হাসপাতালে অক্সিজেন সেবা দিচ্ছে 'প্রযত্নে ক্যানভাস'

করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে পুরো বিশ্বই এখন স্মরণকালের সবচেয়ে সংকটময় অবস্থা পার করছে। তবে এই দুর্যোগের মধ্যেও আশার আলো হয়ে এসেছে নানান উদ্যোগ। সমাজের বিভিন্ন গলি আর রাজপথ থেকে তখন অজস্র মানুষ এগিয়ে এসেছেন বিভিন্ন সব সামাজিক উদ্যোগ নিয়ে। ত্রাণ বিতরণ থেকে চিকিৎসাসেবা প্রদান, চলমান দুর্যোগে বাংলাদেশ হয়ে উঠেছে এক লোকের পাশে অন্য লোক।

পেশাজীবীদের বিভিন্ন সংগঠনের মতো বিপর্যস্ত এই সময়ে আক্রান্ত মানুষের জন্য কাজ করছেন বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৬ ব্যাচের শিক্ষার্থীরাও। করোনাভাইরাসের এই সময় ২০০৬ ব্যাচের প্রকৌশলীরা মনে করছেন, প্রকৌশলগত দিক দিয়ে এই সময় তাঁদের কিছু একটা করার সুযোগ রয়েছে। বিশেষ করে শ্বাসকষ্টে ভোগা রোগীদের জন্য অপরিহার্য অনুষঙ্গ অক্সিজেন ব্যবস্থা নিয়ে কিছু করার পরিকল্পনা ছিল তাঁদের। সেই ভাবনা থেকেই তাঁদের উদ্যোগ ‘প্রযত্নে ক্যানভাস’ কাজ করছে কারিগরি সহায়তার মাধ্যমে বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে একটি দীর্ঘমেয়াদি সেবা যুক্ত করতে।

ঠিক কী করছে প্রযত্নে ক্যানভাস? এক কথায় বললে, ছোট পরিসরে হাসপাতালগুলোতে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থাটা প্রস্তুত করা।

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের জন্য অতি জরুরি একটি সেবা হলো অক্সিজেন প্রদান। কিন্তু বর্তমানে দেশের অধিকাংশ হাসপাতালে—সেটা সাধারণ হোক, বা করোনার জন্য নির্ধারিত—অক্সিজেন সরবরাহের কোনো কেন্দ্রীয় ব্যবস্থা (Central Distribution System) নেই। আইসিইউ (intensive care unit) কিংবা ভেন্টিলেটর (ventilator) -এও প্রচুর পরিমাণে অক্সিজেন প্রয়োজন হয়, যা দেশে বিদ্যমান অক্সিজেন সিলিন্ডারের বর্তমান মজুত দিয়ে পূরণ করা সম্ভব নয়।

প্রযত্নে ক্যানভাসের উদ্যোগের উদ্দেশ্য, বড় আকারের High Pressure Gas Cylinder অথবা Liquid Mega Cylinder ব্যবহার করে ছোট পরিসরে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহের ব্যবস্থা প্রস্তুত করা, যার মাধ্যমে হাসপাতালের রোগীদের শয্যায় কিংবা আইসিইউতে সহজেই অক্সিজেন সরবরাহ করা সম্ভব।

কীভাবে এমন একটা কাজের ধারণা এল কাজটার উদ্যোক্তাদের মাথায়? সে প্রশ্নের উত্তরে উদ্যোগের সার্বিক সমন্বয়ক মিঠুন রাহা জানাচ্ছেন, ফেসবুক মেসেঞ্জারে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০০৬ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের একটি নিজস্ব গ্রুপ থেকেই সবকিছুর সূচনা। কোভিড মহামারিজনিত সংকটে প্রকৌশলীরা কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারেন, তা নিয়ে বিভিন্ন রকম আলোচনার পর অবশেষে আক্রান্ত রোগীদের অক্সিজেন সরবরাহ করার ব্যাপারে সবাই একমত হন। মো. আবু নাসের, শাহনেওয়াজ রহমান, জিয়াউদ্দীন আহমেদ—এ তিনজন প্রকৌশলী সংশ্লিষ্ট কারিগরি সমস্যাগুলোর সমাধান করে ফেলার পর শুরু হয়ে যায় পরিকল্পনাটির বাস্তবায়নের কাজ।

প্রথমেই যোগাযোগ করা হয় হাসপাতাল কর্তৃপক্ষদের সঙ্গে। সবার প্রথমে চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ আগ্রহ প্রকাশ করায় তাদেরকেই বেছে নেওয়া হয় পাইলট প্রজেক্ট হিসেবে। সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা তখন দ্রুত হাসপাতালটি পরিদর্শন করে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থাটির নকশা প্রণয়ন করেন এবং একই সঙ্গে শুরু হয় অর্থ সংগ্রহের কাজটাও। Technical Wing, Fund Collection Wing, Media Wing এই তিন দলের সঙ্গে অগণিত শুভার্থী ও দাতাদের সক্রিয় অংশগ্রহণের মাধ্যমে পরিকল্পনার এক মাসের মাঝেই চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতালের ৩৬টি শয্যায় কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা চালু করা সম্ভব হয়।

উল্লেখ্য, এই প্রকল্পের জন্য প্রয়োজনীয় সব অর্থের সংস্থান আসে বুয়েটের ২০০৬ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের কাছ থেকেই।

বিভিন্ন প্রয়োজনীয় যন্ত্রাংশ ক্রয় থেকে ধরলে পাইপিং নেটওয়ার্ক প্রস্তুত, অক্সিজেন ম্যানিফোল্ড সিস্টেম এবং পাইপলাইন ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম ইনস্টলেশনের মাধ্যমে প্রকল্পটি সম্পাদন করতে সময় লেগেছে ২১ দিন।

কারিগরি সহায়তার এই কাজটা ঠিক কীভাবে সেবা দিচ্ছে রোগীদের? কোনো হাসপাতালে কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা যুক্ত হওয়ার উপযোগিতাটা ঠিক কী? প্রশ্নটা করা হয়েছিল চট্টগ্রাম ফিল্ড হাসপাতালের প্রধান নির্বাহী ড. বিদ্যুৎ বড়ুয়ার কাছে। তিনি জানান, কোভিড-১৯ ভাইরাসে যাঁরা আক্রান্ত, তাঁদের রোগমুক্ত করার জন্য অক্সিজেনের সরবরাহ নিশ্চিত করাই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে হাসপাতালে সেন্ট্রাল অক্সিজেন সিস্টেম পাওয়ায় আগের তুলনায় অধিক রোগীকে চিকিৎসা প্রদানের ব্যাপারে ড. বিদ্যুৎ বড়ুয়া আশাবাদ ব্যক্ত করেন।

স্মরণ রাখা দরকার, ত্রাণ কিংবা আর্থিক সাহায্যের মতো এককালীন কোনো ব্যবস্থার সংস্থান দিচ্ছে না প্রযত্নে ক্যানভাস উদোগটি। করোনাভাইরাসের মহামারি বিদায় নেওয়ার পরেও কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থাটি তাই থেকে যাবে হাসপাতালের কাছেই, প্রয়োজনে তারা সেটাকে সংস্কার করে আরও বর্ধিত করতে পারবে তাদের সেবার আওতায়।

চট্টগ্রামের সাফল্যের পর প্রযত্নে ক্যানভাস আয়োজনের উদ্যোক্তারা এখন কাজ করতে চাইছেন দেশের অন্যান্য প্রান্তেও। মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতাল এবং টাঙ্গাইলের কালিহাতী উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সঙ্গে ইতিমধ্যে আলাপ হয়েছে তাদের। চাহিদা অনুসারে দেশের অন্য হাসপাতালের সঙ্গেও তারা কাজ করতে ইচ্ছুক।

আনন্দের বিষয়, কারিগরি সহায়তার মাধ্যমে চিকিৎসা খাতে কাজ করার এই উদোগে ২০০৬ ব্যাচের শিক্ষার্থীদের সঙ্গে এখন যুক্ত হয়েছেন বুয়েট স্বাপ্নিক ১৯৯৯ শিক্ষার্থীরাও। দুই ব্যাচের শিক্ষার্থীদের যৌথ উদ্যোগে অচিরেই শুরু হবে ২৫০ শয্যাবিশিষ্ট মানিকগঞ্জ সদর হাসপাতালের আইসিইউসহ ২৮টি শয্যায় কেন্দ্রীয় অক্সিজেন সরবরাহ ব্যবস্থা প্রস্তুতের কাজ।

তবে বলাই বাহুল্য, এ ধরনের কাজের বিস্তৃতি দীর্ঘ করতে হলে দরকার পড়ে আরও মানুষের। শুধু অর্থ সাহায্য নয়; বিবিধ কারিগরি, প্রশাসনিক, আইনগত বিভিন্ন প্রয়োজনেই বাংলাদেশের প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের এই উদ্যোগে সমাজের সহৃদয় ব্যক্তিদের অংশগ্রহণ একান্ত কাম্য।

উদ্যোগের সার্বিক বিষয়ে অনুসন্ধান বা অন্য যেকোনো প্রয়োজনে আগ্রহীরা তাই যোগাযোগ করতে পারেন এই ঠিকানায়:

মিঠুন রাহা, (ME '06, BUET) ম্যানেজার, ফিনিশিং, কোটস বাংলাদেশ লিমিটেড ও [email protected]

লেখক: সাবেক শিক্ষার্থী, বুয়েট