খরপো নদীর কাছে একদিন

মাঠে কাজে যাচ্ছেন কৃষিশ্রমিকেরা। ছবি: লেখক
মাঠে কাজে যাচ্ছেন কৃষিশ্রমিকেরা। ছবি: লেখক

ঘরবন্দী দুই মাসের বেশি। কেমন জানি হয়ে যাচ্ছি। একটু স্বস্তির নিশ্বাস নিতে চাই! কে না চায় একটু মনকে সতেজ করতে, সবুজ–শ্যামল প্রকৃতির মাঝে নিজেকে বিলিয়ে দিতে।

জীবন যখন এই অবস্থায় তখন বাড়ির পাশে যদি সুন্দর একটি জায়গা থাকে, তবে একটু মিনি ট্যুর দিতে সমস্যা কোথায়? আর সেটা যদি হয় ভাই ও বন্ধুদের সঙ্গে, তাহলে আরও ভালো হয়। একদম মুক্ত পাখির মতো ডানা ঝাপটে দিগন্তে উড়াল দেওয়া, যত দূর চোখ যায় ছুটে যেতে নেইকো বাধা। খোলা আকাশের দিকে চেয়ে থাকা।

সকালে ঘুম থেকে উঠে বসে আছি বাসার সামনে। শুভ ভাইয়া, সাজু, সূর্য, হীরা, সৈকত সবার মনে এখন একটাই ভাবনা, ইশ যদি ভাইরা মিলে এখন কোথাও ঘুরতে যাওয়া যায়, তবে বেশ হয়। ঠিক সেই মুহূর্তে বন্ধু সাজু বলে উঠল চলো, সবাই খরপো নদী থেকে ঘুরে আসি। লালমনিরহাটের হাতীবান্ধা উপজেলায় গোতামারি ইউনিয়নের ভারতের সীমান্তের পাশে খরপো নদী। গ্রামের লোকেরা এই নদীকে রন্তাই সাগর বলে চেনে। ভারত হয়ে বাংলাদেশে এসেছে এই নদীটি।

সবাই সাজুর সঙ্গে তাল মেলালাম। একে তো মজাদার সাজু তার ওপর হীরা দিয়েছে ঢোলের বাড়ি যেন ঘুরতে যাওয়ার গতিকে আরও বাড়িয়ে দিল। যেহেতু আমাদের বাসা থেকে ৫ কিলোমিটার দূরে খরপো নদী, তাই আর দেরি না করে বাইক রেডি করে ক্যামেরা নিয়ে সবাই রওনা দিলাম।

বাইক যখন গ্রামের আঁকাবাঁকা রাস্তা দিয়ে যাচ্ছে তখন মনে হচ্ছে প্রকৃতি তার সব দেহ প্রদর্শনে মুগ্ধ করে ঘুরতে যাওয়া উৎসুক দর্শকের হৃদয়। রাস্তার ধারে নারকেল, সুপারি, আম, লিচু ও কাঁঠালগাছসহ হরেক রকম গাছের সারি, সঙ্গে বিস্তৃত সোনালি ধান যেন আমাদের স্বাগত জানাচ্ছে সদরে। শুভ ভাই বাইকে বসে গান ধরেন, ‘আহা! কি আনন্দ আকাশে বাতাসে’ সবাই আমরা সুরে তাল মিলিয়ে গাইতে থাকি।

সোনালি ফসল কাঁধে করে ঘরে ফিরছেন কৃষক ও কৃষিশ্রমিক। ছবি: লেখক
সোনালি ফসল কাঁধে করে ঘরে ফিরছেন কৃষক ও কৃষিশ্রমিক। ছবি: লেখক

বাসা থেকে রওনা হওয়ার ২৫ মিনিটের মধ্যেই আমরা পৌঁছে যাই কাঙ্ক্ষিত গন্তব্য খরপো নদীর কাছে। বিশাল বিস্তৃর্ণ এক নদী। নদীর পাশে বিস্তীর্ণ সোনালি ফসলের মাঠ। ধানকাটা মৌসুম থাকার ফলে মাঠে কাজ করছেন কৃষক। সঙ্গে নীলাভ আকাশ। দেখে মনে হচ্ছে প্রকৃতি মাতা তার নিজ তুলি দিয়ে সাজিয়েছে এই জায়গাকে। ফসলি জমির পাশ দিয়ে প্রবাহিত হয়েছে খরপো নদী, কলকল ধ্বনিতে পানি প্রবাহিত হয়ে চলে যাচ্ছে। এই দৃশ্য দেখে মনে হচ্ছে যেন বাংলার একজন মা সোনালি শাড়ি পরে হাসছেন! প্রথমেই নদীর কাছে শ্মশানঘাটের পাশে বসে নিজের ও ভাইদের কয়েকটি ছবি নিয়ে সামনের দিকে এগোতে থাকি। আস্তে আস্তে আমরা নদীর পাশে সরু ফসলি মাঠের পথ ধরে চলতে শুরু করি। সামনে যত দূর যাই শুধু ফসলি মাঠ আর বিস্তৃর্ণ নদী। কৃষক–শ্রমিকেরা নতুন ধান কাটছেন আর সুরে সুরে ভাওয়াইয়া গান গাইছেন একসঙ্গে। তাঁদের গানের সুর আর নদীর কলকল শব্দের সঙ্গে স্নিগ্ধ বাতাস যেন আলাদা এক সৌন্দর্য সৃষ্টি করেছে এই জায়গায়।

আস্তে আস্তে দুপুর হলো সোনালি রোদে ঝিলমিল করছে চারপাশের পরিবেশ। নদীর কিনারার নাম জানি না এমন একটা গাছ তাকিয়ে রয়েছে আমাদের দিকে। আর ওর পাতায় সোনা রোদ গিয়ে আছড়ে পড়ছে, আর সেই ঝলকানিতে মুগ্ধ হচ্ছি আমরা। দুপুর হওয়ার কারণে কৃষকেরা নদীর ধারে খাওয়ার জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছেন। কৃষক–শ্রমিকের পত্নী পরম মায়ায় বাড়ি থেকে খাওয়া নিয়ে এসেছেন। পরিবারসহ কৃষিশ্রমিক পান্তা ভাত গরম আলু ভর্তার সঙ্গে পেঁয়াজ–মরিচ দিয়ে পরম সুখে গান গাইতে গাইতে খাচ্ছে। দৃশ্যগুলো চোখে দেখে আমার মনে হচ্ছে কেউ মনে হয় নিজ ক্যানভাসে পরম যত্নে এই দৃশ্যগুলো এঁকেছে।

শুভ ভাইয়ের আব্বু গোতামারীতে চাকরি করার সুবাদে একজন আমাদের চিনেছেন। রহিম চাচা তাঁর নাম। চাচা অনেক জোরাজুরি করার কারণে আমরা সবাই বসে চাচার পরিবারসহ চিড়া–মুড়ি–মলা খেলাম। রহিম চাচার বউ নিজ হাতে মলা বানিয়েছেন। জীবনে হয়তো এত মজার খাবার কম খেয়েছি।

খাওয়া শেষে কৃষিশ্রমিকেরা তাঁদের পত্নীদের বিদায় দিয়ে আবার সোনালি ফসল কাটতে চলে গেলেন। কৃষিশ্রমিকের পত্নীরা লাইন ধরে বাসার উদ্দেশে রওনা দিলেন মেঠোপথ ধরে।

আমরা আবার উঠে হাঁটা শুরু করলাম। বেলা গড়িয়ে বিকেল তখন। দেখলাম গ্রামের কিছু লোক নদীতে মাছ ধরছে। হরেক রকম মাছ শিকার করার জাল। অনেক ভালো লাগল এটা দেখে।

বিস্তৃত খরপো নদীর সঙ্গে ফসলি মাঠ। ছবি: লেখক
বিস্তৃত খরপো নদীর সঙ্গে ফসলি মাঠ। ছবি: লেখক

বেলা যতই গড়াচ্ছে প্রকৃতির যৌবনে ততই ভাটা পড়ে যাচ্ছে। প্রকৃতি তুমি বহুরূপী, সকালে তুমি করো একরূপ প্রদর্শন, দুপুরে যৌবন, সন্ধ্যায় তোমার বার্ধক্য। হয়তোবা একটু পরেই যৌবন বিকিয়ে শেষ বেলায় পতিত হবে নদীর চারপাশে।

কৃষিশ্রমিকেরা দিনের কাজ শেষে সোনালি ফসল নিয়ে মহা আনন্দে ঘরে ফিরছেন। কেউবা সাইকেল নিয়ে আবার কেউবা ভ্যানে করে কিংবা কেউ নিজ কাঁধে বয়ে নিয়ে যাচ্ছেন তাঁদের ফলানো ফসল। অল্প সময়ের মধ্যে জায়গাটি ফাঁকা হয়ে গেল।

আস্তে আস্তে সন্ধ্যা হয়ে এল। আশপাশে এতক্ষণ যতটা না নীরব ছিল সন্ধ্যার আগমনে পাখির কিচিরমিচির শব্দে আলাদা এক পরিবেশ তৈরি হলো। এখন নদীর পানির শব্দগুলো জোরে শোনা যাচ্ছে। এখন বাসায় ফিরতে হবে। যেতে ইচ্ছে করছিল না। তবুও তো যেতে হবে। মোটরসাইকেল স্টার্ট দিয়ে ‘ওরে নীল দরিয়া আমায় দেরে দে ছাড়িয়া’ সবাই বলতে বলতে বাসার উদ্দেশে রওনা দিলাম। শেষ হলো আমাদের মিনি ট্যুর।

* শিক্ষার্থী: ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়