কমলনগরে নদীভাঙনের ক্ষত দেখলে চোখে পানি আসে

ভাঙছে নদী। ছবি: লেখক
ভাঙছে নদী। ছবি: লেখক

কমলনগরের পুরো দেহে লেগে আছে ক্ষতচিহ্ন। নদীভাঙনের ক্ষত। মেঘনাতীরের পথ ধরে হাঁটলে এ ক্ষতটা বেশিই অনুভব হয়। চোখে জল এসে যাবে নদীভাঙা মানুষের মানবেতর জীবন দেখলে।

ভরদুপুর। যে সময় চুলোয় আগুন জ্বলার কথা, সে সময় নদীতীরের নারীরা ব্যস্ত ঠিকানা বদলানোর কাজে। কোথায় গোসল, কোথায় খাওয়াদাওয়া। এসব যেন ভুলে যায় নদীতীরের মানুষ।
ভররাত। যে সময়টা ডুবে যাওয়ার কথা গভীর ঘুমে। সে সময়টা নদীতীরের মানুষের কাটে ভাঙন দৃশ্য পাহারায়। কখন ঘরের ভিটেটা নদীগর্ভে হারিয়ে যাবে, সে আতঙ্কে ঘুমের দেখা মেলে না।

এমন গল্প আজ বা কালকের নয়। যুগ যুগ ধরে এ করুণ গল্পের বোঝা বয়ে বেড়ায় কমলনগরের মানুষ। দেশের দক্ষিণাঞ্চলের জেলা লক্ষ্মীপুরের বৃহত্তর রামগতি উপজেলা থেকে ভাগ হয়ে ২০০৬ সালে গঠিত হয় কমলনগর উপজেলা। উপজেলা গঠনের অনেক আগ থেকেই মেঘনার করালগ্রাসে ভাঙছে কমলনগর।

নদীভাঙনে গৃহহীন, ভূমিহীন হয়ে পড়েছেন এখানকার ৫০ হাজার মানুষ। এ সংখ্যা দিন দিন আরও বাড়ছে। নদীভাঙনের শিকার হয়ে এখানের বেশির ভাগ মানুষের শেষ ঠাঁই মেলে রাস্তার ধারে, খোলা আকাশের নিচে কিংবা অন্যের আশ্রয়ে।
জেলা শহরের পথ ধরে লক্ষ্মীপুর-রামগতি আঞ্চলিক সড়কের পাশ হয়ে উঠেছে এখানকার মানুষের প্রধান আশ্রয়শিবির। সড়কের পাশে মানবেতর জীবন যাপন করা এসব মানুষের দিকে নজর পড়ে না কারও। সামাজিকভাবেও মানুষ হিসেবে স্বীকৃতি মেলে না তাদের। সড়কটির মিয়ারবেড়ি থেকে চর লরেন্স পর্যন্ত কয়েক কিলোমিটার অংশজুড়ে কোনোমতে ঝুপড়ি ঘরে বসতির দেখা মেলে নদীভাঙা হাজার হাজার মানুষের।
নদীভাঙনে কমলনগরের সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা চর কালকিনি, সাহেবের হাট, ফলকন ও পাটোয়ারিরহাট। নতুন করে ক্ষতির মুখে চর মার্টিন ও চর লরেন্স। ভাঙনে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষ ছড়িয়ে পড়েছেন কমলনগর ও জেলার বিভিন্ন স্থানে। ধারদেনা, ঋণের বোঝা মাথায় নিয়ে এখানকার বেশির ভাগ মানুষ কোনোমতে একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই খোঁজেন।

নিজের অস্তিত্ব বিলীন দেখছেন বসে বসে। ছবি: লেখক
নিজের অস্তিত্ব বিলীন দেখছেন বসে বসে। ছবি: লেখক

নদীরপারে বসতি স্থাপন করেন। টাকার অভাবে কম দামে কেনা জমিতে বসতি গড়েন। কিন্তু বছর পার হতে না হতেই না ভেঙে নেয় বসতি। এভাবে ভাঙনের শিকার হচ্ছেন নদীতীরের মানুষ।
কমলনগরের মেঘনার পথে পথে খবর খুঁজে বেড়াই আজ পাঁচ বছর। নোটবুকের পাতা, খবরের শিরোনামে যুক্ত হয় হৃদয়ভাঙা বহু গল্প, মানুষের আকুতি-মিনতি। কিন্তু কে দেখে এসব? কেবলই আশ্বাস, কাজের কোনো দেখা নেই।

নদীর পথে পথে এমনও মানুষের দেখা মিলেছে, যারা নদীতে ৭, ৮, ৯, ১০ বারের মতো ভাঙনের শিকার হয়ে পথে বসেছেন। ঠিকানা বদল করে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন নিকটাত্মীয়ের থেকে। যাদের সঙ্গে সকাল-সন্ধ্যা কাটত, তাদের দেখা মেলে না বছরে একবার।
ঘরবাড়ি নদীতে হারিয়েছেন চর কালকিনির নবীগঞ্জ এলাকার আলতাফ হোসেন। এখনো জমিজমা কিনেছেন? এমন প্রশ্নে আলতাফের সোজা উত্তর, ‘কী দিয়া জায়গা-জমি কিনমু? কী আছে আমাগো? সব তো গাঙ্গেই নিয়া গ্যাছে। কোথাও যে এক টুকরো জমি কিনে ঘরটা তুলমু, সে সাধ্য আমার নাই। অন এক বেলা যে ঠিকমতো ভাত খাইতে পারমু কি না, সেইটা নিয়াও টেনশন করতাছি।’

চর কালকিনির নাছিরগঞ্জ নদীপাড়ের বাসিন্দা পারুল বেগমের অভিযোগ, ‘আমরা কেমন আছি, কে লয় আমাগো খবর? খুব কষ্টে যে দিন কাডাই, কেউ কি দেখে? এত কিছু আসে, আমরা তো এক মুট চালও পাই না। বারবার গাঙে সব ভাঙি নিয়া যাইতাছে। আমরা খুব কষ্টে আছি, খুব কষ্টে। একবার এসে দেখে যান কমলনগর। এখানের মানুষ কি কষ্টে জীবন যাপন করতাছে।’

কমলনগরের নদীভাঙনের চিত্র সরকারের ওপর মহলে যে পৌঁছেনি, এমনটাও নয়। পৌঁছেছে, বরাদ্দ হয়েছে, কাজে লোপাট হয়েছে। আবার যে বরাদ্দ হয়েছে, সেটা প্রয়োজনের তুলনায় খুবই নগণ্য। কমলনগরের নদীতীরবর্তী সীমানা ১৭ কিলোমিটার। ভাঙন ঠেকাতে বাঁধ নির্মাণ হয়েছে মাত্র এক কিলোমিটার! আবার এ বাঁধ এখন পর্যন্ত ভেঙেছে ১১ বার! এভাবে কি কমলনগরকে বাঁচানো সম্ভব? প্রশ্নটা এখানকার মানুষের।

নদীভাঙনে কত মানুষ যে ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। ছবি: লেখক
নদীভাঙনে কত মানুষ যে ঘরবাড়ি হারিয়েছেন। ছবি: লেখক

কমলনগরের নদীর পথে পথে চর কালকিনি, চর মার্টিন, লুধুয়া ফলকন, পাটোয়ারীরহাট, সাহেবেরহাট ইউনিয়নের চোখে মেললে দেখন যায়, ভাঙনের তীব্রতা কোনো অংশে কম নয়। চর কালকিনি ইউনিয়ন নদীতে ভেঙে দুই ভাগ হয়েছে। মাঝ বরাবর ঢুকে পড়েছে চর মার্টিন। নদীতীরের পথ ধরে হাঁটলে অসংখ্য পারুল বেগম, আয়েশা বেগমের, আলেফা বেগমের গল্প জানি। তাঁদের অভিযোগ নোটবুকের পাতায় জমাট বাঁধাই। অভিযোগের সংক্ষিপ্ত শব্দটা, আমাদের দিকে কেউ ফিরেও চায় না।

স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শিক্ষক সায়েফ উল্লাহ বলেন, ‘আমার বাড়িঘরও কয়েকবার নদীভাঙনের শিকার হয়েছে। নদীতে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে আমার ইউনিয়ন। দু–একটা ওয়ার্ড ছাড়া সব এখন নদীগর্ভে। মানুষের কষ্টেরও সীমা নাই। বেড়িবাঁধের পাশে, না হয় কেউ একটু জায়গা দিলে কোনোমতে মানুষ থাকে। এই রকম মানবেতর জীবনযাপন অন্য কোথাও নাই। আমরা সরকারের কাছে বারবার দাবি করেও এর কোনো স্থায়ী ফল পাইনি।’