পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের সম্ভাব্যতা

প্রতিটি প্রযুক্তির তিনটি গুরুত্বপূর্ণ দিক (aspect) থাকে। কারিগরি সম্ভাব্যতা (technical feasibility), অর্থনৈতিক সহজলভ্যতা (economic viability) এবং সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা (social acceptability।
উল্লেখ্য, হালের ব্রয়লার মুরগি বা দ্রুত বর্ধনশীল পাঙাশ মাছ প্রযুক্তির কথা, যেগুলো প্রাণিজ আমিষের চাহিদা অনেকাংশে পূরণ করে চলেছে। এই নতুন জাতগুলো কারিগরি সম্ভাব্যতা অর্জন করেছে। দেশীয় আবহাওয়ায় এগুলো চাষের উপযোগী ও দ্রুত বর্ধনশীল। পাশাপাশি ব্রয়লারের বাচ্চা ও মাছের ফিঙ্গারলিং এবং এদের খাদ্যও সহজপ্রাপ্য। কারিগরি সম্ভাব্যতার পাশাপাশি উপরিউক্ত প্রযুক্তিগুলো অর্থনৈতিকভাবেও সহজলভ্য। ভোক্তাদের কাছে এগুলোর দাম তুলনামূলক কম এবং উৎপাদন খরচ কম হওয়ায় উৎপাদকেরাও ভালো মুনাফা অর্জন করেন।
কিন্তু ব্রয়লার আর পাঙাশের সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা এখনো প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ, সমাজের বিভিন্ন মানুষের ক্রয়ক্ষমতা, রুচি ও পছন্দ ভিন্ন।
বাংলাদেশের সাম্প্রতিক প্রেক্ষাপটে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইনে শিক্ষা কার্যক্রম একটি নতুন প্রযুক্তি বা ধারণা। শুরুতেই চিন্তা করতে হবে এর কারিগরি সম্ভাব্যতা নিয়ে। উন্নত বিশ্বে কোর্স রেজিস্ট্রেশন থেকে ফল প্রকাশসহ প্রায় সবকিছুই অনলাইনে সম্পন্ন হয়। এর জন্য প্রতিটা প্রতিষ্ঠানের কেন্দ্রীয় সার্ভারের সঙ্গে মুডল (Moodle) অথবা অন্য যেকোনো ওয়েব সার্ভিসের সাহায্যে শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে সেতুবন্ধ রচিত হয়। সেখানে সব শিক্ষক যেমন অনলাইন সিস্টেম সম্পর্কে অবগত থাকেন, তেমনি শিক্ষার্থীদেরও অবগত থাকতে হয়।
মুডল সিস্টেমটি কেন্দ্রীয়ভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় এবং এর জন্য ২৪/৭ কারিগরি সহায়তার ব্যবস্থা থাকে যেন যেকোনো সমস্যায় তাৎক্ষণিক সমাধান মেলে। এরপর আসে লেকচার প্রস্তুত ও ডেলিভারি। ২৫ থেকে ৭৫ সব বয়সী শিক্ষককেই পাওয়ার পয়েন্ট লেকচার প্রস্তুতে দক্ষ হতে হয় এবং ক্লাসের আগেই লেকচারগুলো আপলোড করতে হয়। সংশ্লিষ্ট বিষয়ের পাঠ্যবইয়ের কপি লাইব্রেরিতে থাকতে হয়।
উপরন্তু অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রমের জন্য শিক্ষার্থীদের স্মার্টফোন থাকলে সেটা শুধু লেকচার দেখা বা শোনা এবং যোগাযোগের কাজে ব্যবহৃত হতে পারে। বাড়ির কাজ, অ্যাসাইনমেন্ট বা পরীক্ষার জন্য উপযোগী হবে না। তাই প্রত্যেক শিক্ষার্থীর ব্যক্তিগত কম্পিউটার বা ল্যাপটপ থাকতে হবে। কম্পিউটার বা ল্যাপটপের পাশাপাশি নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ এবং ইন্টারনেট সংযোগও থাকতে হবে।
এই প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে একজন শিক্ষকের স্বাধীনতা থাকে তিনি কীভাবে তাঁর কোর্সটি সাজাবেন। অনেক ক্ষেত্রে পরীক্ষা না নিয়েও শুধু ইন্টারঅ্যাকটিভ পদ্ধতিতে একজন শিক্ষক তাঁর কোর্সটি মূল্যায়ন করতে পারেন। কিন্তু আমাদের দেশে বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নির্দিষ্ট ছক অনুসরণ করে কোর্সটি সাজানো হয়। তথাপি যেসব কোর্সের সমসংখ্যক ব্যবহারিক কোর্স রয়েছে, যেগুলো হাতে-কলমে করতে হয়, সেগুলো অনলাইনে করানো সম্ভবপর নয়।
ধরে নিলাম আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনার জন্য সব ধরনের কারিগরি ও প্রযুক্তিগত ব্যবস্থা কেন্দ্রীয়ভাবে গ্রহণ করা হয়েছে। সব শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ইউনিক আইডি ও পাসওয়ার্ড সরবরাহ করা হয়েছে এবং যেকোনো জায়গা থেকে যার যার আইডিতে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি শিক্ষকেরাও প্রস্তুত—পাওয়ার পয়েন্ট লেকচার রেডি, সংশ্লিষ্ট বইয়ের পিডিএফ কপিও রয়েছে অথবা বইটি স্ক্যান করে সরবরাহ করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে। অর্থাৎ সব প্রতিষ্ঠান, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা অনলাইনে ক্লাস কার্যক্রম পরিচালনা ও অংশগ্রহণের জন্য কারিগরি সম্ভাব্যতা অর্জন করেছেন।
এরপর আসে দ্বিতীয় অ্যাসপেক্ট বা অর্থনৈতিক সহজলভ্যতা। ল্যাপটপ বা কম্পিউটার থাকার পাশাপাশি প্রতিজন শিক্ষার্থীর কাছে থাকতে হবে নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট পরিষেবা। আমাদের দেশীয় অপারেটররা যেখানে অফারভেদে এক গিগাবাইট ইন্টারনেট ডেটার দাম রাখেন ১০০-২০০ টাকা (এর কম-বেশি), সেখানে একজন শিক্ষার্থীকে যদি ১ ঘণ্টার একটি অডিও-ভিজ্যুয়াল ক্লাসে অংশ নেওয়ার জন্য আনুমানিক ১০০ টাকার ইন্টারনেট ডেটা খরচ করতে হয়, তাহলে একটি কোর্সের ৪২টি লেকচারের জন্য ৪ হাজার ২০০ টাকা এবং ৫টি কোর্সের জন্য এক সেমিস্টারে প্রায় ২১ হাজার (৪২০০*৫) টাকা খরচ করতে হবে। খরচ কমতেও পারে।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের অনেক শিক্ষার্থী নিম্ন বা নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসেন। তর্কের প্রয়োজনে ধরে নিলাম ৮০ শতাংশ শিক্ষার্থীই সচ্ছল পরিবারের। ইন্টারনেট পরিষেবা সুলভ না হওয়ার কারণে ২০ ভাগ শিক্ষার্থী যদি কোনো কোর্সেই সম্পূর্ণরূপে অংশ না নিতে পারেন, সেটা কোনোভাবেই বাস্তবসম্মত হবে না। সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকার ও বিটিসিএলকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিনা মূল্যে ইন্টারনেট সেবা বিতরণের ব্যবস্থা করতে হবে।
কারিগরি সম্ভাব্যতা ও অর্থনৈতিক সহজলভ্যতার পর আসে সামাজিক গ্রহণযোগ্যতা। বিভিন্ন দেশে নানা ধরনের চটকদার অনলাইন ডিগ্রির ব্যবস্থা রয়েছে এবং সেগুলো যথেষ্ট ইন্টারঅ্যাকটিভ ও ইনটেনসিভ। তবু সে ডিগ্রি নিয়মিত ডিগ্রির সমতুল্য হিসেবে বিবেচিত হলেও কখনোই সমান বলে বিবেচিত হয় না। আমাদের শিক্ষার্থীদের জন্য সমাজ হিসেবে ভূমিকা পালন করবেন চাকরির নিয়োগকর্তারা। তাঁরা কি শিক্ষার্থীদের অনলাইন ডিগ্রিকে যথাযথ মূল্যায়ন করবেন?
তাহলে করণীয় কী?
উপরিউক্ত বিষয়গুলো বিবেচনাপূর্বক যদি অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা সম্ভব হয়, তাহলে খুবই ভালো। ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের পথে আরও এক ধাপ এগিয়ে যাব। কিন্তু যদি সম্ভব না হয়, তাহলে বিকল্প হিসেবে প্রথমত পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ক্লাস-পরীক্ষা কার্যক্রম চালু করতে হবে। পাশাপাশি সাপ্তাহিক ছুটির দিনগুলোতেও অতিরিক্ত ক্লাস ও পরীক্ষা নিয়ে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে। উপরন্তু সেমিস্টার ফাইনাল পরীক্ষার প্রস্তুতিমূলক ছুটি বাতিল করে সময় সাশ্রয় করতে হবে। এতে হয়তো সম্পূর্ণ ক্ষতি পূরণ হবে না, তবু কিছুটা হলেও পূরণ করা সম্ভব হবে।
দ্বিতীয়ত, যদি কোনো কারণে নিকটবর্তী পিইসি, জেএসসি, এসএসসি ও এইচএসসি পরীক্ষাগুলো নেওয়া সম্ভব না হয়, তবে সিলেবাস শেষ না করে উপরিউক্ত পরীক্ষাগুলো নেওয়াও যুক্তিযুক্ত হবে না। আমাদের মনে রাখতে হবে, শেখার জন্য কোনো শর্টকাট বা সহজ পন্থা নেই। সে ক্ষেত্রে ২০২১ সেশনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা যাবে কি না, তা সময়ই বলে দেবে। যদি ২০২১ সেশনে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রছাত্রী ভর্তি করা না যায়, তাতে দুটি সম্ভাব্য উপকার পাওয়া যেতে পারে। এক. ইতিমধ্যে ভর্তি হয়ে যাঁরা সেশনজটে পড়েছেন, শিক্ষকেরা তাঁদের জন্য অতিরিক্ত সময় ব্যয় করতে পারবেন। দুই. শিক্ষার্থীরা প্রস্তুতিবিহীনভাবে এবং না শিখে পরবর্তী ক্লাসে/সেমিস্টারে প্রমোশন পাবেন না। পূর্ববর্তী সেমিস্টারের সঠিক প্রস্তুতি তাঁদের পরবর্তী সেমিস্টারের পথচলাকে সহজ করে তুলবে।
অনলাইন শিক্ষার মাধ্যমে শিক্ষাপ্রক্রিয়াকে এগিয়ে নেওয়া সম্ভব না হলে চাকরিতে আবেদনের বয়স পার হয়ে যাওয়ার ভয় থাকে। এরও সমাধান খুব সহজেই করা সম্ভব। সব ধরনের চাকরিতে আবেদন করার বয়সসীমা এবং অবসর গ্রহণের বয়সসীমা এক-দুই বছর বাড়িয়ে দিলেই হবে!
আমরা আশা করতে পারি, সরকারের নীতিনির্ধারণী মহল, শিক্ষা মন্ত্রণালয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন এই বিষয়গুলো শিক্ষাক্ষেত্রে চলমান সংকট থেকে উত্তরণের জন্য বিবেচনা করবে।

প্রিয় শিক্ষার্থীরা, পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে বিভিন্ন কারণে কিছু না কিছু সেশনজট থাকেই এবং তোমাদের জীবন থেকে মূল্যবান সময় ঝরে যায়। করোনা মহামারির কারণে তোমরা আরও পিছিয়ে পড়ছ এবং জীবন থেকে যে মূল্যবান সময় হারিয়ে যাচ্ছে, তার জন্য তোমাদের প্রতি আন্তরিক সমবেদনা। তবে ভেঙে পড়লে চলবে না। মনে রাখতে হবে, আঁধারের পরই আসে আলো। এটাই সময় নিজেকে এবং পরিবারকে খুব ভালো করে উপলব্ধি করার। মনে রাখতে হবে, পরিবারই প্রথম ও প্রধান, অন্য সবকিছুই গৌণ। আরও মনে রাখতে হবে, শিক্ষকেরা সব সময় তোমাদের পাশে রয়েছেন।
ব্যক্তিগতভাবে আমি নিজেও অনলাইন ক্লাস কার্যক্রম পরিচালনার জন্য প্রস্তুত। কিন্তু বৃহত্তর স্বার্থে আমাদের প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ। শুধু তাহলেই আমাদের উদ্দেশ্য পূরণ করতে পারব, সফল হব। বর্তমানে যাঁরা ব্যক্তি উদ্যোগে অনলাইন শিক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন, বিভিন্ন ওয়েবিনারে শিক্ষার্থীদের যুক্ত করছেন, বিভিন্ন অনলাইন প্রশিক্ষণের জন্য শিক্ষার্থীদের উৎসাহিত করছেন, তাঁদের আন্তরিক ধন্যবাদ ও সাধুবাদ। আপনাদের এই উদ্যোগ শিক্ষার্থীদের মনোবল চাঙা রাখবে, সাহস জোগাবে এবং তারা অনুভব করবে আমরা তাদের পাশে রয়েছি। সবশেষে আশা করছি, অচিরেই এই অবস্থা দূর হবে এবং সবার জন্য মঙ্গলময় একটি নতুন দিনের সূচনা হবে।
*লেখক: অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, হাজী মোহাম্মদ দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, দিনাজপুর। [email protected]