কোভিড-১৯ মোকাবিলা ও 'হাসি'

বিশ্বব্যাপী মহাদুর্যোগে যেখানে প্রতিদিন মানুষ হারাচ্ছে তার প্রিয়জনকে, সেখানে এ রকম একটা সিরিয়াস ব্যাপার নিয়ে ‘হাসি’! হ্যাঁ, না হেসে উপায় নেই, যত দিন না বিজ্ঞানীরা এ রোগের কোনো প্রতিকার করতে পারছেন। আর হাসবেন না কেন, যদি ‘লাফটার ইজ দ্য বেস্ট মেডিসিন’ এই বিখ্যাত প্রাচীন প্রবাদটা আজ সত্যি হয়। ‘হাসি’ কি সত্যিই করোনাভাইরাসকে মোকাবিলা করতে পারবে? এর উত্তর খুঁজে পেতে আগে জেনে নিতে হবে ‘হাসি’ আদৌ আমাদের কোনো উপকার করে কি না।

আর্থ্রাইটিস রোগের চিকিৎসায় হাসি
১৯৬৪ সালে ক্যালিফোর্নিয়ার স্ট্যানফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় ড. উইলিয়াম ফ্রে হাসির উপকারিতা আছে এমন দাবি করেন। ওই সময়ে ক্যালিফোর্নিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের স্কুল অব মেডিসিনের অধ্যাপক ড. নরমান কাজন এনকাইলুজিং স্পন্ডেলাইটিস (ankylosing spondylitis) নামক এক দুর্লভ ডিজেনারেটিভ আর্থ্রাইটিস নামক রোগে আক্রান্ত হন এবং হাসি থেরাপি নিজের ওপর প্রয়োগ করে সফল হন। তিনি ১৯৭৯ সালে প্রকাশিত ‘অ্যানাটমি অব ইলনেস’ নামক গ্রন্থে এ কথা উল্লেখ করেন।

ব্যথানাশক হিসেবে হাসি
২০১০ সালে ড. কাজন প্রমাণ করেন, ১০ মিনিট প্রাণ খুলে হাসা দুই ঘণ্টা ব্যথাহীন নিদ্রা দিতে সক্ষম, যেটা এত দিন কেবল মরফিনই দিতে পারত। হাসি শরীরে এন্ডোমরফিন তৈরি করে, যা ন্যাচারাল ব্যথানাশক নামে পরিচিত। এটাই ব্যথাহীন নিদ্রার রহস্য বলে মনে করেন ড. উইলিয়াম ফ্রে।

রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ায় হাসি
শুনতে অবাক লাগলেও সত্যি যে হাসি আমাদের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়ায়। ১৯৮৯ সালে আমেরিকার লোমা লিন্ডা ইউনিভার্সিটির স্কুল অব মেডিসিন বিভাগের গবেষক ড. লি বার্ক দেখতে পান, হাসি আমাদের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতাকে সক্রিয় করে। হাসি কাজ করে টেনশনের বিরুদ্ধেও। লি বার্কের মতে, হাসি এন্ডোমরফিন বাড়ায়, মস্তিষ্কে ডোপামাইন পাঠায়, যার দরুন আনন্দদায়ক ও পুরস্কৃত হওয়া অনুভূতি জন্মে এবং রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বৃদ্ধি পায়।

এইচআইভি ও ক্যানসারের বিরুদ্ধে কার্যকর হাসি
২০০৩ সালে ইন্ডিয়ানা স্টেট বিশ্ববিদ্যালয়ের নার্সিং কলেজের গবেষক ড. মেরি পাইন বেনেট প্রমাণ করেন, হাসি ন্যাচারাল কিলার কোষকে সক্রিয় করে, যা ক্যানসার ও এইচআইভি রোগের বিরুদ্ধে কাজ করে। পরবর্তীকালে ২০০৮ সালে তিনি ওয়েস্টার্ন কেন্টার্কি বিশ্ববিদ্যালয়ের নার্সিং স্কুলে গবেষণা চালিয়েও একই রকম ফল পান, যারা হাসির ভিডিও দেখে শব্দ করে হেসেছিল, তাদের ন্যাচারাল কিলার সেলগুলো ক্যানসার কোষের বিরুদ্ধে বেশি সক্রিয় হয়েছিল।

শরীরে রক্তের প্রবাহ বাড়ায় হাসি
মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের মেডিকেল সেন্টারের পরিচালক ড. মাইকেল মিলার। তিনি দেখতে পান, হাসির সময় আমাদের রক্তের কোষের ব্লাড ভেসেলের অভ্যন্তরীণ আস্তরণ (ইন্ডোথেলিয়াম) প্রসারিত হয়, ফলে রক্তপ্রবাহ বেড়ে যায়। সাধারণত টেনশনের সময় আমাদের এর ঠিক উল্টোটি হয়ে থাকে—রক্তের এই আস্তরণ সংকুচিত হয় এবং রক্তপ্রবাহ বাধাগ্রস্ত হয়। কাজেই হাসি রক্ত সরবরাহ বৃদ্ধি করে।

নিউমোনিয়ায় হাসির উপকারিতা
আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়া অ্যাসোসিয়েশন অব লংটার্ম কেয়ার মেডিসিনের প্রেসিডেন্ট ও চিফ মেডিকেল অফিসার ড. মাইকেল আর ওয়াসারম্যান নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হন। এরপর সুস্থ হন। তিনি দাবি করে বসেন, তাঁর সুস্থ হয়ে ফেরার পেছনে হাসি। প্রতিদিন হাসির ভূমিকা ছিল সুস্থ হওয়ার পেছনের কারণ। অপর এক গবেষণায় ড. উইলিয়াম ফ্রে প্রমাণ করেন, মন খুলে ‘হাসি’ শরীরচর্চার সমান, যা কিনা শ্বাস-প্রশ্বাসের সংক্রমণের আশঙ্কা কমায়।

ওষুধের বিকল্প হিসেবে হাসপাতালে ‘হাসি’র ব্যবহার
আমেরিকার ফিজিশিয়ান, নার্স এবং অন্যান্য হেলথ প্র্যাকটিশনাররা চিকিৎসা হিসেবে ওষুধের পাশাপাশি হিউমার এবং হাসির প্রয়োগ করে থাকেন হাসপাতাল, পুনর্বাসন কেন্দ্র এমনকি নার্সিং হোমগুলোতেও। যেমন নিউইয়র্ক মেট্রোপলিটন এলাকার প্রায় সব হাসপাতালে এবং আমেরিকার বিশেষ কিছু শিশু হাসপাতাল যেমন বোস্টন চাইল্ড হাসপাতালগুলোতে ‘বিগ আপ্যল সার্কাস ক্লাউন’ ইউনিট কাজ করে থাকে। এই প্রফেশনাল ভাঁড়রা সপ্তাহে তিন দিন হাসপাতালের ভর্তি গুরুতর অসুস্থ শিশুদের—স্টেথিসকোপ, থার্মোমিটার ও সুচের পরিবর্তে সং সেজে মজার খেলা দেখিয়ে, মুখাভিনয় করে, কৌতুক ও হাসির গান গেয়ে রোগীদের হাসিয়ে থাকেন। এতে রোগ নিরাময় হয় বলে হাসপাতালগুলোতে হাসির জন্য সং আনা হয়।

হাসি টেনশন ও ডিপ্রেশন কমায়
২০১০ সালে অস্ট্রেলিয়ার জেমস কুক বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. ক্রোফোর্ড এবং ড. ক্যাল্টাবিয়ানো তাঁদের ৮ সপ্তাহের গবেষণায় দেখেন, যাঁরা এই সময়টাতে বিভিন্ন ক্ষেত্রে হিউমার ব্যবহার করে হেসেছিলেন, তাঁদের ডিপ্রেশন ও মানসিক চাপ উল্লেখযোগ্যভাবে কম ছিল, যাঁরা হিউমার ব্যবহার করেননি তাঁদের তুলনায়। ২০১৪ সালে ইরানের একদল গবেষকও প্রমাণ করেন, হাসি রক্তে স্ট্রেস তৈরিকারক হরমোন কমায় অর্থাৎ ‘এন্টি-স্ট্রেস’ হরমোন নিঃসরণের পাশাপাশি জয়ফুল হরমোন নিঃসরণ করে। কাজেই হাসি টেনশন ও বিষণ্নতাও কমায়।

করোনা প্রতিরোধে হাসিই হোক মানসিক ঢাল
আমেরিকার সেন্ট পল মিনোসেটার মনোবিজ্ঞানী সিন ট্রুম্যান মনে করেন, করোনাভাইরাস মোকাবিলায় হিউমার (হাসি উদ্রেককারী উপাদান) মানসিক ঢাল হিসেবে কাজ করবে। তাঁর মতে, নিয়ন্ত্রণের অসাধ্য ব্যাপারকে নিয়ন্ত্রণ করতে হিউমার সত্যি একটা শক্তিশালী পন্থা হতে পারে। অর্থাৎ এটাকে মজা হিসেবেই নিয়ে হাসির ছলেই এর ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। তাই আমেরিকানরা এই মহামারির সময় তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ভালো রাখতে হাসির ব্যবহার শুরু করে দিয়েছে। কমেডিয়ানদের কাজে লাগানো শুরু করেছে। যেমন নিউইয়র্কের গভর্নর এন্ড্রু কুমো আমেরিকান কমেডি অ্যাক্টর ড্যানি ডেভিট, স্টিভেন কোলবার্টসহ অন্যান্য কমেডিয়ানকে নিয়ে নিউইয়র্কবাসীর করোনা মোকাবিলায় হাসির খোরাক জোগাতে কাজে নেমে পড়েছেন।

বিশ্বে করোনা মোকাবিলায় হিউমারের ব্যবহার
শুধু আমেরিকা নয়; চীন, ইরান ও ইতালিতেও এই সংকটময় পরিস্থিতিতে হিউমার অর্থাৎ হাসির উদ্রেক করে এমন কাজ করতে দেখা গেছে। চীনের হুয়াশান হাসপাতালের চিফ ড. ঝং ওয়েন হং করোনাভাইরাস মোকাবিলায় হাসি উদ্রেককর যে মন্তব্য করেছেন, তা উজ্জীবিত করেছে প্রায় ২.৪ মিলিয়ন চীনাকে। উহানবাসী তাই এই কোয়ারেন্টিন সময়ে তাদের মানসিক স্বাস্থ্য ঠিক রাখতে ঘরের ভেতর মাছ ধরা, হাসির গান গাওয়া, মাথা প্লাস্টিকের ব্যাগে মুড়িয়ে চীনের জনপ্রিয় মাহোজং খেলা, ঘরের ভেতর ব্যাডমিন্টন খেলার মতো হাসি উদ্রেককর কাজে নিজেদের ব্যস্ত রেখেছিল। অন্যদিকে ইতালির মানুষেরা বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়ে গান গেয়ে সবাইকে, আর ইরানের স্বাস্থ্যকর্মীরা হাসপাতালগুলোতে নেচে–গেয়ে রোগীদের উজ্জীবিত রেখে চলেছেন।

আলোচনা সংক্ষেপ করলে যেটা পরিষ্কার তা হলো, হাসি যেমন শরীরে রক্তপ্রবাহ বাড়িয়ে টেনশন কমায়; তেমনি, আর্থ্রাইটিস, এইচআইভি ও ক্যানসারের মতো জটিল রোগেও উপকারী ভূমিকা রাখে। আবার হাসি ব্যথানাশক ও নিউমোনিয়ার মতো শ্বাসতন্ত্রের সংক্রমণ প্রতিরোধে কার্যকর। কাজেই, করোনাভাইরাসের বিরুদ্ধেও যে এই হাসি কার্যকর হতেই পারে। তবে হাসি পরোক্ষভাবে করোনা মোকাবিলায় ঢাল হিসেবে কাজ করলেও সরাসরি করোনাকে যে ঝেঁটিয়ে বিদায় করবে না, তা এখনো বলা মুশকিল হলেও একেবারে হেসে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। তবে আর যা–ই হোক, এ সময়ে হেসে শরীরের রোগ প্রতিরোধের ক্ষমতা বাড়াতে তো দোষের কিছুই নেই।

আসুন, ‘হাসি’কে এই সংকটময় সময়ে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনে যোগ করে নিই—
* ফানি ইউটিউব/টিকটক চ্যানেল দেখে
* কমেডি শো/ হাসির নাটক দেখে
* খোশগল্প শেয়ার করে
* জোকস শুনে/পড়ে
* হাসির কমিকস পড়ে
* বাচ্চাদের সঙ্গে খেলা করে
* নিজেই নিজের করুণ অবস্থা নিয়ে হেসে
* কোনোটাই করতে না পারলে কারণ ছাড়াই বোমান ইরানি (মুন্না ভাই এমবিবিএস) কিংবা ড. মদন কাটারিয়ার মতো হেসে।

আসুন, সবাই মিলে করোনা মোকাবিলা করি। অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মানার পাশাপাশি প্রাণ খুলে হাসি আর করোনাভাইরাসের মোকাবিলায় হাসিকে মানসিক ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে এই ভাইরাসকে বিদায় জানাই।

*লেখক: পিএইচডি গবেষক (হিউমার), স্কুল অব সাইকোলজি, সেন্ট্রাল চায়না নরমাল বিশ্ববিদ্যালয়, উহান, চায়না এবং সহকারী অধ্যাপক, মনোবিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়। [email protected]