বিশ্বে পঙ্গপাল ও আমাদের প্রস্তুতি

পঙ্গপাল। ছবি: সংগৃহীত
পঙ্গপাল। ছবি: সংগৃহীত

পঙ্গপাল মূলত একপ্রকার পতঙ্গ। এটি এক্রিডিডেই গোত্রের ছোট শিংকের বিশেষ প্রজাতির অন্তর্ভুক্ত। এরা সাধারণত দল বা ঝাঁক বাঁধা অবস্থায় চলাচল করে থাকে। কিন্তু পঙ্গপাল এবং ঘাসফড়িংয়ের মধ্যে পার্থক্যগত কোনো শ্রেণিবিন্যাস নেই। মরুর এই পঙ্গপাল মূলত আরব উপদ্বীপের দেশগুলোতে বসবাস করে থাকে। বিগত বছরগুলোতে হর্ন অব আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া, পাকিস্তান, ভারতসহ ২৫টি দেশে প্রায় ১৬ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার জুড়ে ভয়ানক এ পতঙ্গের অবস্থানের কথা জানা গেছে। তবে সুযোগ পেলেই বিশ্বের ৫২ দেশের ৩২ মিলিয়ন বর্গকিলোমিটার অর্থাৎ পৃথিবীর ২০ শতাংশ অঞ্চলে এরা বিস্তার হওয়ার আশঙ্কা আছে। কিট বিশেষজ্ঞদের মতে প্রকৃতির এই নীরবতায় সম্প্রতি এরা বিশ্বভ্রমণে বের হয়েছে।

পঙ্গপাল ১৯৯৩ সাল থেকে ব্যাপক আকারে পাকিস্তানে আক্রমণ করেছিল। পরে পাকিস্তান শেষে ভারতের ফসলে ও গাছপালায় হানা দিয়ে ব্যাপক ক্ষতি করেছে। যদিও বাংলাদেশের কিট বিশেষজ্ঞ ও কৃষিবিদেরা বলছেন, ‘বিগত ৫০ থেকে ৬০ বছরের পর্যালোচনায় দেখা যাচ্ছে যে আমাদের পরিবেশ পঙ্গপাল বসবাসের জন্য উপযোগী নয়। বিশেষজ্ঞদের মতে এদের বংশবিস্তারের জন্য দরকার উষ্ণ আবহাওয়া বা উচ্চ তাপমাত্রা, সে জন্যই পঙ্গপাল মরু অঞ্চলে বসবাস করে আসছে।

সম্প্রতি গণমাধ্যমে জানতে পারি, পর্যটন নগরী কক্সবাজারের টেকনাফে এক গ্রামে একটি বাগানে একধরনের নতুন কীটপতঙ্গ দেখা গেছে। অতীতে ওই সব এলাকায় এ রকম বিরল প্রজাতির পতঙ্গ কখনো দেখা যায়নি। তবে কৃষি মন্ত্রণালয় থেকে বলা হয়েছে, টেকনাফের এগুলো পঙ্গপাল নয়।

তবে যুক্তরাষ্ট্রের মিনেসোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষণা বলছে, টেকনাফে আসা পতঙ্গই প্রকৃতপক্ষে পঙ্গপাল। কেননা বিজ্ঞানীদের মতে এসব কিট আফ্রিকান ডেজার্ট বা পঙ্গপাল নয়। এরা হচ্ছে পূর্ব এশিয়া অর্থাৎ অরিয়েন্টাল মাইক্রোটরি লোকাস্ট, মানে মিয়ানমার কিংবা ভারত থেকে এসেছে।

২০১৯ সালের মার্চেও আবার পঙ্গপাল শনাক্ত হয় পাকিস্তানে। পরে এটি সিন্ধু, দক্ষিণ পাঞ্জাব ও খাইবার পাখতুনখাওয়া প্রদেশে ৯ লাখ হেক্টরজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে। ক্ষতিগ্রস্ত হয় কোটি কোটি রুপি মূল্যের খাদ্যশস্য ও গাছপালা। সৌদি আরবেও আক্রমণ করেছে এই পঙ্গপাল।
গবেষণা বলছে, দিনে প্রায় ১৬০ বর্গকিলোমিটার উড়তে পারে একেকটি পঙ্গপাল। প্রতিদিন একটি পূর্ণ বয়স্ক পঙ্গপাল তার ওজনের সমপরিমাণ খাদ্য গ্রহণ করে থাকে। যে এলাকায় পঙ্গপাল আক্রমণ করে, সেখানে খাদ্য সম্পূর্ণ শেষ করে অন্য অঞ্চলে যায়।

জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার মতে, এক বর্গকিলোমিটার আকারের পঙ্গপাল একসঙ্গে যে খাবার খায়, তা দিয়ে ৩৫ হাজার মানুষকে এক বছরের খাবার জোগান দেওয়া সম্ভব। কেবল খাবারই খায় না তারা, একই সঙ্গে প্রজননের কাজটিও করে। তাই আফ্রিকার দুর্ভিক্ষের আরেক নাম হচ্ছে পঙ্গপাল।

আফ্রিকায় পঙ্গপালের কারণে খাদ্যসংকট বলে মনে করা হয়। ছবি: সংগৃহীত
আফ্রিকায় পঙ্গপালের কারণে খাদ্যসংকট বলে মনে করা হয়। ছবি: সংগৃহীত

প্রাচীন মিসরীয়দের কবরে পঙ্গপালের ছবি দেখা যায়। ধর্মীয় স্কলারদের মতে গ্রিসের ইলিয়াডসহ বাইবেলে পঙ্গপালের কথা উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া প্রাচীন মিসরের ফারাওদের আমলেও পঙ্গপাল দুর্ভিক্ষ তৈরি করেছিল। ধারণা করা হচ্ছে, ইথিওপিয়া, কেনিয়াসহ পূর্ব আফ্রিকার দেশগুলো পঙ্গপালের আক্রমণে খাদ্যসংকটে পড়ে লক্ষাধিক মানুষ ও গবাদিপশু মারা যেতে পারে। ইতিমধ্যে আফ্রিকার পঙ্গপাল আক্রমণ পরিস্থিতি সামাল দিতে জাতিসংঘের কাছে ৬০ কোটি ডলারের অনুদান চেয়েছে আফ্রিকার মানবাধিকার কমিশন।

বিশেষজ্ঞদের মতে, পঙ্গপাল পাকিস্তান ও ভারতে অবস্থান করায় চিন্তাটা বেশি। ভারত প্রতিবেশী দেশ হওয়ার কারণে বাংলাদেশ পঙ্গপাল আক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে। পঙ্গপাল নিয়ন্ত্রণে পাকিস্তানে জরুরি অবস্থা পর্যন্ত জারি করতে হয়েছিল। তাই পঙ্গপাল আক্রমণকে খাদ্যসংকটের মারাত্মক ঝুঁকি বিবেচনায় নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের কৃষি মন্ত্রণালয় যথোপযুক্ত সময়োপযোগী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে; অন্যথায় আমাদেরকে করোনার মতো চড়া মূল্য দিতে হতে পারে। যদিও তাদের উপদ্রব ঠেকাতে এখন পর্যন্ত কার্যকর কোনো ওষুধ বা পদ্ধতি আবিষ্কৃত হয়নি।

পঙ্গপাল নিয়ন্ত্রণে সাধারণত বাতাসে ও মাটিতে কীটনাশক ব্যবহারের প্রয়োগ হয়ে থাকে। এ ছাড়া কন্ট্রাক্ট ইনসেক্টিসাইড ওষুধ বা কীটনাশক ব্যবহারের মাধ্যমে কিছুটা সফলতা পাওয়া যায়। তবে সরকারের উচিত পঙ্গপালের হাত থেকে বাঁচার জন্য উড়োজাহাজ বা কীটনাশক বহনযোগ্য যন্ত্র প্রস্তুত এবং পর্যাপ্ত কীটনাশক মজুত রাখা। কৃষি বিভাগের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের যথাযথ প্রশিক্ষণ প্রদানসহ পঙ্গপাল রোধে গবেষণা চালিয়ে যাওয়া একান্ত প্রয়োজন।

বাংলাদেশ সরকার পঙ্গপাল আক্রমণের আশঙ্কা বিবেচনায় নিয়ে নিয়মিত জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার সঙ্গে যোগাযোগ অব্যাহত রেখেছে। তা অবশ্যই ভালো খবর। তবে এখনই পঙ্গপাল রোধে আগাম কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে বাংলাদেশসহ বিশ্বে দুই থেকে ছয় মাসের মধ্যে কৃষি–খাদ্যকে বিপর্যস্ত করে তুলতে পারে। এ জন্য বিভিন্ন দেশকে পঙ্গপাল নিয়ন্ত্রণে যথাযথ কর্মসূচি নিতে হবে।

করোনার অর্থনৈতিক সংকটে কৃষিই আমাদের একমাত্র বেঁচে থাকার পন্থা এবং শেষ আশ্রয়স্থল। সেখানে মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা হিসেবে পঙ্গপাল যদি আসে, তাহলে পরিস্থিতি পুরোটা আয়ত্তের বাইরে চলে যাবে।

পঙ্গপাল রোধে পূর্বসতর্কতামূলক আমাদের করণীয় কাজ হলো কীটনাশক মজুত রাখা, হাঁসের প্রজনন বৃদ্ধি করা, জাল বা নেটের ব্যবস্থা করা, পরিষ্কার–পরিচ্ছন্ন চাষাবাদ এবং ফসলের জমি উত্তমভাবে চাষ করা ইত্যাদি।

যদিও কৃষি কর্মকর্তারা বলেছেন, টেকনাফে যে পতঙ্গ দেখা গেছে তা পঙ্গপাল নয়। কিন্তু এর মানে এই নয় যে ভবিষ্যতে বাংলাদেশে পঙ্গপাল আক্রমণের আশঙ্কা নেই। কারণ, পঙ্গপাল জুন পর্যন্ত আক্রমণ করে থাকে। তাই একেবারেই পঙ্গপাল আক্রমণের আশঙ্কা অবহেলা না করে আমাদের সতর্ক থাকতে হবে।

লেখক: পিএইচডি ফেলো, জংনান ইউনিভার্সিটি অব ইকোনমিকস অ্যান্ড ল, উহান, চীন এবং শিক্ষক, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়, ত্রিশাল, ময়মনসিংহ।