অভূতপূর্ব ঈদ

এ এক বিশৃঙ্খল সময়। নজিরবিহীন সমস্যার এক অভূতপূর্ব ঈদ! যেখানে নতুন পোশাকের উচ্ছ্বাস নেই। কিশোরী-তরুণীদের হাতে রাঙা মেহেদির প্রলেপ নেই। পারলারে যাওয়ার শিডিউল নেই। চাঁদরাতে কারও টুকটাক কেনাকাটার প্রয়োজন নেই।

পাশের বাড়ির বিশ্ববিদ্যালয়পড়ুয়া তরুণটি এবার লাউডস্পিকারে বাজায়নি কাজী নজরুল ইসলামের অমর ঈদসংগীত। রাত জেগে সে বন্ধুদের সঙ্গে হইহুল্লোড় করেনি। বেসুরো গলায় গিটারের ঝংকার তোলেনি। চায়ের দোকানে মধ্যে রাত অব্দি বসে আড্ডা দেবারও কেউ ছিল না।

বাচ্চাদের নানাবাড়ি, দাদাবাড়ি যাওয়ার বায়না নেই। বুকে বুক, হৃদয়ে হৃদয় লাগিয়ে প্রিয়জনের সঙ্গে কোলাকুলি নেই। কোনো বিয়ে–শাদি নেই। নেই আত্মীয়স্বজনের বাড়িতে যাওয়ার আমন্ত্রণ। কাউকে আপ্যায়ন করার আয়োজনও নেই।

বাস, লঞ্চ এবং ট্রেনের টিকিটের জন্য লম্বা লাইন নেই। টিকিট কালোবাজারি নেই। নেই ট্রেনের ছাদে যাত্রী ওঠার উদ্দাম লড়াই। রাস্তায় পঞ্চাশ মাইল, এক শ মাইলের ট্রাফিক জ্যাম নেই। ট্রেনের শিডিউল বিপর্যয় নেই। এ নিয়ে কারও কোনো অভিযোগ নেই, রাগ নেই। আকাশে ওড়ার মহাপতঙ্গরাও নেই।

সে রকম বড় কোনো সড়ক দুর্ঘটনা নেই। লঞ্চডুবি নেই। ছিনতাইকারী, মলম পার্টির খপ্পরে পরে সর্বস্বান্ত হওয়ার ঘটনা নেই। ছুটি না পাওয়ার আক্ষেপ নেই। দোকানির বিক্রি নেই, মানুষের আয় নেই।

ছোট পর্দায় ঈদের অনুষ্ঠান নেই। দম ফাটানো হাসির ঈদ নাটক নেই। আনন্দমেলা নেই। বিদঘুটে সব রান্নার আয়োজন নেই। পার্কে ভিড় নেই। চটপটির দোকান নেই। রাস্তায় মানুষ নেই।

আমাদের বাঙালি মুসলিম সমাজব্যবস্থাটাই গড়ে উঠেছে এমন করে। শত বছর ধরে, জীবনকে মেলে ধরার জন্য আমরা ঈদকেই বেছে নিয়েছি। একটা বছর ধরে আমরা প্রিয়জনদের কাছে যাওয়ার জন্য অপেক্ষা করি। হাজারো সীমাবদ্ধতা, প্রতিকূলতা অতিক্রম করে ঈদে বাড়িতে যাই। কাঁচা মাটিতে সবুজ ঘাসের গন্ধে বুক ভরে নিশ্বাস নিই। সবার সঙ্গে দেখা–সাক্ষাৎ হয়। পারিবারিক নানা রকম অনুষ্ঠান হয়। বিভিন্ন সমস্যার সমাধান হয়। আবার জীবিকার টানে চলে যেতে হয় নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে। যুগ যুগ ধরে এ রকমই চলছে।

টোয়েন্টি টোয়েন্টির (২০২০) কালে ছন্দপতন হয়েছে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনের। জীবন-জীবিকার টানাপোড়েনে দিশেহারা সাধারণ মানুষ।

তবু সবকিছু ছাপিয়ে বেঁচে আছে আশা। সে আশায় বুক বেঁধেছি আমরা সবাই। একদিন এ আঁধার কেটে যাবে। নতুন প্রহরে ব্যাপক উত্সাহ–উদ্দীপনা নিয়ে উদযাপিত হবে চিরচেনা বাঙালির ঈদ।

এ যাত্রায় বেঁচে গেলে Roberts Browning–এর মতো করে একদিন বলব

How sad and bad and mad it was!

But then, how it was sweet!