্লাস্টিক সামগ্রী, ময়লা–আবর্জনা যেখানে–সেখানে না ফেলি, পরিবেশদূষণ না করি।

*লেখক: শিক্ষার্থী বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ময়মনসিংহ