ডাকঘর কি এমনি থাকবে

আগে ডাকঘরের এই বাক্সগুলো চিঠিতে ভরে থাকত। ছবি: সৈকত
আগে ডাকঘরের এই বাক্সগুলো চিঠিতে ভরে থাকত। ছবি: সৈকত

ডাকঘর! রবিঠাকুরের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নাটক। ‘অমল’ নামের একটি শিশুর অবসন্নতা ও মৃত্যুর কাহিনি লেখক ফুটিয়ে তুলেছেন তাঁর লেখায়। আমার এই লেখাটি কোনো নাটক বা উপন্যাস নয়। লেখাটি মূলত ধীরে ধীরে মৃত্যুর দিকে ধাবিত হওয়া বাংলাদেশের পোস্ট অফিস নিয়ে।

একটা সময় ছিল, যখন মানুষ ডাকঘরের মাধ্যমে তাদের প্রিয় মানুষদের কাছে চিঠি আদান–প্রদান করে যোগাযোগ রক্ষা করত। ফলে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে চিঠি আদান–প্রদানে রানার, ডাক পিয়ন, পোস্টমাস্টারসহ অন্য কর্মচারীরা ব্যস্ত সময় পার করতেন। কিন্তু সময় বদলের সঙ্গে সঙ্গে হাতে লেখা চিঠি তার আবেদন হারিয়েছে। চিঠির স্থান দখল করে নিয়েছে ই-মেইল।

২০০৫ সালের কথা। তখন আমি আইসিআই ইউনিভার্সিটি নামক একটি খ্রিষ্টান মিশনারির সদস্য ছিলাম। নিয়মিত আমার বাড়িতে বই, চিঠিপত্র আসত পোস্ট অফিসের মাধ্যমে। তখন গ্রামে মোবাইলের তেমন প্রচলন ছিল না। ইন্টারনেটের কথা তো ভাবাই যায় না! বন্ধুবান্ধব, দূরদূরান্তে থাকা আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে চিঠি আদান–প্রদানের একমাত্র ভরসা ছিল পোস্ট অফিস।

উপমহাদেশে প্রথম ডাক সার্ভিস চালু হয় ১৭৭৪ সালে। বাংলাদেশের ডাক বিভাগের ইতিহাসও অনেক পুরোনো, ১৫০ বছরের ঐতিহ্য ধারণ করে এগিয়ে চলা ডাক বিভাগ আজ নানা সমস্যায় জর্জরিত। দেশে প্রায় ১০ হাজারের মতো পোস্ট অফিস রয়েছে। অভ্যন্তরীণ ডাকসেবা হিসেবে ডাকঘর চিঠিপত্র, পোস্ট কার্ড, পার্সেল ইত্যাদির সেবা প্রদান করে থাকে। কিন্তু নানা করণে এখন মানুষ পোস্ট অফিসের সেবা নিতে আগ্রহী নয়। ফলে মাঝেমধ্যে যে চিঠি/পার্সেল আসে, তার অধিকাংশই সরকারি চিঠি, পাবলিক চিঠি মাসের পর মাস অনেক পোস্ট অফিসে আসে না। এর মূল কারণ মোবাইল ফোন, ই-মেইল, ইন্টারনেটের সহজলভ্যতা। ডাক বিভাগের মাধ্যমে মানুষ সঞ্চয়পত্র, ডাক জীবন বীমা, মোবাইল মানি অর্ডারের সেবা পেয়ে থাকলেও সব ডাকঘরে এই সেবাগুলো এখনো পোঁছায়নি, যার মূল কারণ অনুন্নত অবকাঠামো, সেবার সহজলভ্যতা ও ডাকসেবা সম্পর্কে মানুষের ধারণার অভাব। ফলে বিকাশ, রকেট সার্ভিস চালু হওয়ায় মানি অর্ডারের পরিমাণ কমে গেছে। সুন্দরবন, এসএ পরিবহন, কন্টিনেন্টাল কুরিয়ার সর্ভিস দখল করে নিয়েছে ডাক বিভাগের পার্সেল, চিঠি আদান–প্রদানের স্থান।

সারা দেশের পোস্ট অফিসগুলোর অবস্থার উন্নতির জন্য নানা পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। ছবি: সৈকত
সারা দেশের পোস্ট অফিসগুলোর অবস্থার উন্নতির জন্য নানা পদক্ষেপ নিতে হবে সরকারকে। ছবি: সৈকত

করোনার জন্য দুই মাসের ও বেশি সময় ধরে ঘরবন্দী। আজ খুব সকালে বের হয়েছিলাম, উপজেলা পোস্ট অফিসের পাশ দিয়ে যাওয়ার পথে জরাজীর্ণ ডাকঘর চোখে পড়ল। সারা দেশের অধিকাংশ পোস্ট অফিসের অবস্থা অত্যন্ত নাজুক। জনবলের অভাব, পিয়ন, রানারসহ কর্মীদের সম্মানী কম, গ্রাম পর্যায়ে ডাকঘরগুলোতে প্রযুক্তির অভাব, সঠিক পরিকল্পনা ও সময়োপযোগী সিদ্ধান্ত ইত্যাদি কারণ ডাকসেবা মনুষের কাছে পোঁছানোর প্রধান অন্তরায় হিসেবে কাজ করছে।

ডাকসেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছাতে সরকারকে কিছু পদক্ষেপ নিতে হবে। সর্বপ্রথম অবকাঠামোর উন্নয়ন ও দক্ষ জনবল নিয়োগ দিতে হবে। ডাকসেবা প্রদানের সঙ্গে সঙ্গে প্রতিটি ডাকঘর ইন্টারনেট সংযোগের আওতায় আনতে হবে, যার মাধ্যমে বিভিন্ন চাকরির আবেদন, কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি, বিভিন্ন পরীক্ষার ফলাফল জানাসহ অনলাইনের সব সুবিধা প্রদান করতে হবে।

বাংলাদেশ গ্রাম পর্যায়ে ডাকঘর রয়েছে। ফলে গ্রামের মানুষ সব ধরনের ডাকসেবার সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারনেট জগতের সব ধরনের সুবিধাও ভোগ করতে পারবে খুব সহজেই। এ ছাড়া সাইবার ক্যাফে স্থাপন ও কম্পিউটার প্রশিক্ষণের উদ্যোগ নিতে হবে। সাইবার ক্যাফেতে বিনা মূল্যে বা স্বল্প মূল্যে ইন্টারনেট ব্রাউজের ব্যবস্থা এবং কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রাপ্তদের ঋণ প্রদান করে স্বকর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। এর মাধ্যমে ডাক ও ইন্টারনেট সেবা সহজেই মানুষের কাছে পোঁছাবে এবং কর্মসংস্থানেরও ব্যবস্থা হবে। ফলে সরকারের ভিশন-২০২১ বাস্তবায়নে এক ধাপ এগিয়ে যাবে দেশ। আমাদের প্রত্যাশা থাকবে ডাকঘর ফিরে আসবে তার স্বরূপে, সঙ্গে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া নিয়ে। ডাক বাক্সগুলো ভরে যাবে চিঠিপত্র/পার্সেলে।
*শিক্ষক