আনন্দের শহর কলকাতা

মানুষ হিসেবে আমি একটু আলসে প্রকৃতির, যদি কোনো কাজে বা প্রয়োজনে কখনো পুরান ঢাকা থেকে ধানমন্ডি, মিরপুর বা উত্তরার মতো জায়গায় যেতে হয়, তাহলে গায়ে জ্বর না এলেও মনে মনে ঠিক জ্বর চলে আসে। এটা হয় দূরত্ব আর ট্রাফিক জ্যামের কথা ভেবে। কিন্তু যখন কোথাও ঘুরতে যাওয়া হয়, তখন সেই আলসেমি যেন অদ্ভুত কোনো এক হরমনের প্রভাবে কোথায় যেন উড়ে যায়!

গত ডিসেম্বরে বিবাহবার্ষিকী ছিল। ভার্চ্যুয়াল জগতের লাইক, পোস্ট আর শেয়ারের সংস্কৃতিতে সহধর্মিণীকে কোনো রেস্তোরাঁয় নিয়ে যাওয়া বা তাকে কোনো গিফট দেওয়া ছিল যুগের দাবি। সেই যুগের দাবি আর ‘ভ্রমণ হরমোনকে’ বিবেচনায় রেখে ঠিক করলাম কলকাতা যাব। ২৫ ডিসেম্বর বাসের টিকিট কেটে যাত্রা শুরু করলাম, ফিরলাম ৩১ ডিসেম্বর মাঝরাতে। এরই মধ্যে বেশ কিছু জায়গায় ঘোরা হলো।

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল
ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল হুগলি নদীর পাশে। এটি ব্রিটিশ আমলে বানানো। মূলত ইংল্যান্ডের রানি ভিক্টোরিয়া ১৯০১ সালে মারা যাওয়ার পর তাঁর স্মরণে এটি বানানো হয়েছিল। ১৯০৬ সালে নির্মাণকাজ শুরু হয়ে শেষ হয় ১৯২১ সালে। এটি শ্বেতপাথর দিয়ে করা হয়েছিল এবং খুব নিখুঁতভাবে করার চেষ্টা করা হয়েছিল। এটি এখন জাদুঘর হিসেবে বিবেচিত।

ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল এখন পর্যটকদের জন্য ঘোরার ও দেখার অন্যতম নিদর্শন হিসেবে পরিচিত। প্রতিদিন শত শত লোক এটি দেখার জন্য ভিড় করে থাকে। প্রায় ৬৫ একর জায়গার ওপর নির্মিত এবং তখনকার সময়ে ১ কোটি ৫ লাখ টাকার মতো খরচ হয়েছিল।

টিকিট ও সময়
বিদেশিদের জন্য ১৫০ রুপি করে এবং প্রতিদিন খোলা থাকে সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৫টা পর্যন্ত। তবে বিশেষ কিছু দিনে বন্ধ থাকে। ভারতের স্বাধীনতা দিবস, হোলি, ঈদুল ফিতর ইত্যাদি।

হাওড়া ব্রিজ
এটি এখন রবীন্দ্র সেতু নামে পরিচিত। পুরোনো নাম হাওড়া ব্রিজ। এই নামেই সবাই চেনে। এটি মূলত হুগলি নদীর ওপর অবস্থিত এবং কলকাতা ও হাওড়া শহরকে সংযোগ করেছে সেতুটি। এটি ১৮৭৪ সালে প্রথম তৈরি করা হয়েছিল এবং ১৯৪৫ সালে পুরোনো সেতুর বদলে নতুন করে সেতু বানানো হয়। এই সেতুর ওপর দিয়ে প্রতিদিন হাজারো যানবাহন চলে।

রবীন্দ্র সেতু নামকরণ করা হয় ১৯৬৫ সালের ১৪ জুন। তবে মানুষ এখনো হাওড়া ব্রিজ নামে ডাকে এবং চেনে। এটি দেখতে কোনো এন্ট্রি ফি লাগে না এবং বিকেলের পর দেখতে যেতে পারেন, রাতের আলোতে অসাধারণ লাগবে।

সায়েন্স সিটি
এটি কলকাতার চমৎকার একটি ঘোরার জায়গা এবং বিনোদন পার্কের মতো। এটি মূলত বিজ্ঞান সংগ্রহালয় এবং বিজ্ঞানকেন্দ্রিক বিনোদন উদ্যান। এটি কলকাতার নিউ টাউনে অবস্থিত, যা রাজারহাট নামে পরিচিত। ১৯৯৭ সালে বানানো হয়। এর ভেতরে প্রবেশ করে অনেক কিছু দেখতে পারবেন, যা আগে কখনো দেখেননি। যাঁরা বিজ্ঞান ভালোবাসেন, তাঁদের জন্য সারা দিন আর যাঁদের বিজ্ঞান একদম ভালোই লাগে না, তাঁদেরও কমপক্ষে আধা দিন বরাদ্দ রাখতেই হবে সায়েন্স সিটির জন্য।

৬০ রুপি দিয়ে প্রবেশ করতে হয় এখানে। কিছু শোর জন্য আলাদা টিকিট কাটতে হয়।

ইকোপার্ক
এটি কলকাতার নিউ টাউন বা রাজারহাটে। এর আয়তন ৪৮০ একর এবং ভেতরে ১০৪ একরের আরও একটি দ্বীপ রয়েছে। আমার দেখা সবচেয়ে সেরা একটি সময় কাটানোর স্থান বলে মনে হয়। ২০১২ সালের দিকে এটি চালু হয়। বিকেলের পর এখানে রমরমা পরিবেশ থাকে এবং প্রচুর ভিড় থাকে। বিকেলের পর অসাধারণ এক সময় কেটে যাবে, যা আপনি ভাবতেও পারবেন না। রাত ৮টা পর্যন্ত খোলা থাকে, তাই বিকেলে ঘোরার জন্য বেশ ভালো জায়গা।

পরিদর্শক কেন্দ্র, রেস্তোরাঁ, ফুড কোর্ট, নগর জাদুঘর, কারুশিল্প হাট নিয়ে এই ইকোপার্ক।

এন্ট্রি টাইম: (খোলা থাকে)

# গ্রীষ্মকালে: (১ মার্চ থেকে ৩১ অক্টোবর)
মঙ্গলবার থেকে শনিবার বেলা আড়াইটা থেকে রাত সাড়ে আটটা। রোববার এবং ছুটির দিন দুপুর ১২টা থেকে রাত সাড়ে ৮টা।

# শীতকালে: (১ নভেম্বের থেকে ২৮ ফেব্রুয়ারি)
মঙ্গলবার থেকে শনিবার দুপুর ১২ থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা।
রোববার এবং ছুটির দিন বেলা ১১টা থেকে সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা।

মাদার’স ওয়াক্স মিউজিয়াম
এটিকে ভারতের প্রথম মোমশিল্পের জাদুঘর বলা হয়। কলকাতার ইকোপার্কের পাশেই। ২০১৪ সালের নভেম্বর মাসে মাদাম তুসো জাদুঘরের আদলে তৈরি। পৃথিবীর বিখ্যাত কিছু শহরে এমন জাদুঘর আছে। কলকাতায় ঘুরতে গেলে এটি দেখতে মোটেও ভুলবেন না। মূলত বিখ্যাত ব্যক্তিদের প্রতিচ্ছবি এই জাদুঘরে আছে। ছবি তোলা পছন্দ হলে এখানে গেলে ক্যামেরার মেমোরি ও ব্যাটারি বাঁচিয়ে রাখতে হবে; কারণ এত বিখ্যাত বিখ্যাত মানুষের মূর্তি আছে, ছবি তুলতে তুলতে মেমোরি ও ব্যাটারি শেষ হয়ে যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, সৌরভ গাঙ্গুলী, ম্যারাডোনা থেকে শাহরুখ খান—কে নেই এখানে। প্রতিদিন দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে সন্ধ্যা ৬টা পর্যন্ত খোলা।

পার্ক স্ট্রিট
এটি খুব জনপ্রিয় একটি এলাকা। এখানে বিকেলের দিকে ভিড় থাকে। রাস্তাটি ব্রিটিশ আমলে নামকরণ করা হয়েছিল। বিকেল বা সন্ধ্যার পর সময় কাটাতে বেশ দারুণ জায়গা। কলকাতার নিউমার্কেট এলাকার কাছেই পার্ক স্ট্রিট। মাস্তি ও চা, ফুচকা ও অন্যান্য জিনিস খেয়ে টাইম পাসিং এরিয়া।

জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়ি
কলকাতার জোড়াসাঁকোতে অবস্থিত ঠাকুর পরিবারের প্রাচীন বাড়ি। বাড়িটি বর্তমানে রবীন্দ্র ভারতী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণ হিসেবে ব্যবহার করা হয়। এই বাড়িতে কবি এবং প্রথম অ-ইউরোপীয় নোবেল পুরস্কারপ্রাপ্ত রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর জন্মগ্রহণ করেন। এই বাড়িতেই কবি তাঁর শৈশবকাল কাটান। ১৯৪১ সালে ৭ আগস্ট এখানেই মৃত্যু। স্পিকারে বাজতে থাকা রবীন্দ্রসংগীত এর সঙ্গে প্রতিটি রুম পরিদর্শন করলে কেন যেন মনে হবে রবীন্দ্রনাথ স্বয়ং এসে আপনাকে তাঁর জীবনকাহিনি বর্ণনা করছে। এত সমৃদ্ধ জাদুঘর আমি আগে দেখিনি। রবীন্দ্রনাথের আঁতুড়ঘর থেকে শুরু করে তাঁর মৃত্যুর আগমুহূর্তের জ্বরের তাপমাত্রা পর্যন্ত জানা যাবে জোড়াসাঁকো ঠাকুরবাড়িতে।

মার্বেল প্যালেস
ভবনটির ভেতরে রয়েছে অসংখ্য ভাস্কর্য। বিশেষ করে গ্রিক ও রোমান পুরাণের দেব–দেবী জিউস, মিনার্ভা, মার্কারি, অ্যাপোলো, হেরা, ভেনাস, কিউপিড—যেন জীবন্ত হয়ে উঠেছে শ্বেতপাথরের দেহে। ভাস্কর্য ছাড়াও রয়েছে অসংখ্য পেন্টিং বা চিত্রকর্ম। বিশাল বিশাল ক্যানভাসে আঁকা এই চিত্রকর্মগুলো দর্শকদের মুগ্ধ করে অনায়াসে। এই চিত্রকর্মগুলোর মধ্যে ষোড়শ শতকের বিখ্যাত জার্মান শিল্পী রুবেনসের আঁকা দুটি ছবি রয়েছে। এ দুটি ছবি হলো দ্য ম্যারেজ অব সেন্ট ক্যাথেরিন এবং দ্য মার্টারডম অব সেন্ট সেবাস্টিয়ান। ইংরেজ শিল্পী স্যার জোশুয়া রেনল্ডেরও দুটি মূল চিত্রকর্ম এখানে রয়েছে। এ দুটি হলো সাপের সঙ্গে যুদ্ধরত শিশু হারকিউলিস আর ভেনাস ও কিউপিড।

বি.দ্র. ভারতীয়দের দেশপ্রেম আর পরিচ্ছন্নতাবোধ যথেষ্ট উচ্চমানের। মনে রাখবেন, এই পরিবেশ আপনার আমার আমাদের, এই পরিবেশকে পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন রাখার দায়িত্ব আমাদের। যেখানে–সেখানে ময়লা–আবর্জনা ফেলবেন না।

শিক্ষক, সেন্ট গ্রেগরি হাইস্কুল অ্যান্ড কলেজ, ঢাকা