সিকিমের ডায়রি

রানকা মনাস্ট্রিতে লেখক। ছবি: সংগৃহীত
রানকা মনাস্ট্রিতে লেখক। ছবি: সংগৃহীত

অনেকদিন থেকে প্লান করছিলাম জম্মু-কাশ্মিরে পরিবার নিয়ে যাব। প্লান-প্রোগ্রাম ঠিক করে ২০১৯ সালের এপ্রিলকেই বেছে নিয়েছিলাম। যেহেতু এই মাসে ছুটিরদিন বেশি আর এপ্রিল-মে মাসে শ্রীনগরে টিউলিপ উৎসব হয় তাই ১২ এপ্রিল ঠিক করে ফেললাম।

কিন্তু পুলওয়ামা আক্রমণের পর সব কিছু ভেস্তে গেল। যদিও শ্রীনগরের ফেসবুক বন্ধুরা আশ্বস্ত করেছিলেন আমাদের কোনো সমস্যা হবে না। তারা সবধরণের সাহায্য করবেন। তবু পুরোপুরি মনস্থির করতে পারছিলাম না। কাশ্মীরের নিউজ আপডেট নিতে থাকলাম। পরে একটা পর্যটক বাসে হামলার পর মাথা থেকে আর কাশ্মীরের চিন্তা বাদ দিয়ে দিলাম।


এরপর ভাবলাম সিকিম যাই। যেহেতু বাংলাদেশিদের জন্য নতুন করে পারমিশন চালু হয়েছে আর মার্চ থেকে মে হচ্ছে স্প্রিং সিজন, চেরী ব্লসম এবং সব ধরণের ফুলের সমারোহে সিকিমের রাস্তা ঘাট বর্ণিল হয়ে যায়, কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়ায় বরফে সোনালি রোদের ঝিলিকে সিকিমের সৌন্দর্য পরিপূর্ণ থাকে।


আমরা ছিলাম দুটি ফ্যামিলি। আমার সিনিয়র সহকর্মী অত্যন্ত প্রিয় বড় ভাই টিটু ওসমানী ভাইয়ের পরিবার, চারজন বড় আর শিশু জন মিলে মোটে সাত। শুক্রবার সঙ্গে তিনদিনের ছুটি হলে ইমিগ্রেশনে খুব ভিড় থাকে। আমরা সকাল সময় মতো তামাবিলে পৌঁছে গেলাম। গিয়ে দেখি আমাদের বিদায় দিতে বন্ধু আসাব জাফলং থেকে তামাবিল চলে এসেছে মোটরসাইকেল নিয়ে। ওর সঙ্গে যে কয়টা ছবি ওঠালাম তার চেয়ে ওর বাইক চড়েই বেশি ছবি তুললাম, দামী বাইক বলে কথা।

ওখানে ইমিগ্রেশনে লম্বা লাইন ছিল। ২ টা শ্যামলী পরিবহনের বাস আমাদের আগেই চলে এসেছে। আমরা গাড়ি থেকে নামার সঙ্গে সঙ্গেই ইমিগ্রেশন পুলিশ টিটু ভাইকে ডাকলেন। উনি আমাদের পাসপোর্টগুলো নিয়ে গেলেন। ভিআইপি বলে কথা! কাস্টমসের কাজ শেষ করে আমরা চলে গেলাম ভারতের ডাউকি বর্ডারে। ওখানেও আমাদের ভিআইপি ভাই লাইনের পেছনে থেকে সবার আগে আমাদের সাতটি পাসপোর্টের ইমিগ্রেশন কাজ করে উনার অসাধারণ কারিশমা দেখালেন।

গাড়ি আসল ২ ঘণ্টা লেটে

১০টার মধ্যেই আমাদের সব অফিসিয়াল কাজ শেষ। আমার এক ভারতীয় বন্ধু আগে থেকেই একটি সেভেন সিটার গাড়ি ঠিক করে রেখেছিলেন। গাড়িটি ১০ টায় আসার কথা থাকলেও দুই ঘন্টা আমাদের বসিয়ে রাখল। ট্যুর প্লানের প্রথম পরীক্ষায় ব্যর্থতার দায়ভার আমার কাঁধে চাপিয়ে বেলা ১২টায় ডাউকির ইন্ডিয়ান কাস্টমসে হাজির হল গাড়িটি।

চালক লেট করায় মেজাজটা চরম খারাপ হয়ে গেল। গরমে বাচ্চাদেরও খারাপ লাগা শুরু হলো। ডাউকি বাজার না গেলে কাছাকাছি কোথাও খাবার কিছু পাওয়া যাচ্ছে না। পরদিন এ এলাকায় নির্বাচন থাকায় অনেক দোকানপাটও বন্ধ।

গাড়িটা এসেছিল গুয়াহাটি থেকে। চালক ফারুক ভাই একজন অসমীয়া। আর গাড়ি পাঠিয়ে সহযোগিতা করেছেন আসামের বন্ধু, বড় ভাই শহিদ উল ইসলাম লস্কর।
ঠিক ১২ টায় যখন ফারুক ভাই এসে পৌঁছালেন ততক্ষণে আমাদের হিসাবের খাতা থেকে ২ ঘন্টা লস। যাইহোক বিরক্তি নিয়ে সবাই আর্টিগা সেভেন সিটার গাড়িতে উঠলাম। চালক ব্যাগগুলো রুফটপ ক্যারিয়ারে তুলে দিয়ে পলিথিন দিয়ে বেঁধে দিলেন।

ডাউকির ঝুলন্ত ব্রীজে উঠে উপর থেকে নীচে যখন বাংলাদেশে জাফলংয়ের ভিউ দেখি তখন প্রতিবারই মনে হয় প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পুজারী আমরা বাংলাদেশীদের উপভোগের সীমারেখা যদি ওপারে আরও বিস্তীর্ণ হতো!
যাই হোক প্রিয় মাতৃভূমিকে অনেক নীচে রেখে সর্পিল রাস্তা বেয়ে শুধু উপরে উঠতে থাকলাম। অনেকবার হলো শিলং গিয়েছি, গ্রুপের বাচ্চারাও গিয়েছে। তাই এবার শিলং যাওয়ার পথে কোন ভিউ পয়েন্টে আর থামলাম না। তবে রাস্তার দুপাশের সৌন্দর্যে সেই দুই ঘন্টা অপেক্ষার বিরক্তিটা কমে যেতে থাকল।

প্রায় তিন ঘন্টার ভ্রমণে শিলং শহরের পাশ দিয়ে যখন গুয়াহাটির রাস্তা দিয়ে যাওয়া শুরু করলাম। তখন মনে হলো আকাশ থেকে নিচে নামে যাচ্ছি। প্রথমবার এই রাস্তা দিয়ে যাচ্ছি তাই দৃষ্টির সীমারেখাও নতুনের খুঁজে ছুটাছুটি শুরু করল।

তবে শিলংয়ে এখন অনেক ট্রাফিক। রাস্তাগুলো খুব ছোট। তাই শহর থেকে বের হতে অনেক সময় লাগল। তবে সবাই আইন মেনে গাড়ি চালায় এবং কেউ ওভারটেক করে না। ভারতের ন্যাশনাল হাইওয়ে হওয়ায় গুয়াহাটির রাস্তা বেশ বড় এবং চার লেনের। গাড়ির স্পিড অনেক বেড়ে যাওয়া খুব সংগত হলেও ফারুক ভাই অতিমাত্রায় সতর্ক।

পাহাড়ের খাদে দাঁড়িয়ে থাকা গ্যাংটক শহরের ভবনগুলো। ছবি: লেখক
পাহাড়ের খাদে দাঁড়িয়ে থাকা গ্যাংটক শহরের ভবনগুলো। ছবি: লেখক

ডিম-ডাল-সবজি-গরম ভাত

খুব ক্ষুধা লেগেছিল। ফারুক ভাই সাড়ে ৫টার দিকে রাস্তার পাশে একটা ধাবাতে বিরতি দিলেন। আমরা খাবারের অর্ডার দিয়ে ফ্রেশ হতে না হতেই চালকের খাবার রেডি। উনি খাচ্ছেন আরেক টেবিলে আর টেবিলে ক্ষুধা নিয়ে খাবারের অপেক্ষা করছি আমরা।

রেস্তোরাটা বেশ বড়। ক্যাশ কাউন্টারে খাসিয়া তরুণী বসা। যারা এখানে আসছে সবাই রাস্তায় যাত্রাবিরতী দিয়ে খেতে এসেছে। বাইরে অনেক বড় পার্কিং স্পেস এবং কিছু ছোট ছোট খোলা দোকানে লোকাল আচার, চাটনি, বিস্কুট, চকলেট ইত্যাদি বিক্রি হচ্ছে। এখানকার মেয়েরা খুবই কর্মঠ। দোকান নিয়ে বসে, ক্ষেতে চাষ করে, এক কথায় ঘরের বাইরের সব কাজ করে।

আমরা ভেজ খাবারের অর্ডার করেছিলাম। চালকের খাবার সাথে সাথে আসলেও আমাদেরটা দিতে বেশ দেরী করল। ডিম, ডাল, সবজি দিয়ে গরম ভাত, ক্ষুধার্ত পেটে বেশ ভাল লাগল।
অনেক টেনশন কাজ করছিল মাত্র ছয়দিনে কিভাবে কি করব। পয়লা বৈশাখের সঙ্গে শুক্র-শনি মিলে তিন দিন আর অফিস থেকে নেওয়া তিন দিন মোট ছয়দিন ছুটি।
আর আমাদের তিনজনের অর্থাৎ আমি, মিসেস এবং টিটু ভাই, সবার এক সঙ্গে ছুটি মেলাতে অনেক ঝামেলা পোহাতে হয়েছিল। সেই ভিসা করার সময় থেকেই একটার পর একটা বাঁধা, ফ্লাইট বুকিং দিয়ে ও তারিখ কনফার্ম করতে না পারায় বারবার ক্যানসেল করে অবশেষে ভারতীয় ট্রেনের উপর ভরসা করেই রওয়ানা দিয়েছিলাম। যাই হোক গুয়াহাটির লস্কর ভাই অনেক চেষ্টা করেছিলেন ১৩ এপ্রিলের রাজধানী এক্সপ্রেসের টিকিট ম্যানেজ করার। কিন্তু পারেননি। তাই আমাদের খুব তাড়া ছিল যে গুয়াহাটি পৌঁছেই রেল স্টেশনে যাব পরের দিনে শিলিগুড়ির টিকেট করার জন্য।

গুয়াহাঁটি আর শিলং এর মাঝখানের ধাবায় দুপুরের খাবার বিকেলে খেয়ে আমরা আবার রওয়ানা দিলাম গুয়াহাটি রেল স্টেশনের উদ্দেশ্যে।

জানিয়ে রাখা ভাল যে ধাবা পান্জাবী শব্দ। পাকিস্তান এবং ভারতে রাস্তার পাশের রেস্তোরাকে ধাবা বলে। এখানে সাধারণত স্থানীয় খাবারের মেন্যুতে প্রাধান্য দেওয়া হয়।
গুয়াহাটি শহরের ট্রাফিক অতিক্রম করে রেলস্টেশনে পৌঁছলাম রাত প্রায় সাড়ে আটটায়। টিটু ভাইসহ গেলাম স্টেশনের ফরেন রিজার্ভেশনে। রিক্যুইজিশন স্লিপ জমা দিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে পরের দিন কোন ট্রেনেরই টিকেট পেলাম না। চলে গেলাম কারেন্ট রিজার্ভেশনে। সেখানে এক ভদ্রলোক বললেন রাত ১০ টার পর যেতে। তখন কারেন্ট রিজার্ভেশনের টিকেট পেয়ে যেতে পারি।

কারেন্ট রিজার্ভেশন হচ্ছে ট্রেন ছাড়ার শিডিউলের কয়েকঘন্টা আগে যে টিকিটগুলো বাতিল হয় সেগুলো কারেন্ট রিজার্ভেশনে চলে যায়। ভাগ্য সহায় হলে তখন টিকেট পাওয়া যায়। আর ৪ বছর বা এর নিচে টিকেট কাটতে হয় না। রিক্যুইজিশন স্লিপে নাম, বয়স, পুরুষ না নারী, ভারতীয় ঠিকানা এবং ভারতীয় মোবাইল নম্বর লিখতে হয়।
টিকেট না পাওয়া আমরা ফ্ল্যাটে চলে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। গুয়াহাটির আইনজীবী ইমরান ভাই স্টেশনে চলে আসলেন আমাদের নিতে।
রাতে খাবারের জন্য ড্রাইভারকে সেখানকার বিখ্যাত মোঘল গার্ডেনে নিয়ে যেতে বললেন ইমরান ভাই। তবে এবার আরা বাঙালী রসনা বিলাসীদের নিরাশ হতে হয়নি। কাচ্চি বিরিয়ানীর স্বাদটা ছিল অসাধারণ। বিফ চিকেন ডাল তান্দুরী বাসমতি চালের সাদা ভাত স্বাদ নিলাম সবকিছুরই। মনে হচ্ছিল পারলে আগামী কয়েকদিনের খাবারটা ও যদি খেয়ে নিতে পারতাম।
খাওয়া শেষে চলে গেলাম Pub Sarania Rd-এ আমাদের জন্য ঠিক করে রাখা ফ্ল্যাটে। ফ্ল্যাটটা ছিল খুব কজি। আমাদের তুলনায় বেশ বড়। কিচেনে সব আটেনসিল রেডি। ৩ টা বেড রুম ছাড়া ও বেশ বড় সিটিং ডায়নিং রিডিং

রুম, সব মডার্ণ অ্যামিনিটিজ ছিল। আবার লস্কর ভাইয়ের জন্য কৃতজ্ঞতা ভরে উঠল। বউ বাচ্চাদের ফ্ল্যাটে রেখে ইমরান ভাই উনার গাড়ি দিয়ে আমাকে এবং টিটু ভাইকে নিয়ে গেলেন স্টেশনে টিকেট করার জন্য। অনেক ঝামেলা পেরিয়ে অবশেষে টিকেট পেলাম নর্থ ইস্ট এক্সপ্রেসের তবে গুয়াহাটি স্টেশন থেকে নয় অল্প দুরে কামাক্ষ্যা স্টেশন থেকে। টিকেট কেটে ফিরে এসে শরীরে ক্লান্তি নিয়ে রুমে ঢুকেই ঘুম।

ভ্রমণের নির্ধারিত তারিখ বারবার অনিশ্চয়তায় পড়ে যাওয়ায় গো এয়ার, ইন্ডিগোর ফ্লাইটগুলো অনেকবার বুকিং দিলাম আর বাতিল হলো। ইন্ডিয়ান ডমেস্টিক রুটের ফ্লাইটের ভাড়া মাস দুয়েক আগে থেকে বুকিং দিয়ে রাখলে অনেক সস্তায় পাওয়া যায়। নতুবা ভাড়া তো বাড়েই সাথে সরাসরি রুট ও চেন্জ হয়ে যায়। আমাদের ক্ষেত্রে যেটা হয়েছিল দুদিন আগে টিকেট করতে গিয়ে দেখি ভাড়া ৫/৬ গুনের চেয়ে বেশি। আবার ফ্লাইটগুলো গুয়াহাটি থেকে শিলিগুড়ি সরাসরি দিতে পারছে না। দিল্লি হয়ে ঘুরে তারপর শিলিগুড়ি যায়। ফলে একঘন্টার এয়ার ডিসটেন্স বেড়ে ১৫ থেকে ২০ ঘন্টা পর্যন্ত হয়ে যায়।

সিকিমে প্রবেশ করতে হলে আপনাকে প্রথমে শিলিগুড়ি যেতে হবে। যাওয়ার পথে দার্জিলিং এবং কালিম্পং এর রাস্তা ভাগ হয়ে যায়। বাংলাদেশের সবচেয়ে কাছের বোর্ডার হচ্ছে ফুলবাড়ি-বাংলাবান্ধা। ফুলবাড়ি থেকে মাত্র ৩ কিলো দুরত্বেই শিলিগুড়ি। আমরা ও এদিকেই যেতাম তবে আমাদের সিলেট থেকে ঢাকা হয়ে পঞ্চগড় পৌঁছাতে যে সময় এবং কষ্ট হবে তার চেয়ে সহজে আমরা গৌহাটি পৌঁছাতে পারি। তার চেয়ে বড় ব্যাপার হচ্ছে যাওয়ার সময় মেঘালয়ের ঠান্ডা আবহাওয়া আর রাস্তার নয়নাভিরাম সৌন্দর্য উপভোগ করা যায়। তবে মেঘালয় পেরিয়ে আসামের ঢুকার সাথে সাথেই অনেকটা ঢাকার মতো মনে হয়। আর আসামের বনগাইগাওঁ এর একটু পরে থেকেই পশ্চিমবঙ্গ শুরু হয়ে যায়।

আলিপুরদুয়ার, কোচবিহার, ধুপগুড়ি, ময়নাগুড়ি, জলপাইগুড়ি জেলাগুলো দিয়ে গেলে আপনার মনে হবে আবার বাংলাদেশেই চলে এসেছেন। সাইনবোর্ডে বাংলা লেখা, ভাষা বাংলা। তবে ওদের বাংলার ফন্ট গুলো একটু পুরানো ধাঁচের। আর আসামের সাইনবোর্ডগুলো পড়ে তো মনে হচ্ছিল বাংলাতে কিছু ভুলভাল করলেই তো অসমীয়া হয়ে যায়। যেমন Axis Bank কে লিখেছে 'এক্সিচ বেনক'।
বাংলাদেশ থেকে বুডিমাড়ি - চ্যাংড়াবান্ধা হয়ে শিলিগুড়ি গেলে কিন্তু অনেক সময় লাগে। তবে বাই রোডে ভুটান যেতে হলে ফুয়েটশিলিং যাওয়ার জন্য বুড়িমাড়িই সেরা অপশন।
পাব সারনিয়া রোডের হোমস্টে ফ্ল্যাট থেকে আমরা সকাল সকাল চলে গেলাম কামাক্ষ্যা রেল স্টেশনে। আমার মেয়ে আলীশব প্রথম ট্রেন ভ্রমণ। এতদিন শুধু ইউটিউবে দেখেছে। শীতাতপ ৩ এ (AC Tire 3A) শ্রেণীর টিকেট ছিল আমাদের তবে এক বগিতে এতগুলো টিকেট পাইনি। দুই পরিবার দুই বগিতে।


নতুন জায়গায় সাত ঘন্টার ট্রেন ভ্রমণ খারাপ লাগেনি, তবে বাইরে তাকিয়ে উপভোগ করার প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো একেবারে বাংলাদেশের মতো। একদম সময়মতো নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে আমরা যখন পৌঁছালাম তখন গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি হচ্ছিল। আমাদের পৌছার আগেই দার্জিলিংয়ের বিবেক দা উনার গাড়ি নিয়ে এনজেপি স্টেশনে হাজির। আমরা খুব তাড়াহুড়া করে গাড়িতে উঠে রওয়ানা দিলাম। টেনশনে ছিলাম রাত ৯টার মধ্যে রাংপোতে না পৌঁছালে পারমিশন জটিলতায় গ্যাংটক শহরে পৌঁছাতে পারবো না।

ফ্লাওয়ার এক্সিবিশন সেন্টার, রিজ পার্ক, গ্যাংটক। ছবি: লেখক
ফ্লাওয়ার এক্সিবিশন সেন্টার, রিজ পার্ক, গ্যাংটক। ছবি: লেখক

গ্যাংটকে নেপালী আর হিন্দির প্রাধান্য
সিকিম রাজধানী গ্যাংটক ইস্ট সিকিমের হেড কোয়ার্টার। গ্যাংটক ছোট শহর। নেপালী আর হিন্দি ভাষার প্রাধান্য। সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৫ হাজার ফিট উপরে শহরটির অবস্থান। শহরে ঢোকার জন্য রাংপো নামক ছোট বাজার থেকে পারমিশন নিতে হয়। এটাকে বলে ইনারলাইন পার্মিশন (ILP)। পারমিশনের জন্য পাসপোর্ট এবং ভিসার ফটো কপি লাগে ২ টা করে। আর পিপি সাইজ দুই কপি ছবি। পাসপোর্টে একটা সিল মেরে একটা পারমিশন পেপার দিয়ে দিবে। এটা ভ্রমণকালীন সময়ে সাথে রাখতে হবে। বিভিন্ন ট্যুরিস্ট স্পটে কাজে লাগে।


আমাদের গাড়ীচালক বিবেক দা শিলিগুড়ি পেরিয়ে তিস্তার পার ধরে গ্যাংটকের রাস্তা বেয়ে উপরে উঠতে থাকলেন। এত সরু সর্পিল আর আপ হিল রাস্তায় এত স্পিডে গাড়ি চালানো কিভাবে সম্ভব তা তখন চিন্তায় ছিল না। তখন শুধু মনে হচ্ছিল এই বুঝি গভীর খাঁদে পরে গেলাম, এই বুঝি গাড়ির সাথে ধাক্কা খেল।


পেটে ক্ষুধা চরমে। সময় বাঁচাতে এনজেপিতে কিছু খাইনি। বিবেক দা অল্প অল্প দুরে বলে আড়াই ঘন্টার রাস্তা পেরিয়ে রাংপোর কাছাকাছি রাত সাড়ে আটটার দিকে বড় একটা খাদের কিনারে একটা নেপালি রেস্তোরায় থামলেন। সেখানে সেই মেঘালয়ের ধাবারগুলোর মতো পৌছার সাথে সাথে ড্রাইভারের খাবার রেডি। একটু অপেক্ষার পর আমাদের খাবার আসল সাদা ভাত, ডিম ভুনা, সবজি আর টার্কা ডাল। সাথে মুগের পাপড়। সেখানেও ক্যাশ কাউন্টারে ছিল সুন্দরী নেপালী তরুণী।


খেয়েই পারমিশনের মাথায় তাড়া নিয়ে আবার রওয়ানা দিলাম। যখন পৌঁছালাম তখন নয়টা বাজতে অল্প বাকি। যাওয়ার আগে শুনছিলাম রাত ৮টা পর্যন্ত ইনার লাইন পারমিট বা আইএলপি পাওয়া যায়। চালক আশ্বস্ত করেছিল ৯টা পর্যন্ত পাওয়া যাবে। যাই হোক রাত ৯টা গিয়ে দেখলাম খোলা আছে তবে বন্ধ করা উপক্রম। বাংলাদেশের টাঙাইল থেকে আসা একটা বড় টিম আর অল্প কয়জন সাদা আর ইন্দোনেশিয়ান পারমিট নেওয়ার অপেক্ষায় আছে। টিটু ভাইয়ের কৌশলে আমাদের ডকুমেন্টগুলো অন্য বাংলাদেশিদের আগেই জমা দিলাম।

ওরা কেউ ছবি আনেনি, কেউ বা জেরক্স। সে এক হুলস্থুল কান্ড। অফিস থেকে ওদের বের করে গেট অফ করে দিল। আমার আর ইন্দোনেশিয়ান একজনের ভিসার ফটোকপি মিসিং ছিল। দিলাম দৌড়। একটু দুরে বাজারে গিয়ে দেখি সব প্রায় বন্ধ করে দিয়েছে। একটা দোকানের শাটার অল্প তোলা। ডেকে বের করে জোর করে কপি করিয়ে আবার দৌড়ে এলাম। দেরীতে চেকপোস্টে ঢুকায় অফিসাররা খুব বিরক্ত আর সকল চালকদের নিয়ে খুব বকা দিচ্ছিল। তবু পর্যটকদের সাথে কোন খারাপ ভাষা ব্যবহার করেনি।

যাই হোক এক ফরমে টিমের সবার পারমিশন দিল। মনে হচ্ছিল গ্যাংটক জয় করলাম। আবার গাড়িতে গ্যাংটকের উদ্দেশ্যে। রাংপো হচ্ছে ইস্ট সিকিমের ছোট শহর। রাংপো পৌঁছানোর একটু পূর্ব পর্যন্ত দার্জিলিং আর গ্যাংটকের রাস্তা ভাগ হয়ে যায়। রাংপো ছাড়ার সাথে সাথে ঠান্ডা বেড়ে যায়।

শহরটাই যেন আকাশ ছোয়া
আমাদের প্রথমে মাংগানের একটা হোম স্টে-তে থাকার কথা ছিল এবং ওখান থেকে পরের দিন লাচুং-এ গিয়ে থাকব বলে প্লান ছিল। মাংগান খুবই সুন্দর একটা গ্রাম। কাঞ্চনজঙ্ঘার ভিউ একদম পরিষ্কার থাকে। কিন্তু যার সাথে কথা হয়েছিল সে কথা রাখেনি।

গ্যাংটক শহরে ঢোকার সময় যখন রাস্তা দিয়ে উপরে উঠছিলাম তখন গাড়ির কাচ নামিয়ে দিয়ে মাথা বের করে যত আকাশ দেখার চেষ্টা করছিলাম ততই শহরের ঘর বাড়ির জ্বলে থাকা বাতিগুলো দেখা যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছিলো শহরটাই বোধ হয় আকাশ ছোয়া। আর শহরে ঢুকে যখন রাস্তা দিয়ে নীচে তাকাচ্ছিলাম উপর থেকে নীচে যতদূর চোখ যাচ্ছিলো ঘর বাড়ির জ্বলে থাকা বাতিগুলো দেখা যাচ্ছিলো, অদ্ভুত দৃশ্য।
যখন আমরা এমজি মার্গের পাশে তিব্বত রোডে আগে থেকে বুকিং দেওয়া আমাদের হোটেলে এসে পৌঁছাই তখন রাত ১০টা। পুরো শহর ঘুমে, মনে হচ্ছিল রাত ১২ টা। এখানে ও আবার পাসপোর্ট, ভিসার ফটোকপি আর ছবি জমা দিয়ে রুম বুঝে নিলাম। এপ্রিল মাসেও হাড় কাপানো শীত। হিটার থাকায় শাওয়ার নিয়ে ভ্রমণের সকল অবসাদ শেষে এক ঘুম।


ভোর ৫টা বাজার সাথে সাথেই রুম থেকে একটা ঘন্টা ধ্বনির শব্দ শুনলাম। যে কয়দিন ছিলাম প্রতিদিনই শুনেছি। মুলত এরপর থেকেই মানুষের চলাচল শুরু হয়ে যায়। সূর্য উঠার পর রুমের জানালা দিয়ে এক অপূর্ব প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য দেখলাম। কাঞ্চনজঙ্ঘার চূড়া কিছু ভবন আর গাছপালার ফাঁক গলে উঁকি দিচ্ছে পূর্ণ যৌবনা হয়ে। মনে হচ্ছিল একদম কাছে। আর ৬০ কিলোমিটার দুরত্ব কাছে নাই বা কেনো! সকালের সূর্যের আলো পড়ে পর্বতচূড়ার শুভ্রতার মাঝে সোনালি ঝিলিক যেনো আমার চোখে প্রতিফলিত হচ্ছিলো। মাংগান গ্রামের রিসোর্টে থাকতে না পারাটা খুব খারাপ লাগছিলো। ওখানে থাকলে খুব কাছ থেকে এ সুন্দর উপভোগ করতে পারতাম।

রুমতেক মনাস্ট্রি
রাঙ্কা মনাস্ট্রিতে সকালের কমপ্লিমেন্টারি বুফে ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম সকাল ৮টার ভেতরেই। আমরা সিদ্ধান্ত নিলাম গ্যাংটক শহরটা দেখব সারাদিন। লাচুং বা লাচেন যাওয়া হয়ে উঠল না। কারণ ওখানে যেতে একদিন আগে পারমিশন নিয়ে রাখতে হয়। মোড়ে মোড়ে অনেক ট্রাভেল এজেন্সি থাকে। তাদের মাধ্যমে পারমিশন এবং ট্রাভেল গাইড নিতে হয়। এরা সবাই স্থানীয় সরকারের অনুমোদিত এজেন্ট। তবে আপনাকে দরদাম করতে হবে গাড়ি ভাড়া নিয়ে। ওখানে সবাই আইনের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল, কর্তৃপক্ষ ও খুব কঠোর। রাস্তাঘাট খুবই পরিষ্কার। ময়লা ফেললে, সিগারেট খেলেই ফাইন। সকাল ৮ টার আগে চার সিটের ট্যাক্সি ক্যাব ছাড়া বাকি সব গাড়ি গুলো শহর ছেড়ে দিতে হয়। ৮টার পরে ৪ সিটার ক্যাব ছাড়া কেউ রাস্তায় বের হতে পারবে না। কারণ পাহাড়ি রাস্তাগুলো খুবই ছোট এবং মারাত্মক রকম উঁচু নিচু। এজন্য শুধু ছোট গাড়ি চলে। সিকিম রাজ্য ছাড়া অন্য কোন রাজ্যের গাড়ি নিয়ে গ্যাংটক শহরে বা ট্যুরিস্ট স্পট ভিজিট করা যাবে না। মেঘালয়, আসাম বা পশ্চিমবঙ্গের গাড়িগুলো শুধু শহরে ঢুকে কিছু নির্দিষ্ট জায়গায় দাড়াতে পারে।


আমরা দুই ফ্যামিলি দুটো ট্যাক্সি নিয়ে শহর ঘুরতে বেরিয়ে পড়লাম। প্রথমে ড্রাইভার নিয়ে গেল রুমতেক মনাস্ট্রি, বৌদ্ধদের উপাসনালয়। চোখে পড়ার মত একটা জিনিস হলো তিব্বতের হিমালয়ান বৌদ্ধদের মন্দিরে এবং আশ্রমে বাটার ল্যাম্প জ্বালানোর বিখ্যাত প্রচলন। এটা তাদের একটি আধ্যাত্মিক বৈশিষ্ট্য। ঐতিহ্যগতভাবে ইয়াক-এর দুধ থেকে তৈরি মাখন দিয়ে এই বাতি জ্বালানোর প্রচলন থাকলেও এখন অনেক জায়গায় ভেজিটেবল ওয়েল অথবা ঘি পুড়ানো হয়। প্রায় পুরো সিকিম জুড়ে রাস্তার পাশে দেখা যায় বৌদ্ধদের ধর্মীয় বাণী সম্বলিত রংবেরং এর কাপড়ের ছোট ছোট পতাকা সুতলি দিয়ে বা খুটিতে টানানো। এ বিষয়টা নেপালে আর ভুটানে ও অনেক বেশি দেখা যায়।
তারপর গেলাম রানকা মনাস্ট্রি। এই মনাস্ট্রিগুলোর স্ট্রাকচারাল ভিউ প্রায় কাছাকাছি। বাইরের প্রাকৃতিক দৃশ্যগুলো নয়নাভিরাম।

এমজি মার্গে সৈয়দা আলীসব আফশিন। ছবি: লেখক
এমজি মার্গে সৈয়দা আলীসব আফশিন। ছবি: লেখক

প্যারাগ্লাইডিং স্বপ্নের সমাপ্তি

আমরা গেলাম বানঝাকরি ওয়াটারফলস পার্ক। ওখান থেকে গেলাম প্যারাগ্লাইডিং স্পট এ। আমার মিসেসের খুব শখ হলো প্যারাগ্লাইডিং করবে। পর্যটকদের আকাশে উড়া দেখে আমার বাচ্চা কান্নাকাটি শুরু করে দিলো যে তার মাকে এভাবে আকাশে উড়তে দিবে না। কিন্তু বাচ্চার মাও নাছোড়বান্দা। এটা সে করবেই। যাই হোক রাইডের জন্য ২ হাজার ৪০০ রুপি আর পুরো ফ্লাইং ভিডিও করার জন্য অতিরিক্ত ৫০০ রুপি দিয়ে টিকেট করে ফেললাম। কিছু নির্দিষ্ট বেল্ট আর জুতা ওকে পরতে দিয়ে কোম্পানির একটা টাক্সিক্যাব করে অনেক উচুতে একটা পাহাড়ে নিয়ে গেল। আমরা বাকি সবাই ল্যান্ডিং স্পটের সামনে বসে অপেক্ষা করতে থাকলাম। একেকেটা রাইড আকাশে উড়ে আর আমার মেয়ে চিৎকার করে মা মা করে। এ সময় বৃষ্টি চলে এলো। বৃষ্টিতে আকাশে কোন রাইড ফ্লাই করে না। কিছু সময় অপেক্ষা করে কয়েকজন দুর্ভাগা পর্যটকসহ পাইলট ফিরে আসলেন। ফলে আমার মিসেসের প্যারাগ্লাইডিং স্বপ্নের সমাপ্তি ঘটল। অবশ্য পুরো টাকাটাই তারা ফেরত দিয়ে দিলো।

এরপর গেলাম স্কাই রোপওয়েতে। পর্যটকদের ভিড় থাকায় বেশ কিছু সময় লাইনে দাঁড়িয়ে অবশেষে সবাই বড় একটা কম্পার্টমেন্টে উঠলাম। অনেক উঁচু থেকে গ্যাংটক শহর দেখা বেশ উপভোগ করলাম সবাই। হোটেলে ফেরার পথে দেখে আসলাম ফ্লাওয়ার এক্সিবিশন সেন্টার, রিজ পার্কে। নাম না জানা অনেক ধরণের হিমালয়ান ফ্লাওয়ার। অর্কিডের এত এত ভ্যারাইটি হতে পারে এখানে না আসলে জানা হতো না। এখানকার লোকজন ফুলের পুজারি। রাস্তার ধারে ধারে, সবার বাড়ির সামনে, দোকানের সামনে শুধু ফুল আর ফুল।

সন্ধ্যা পর হোটেল থেকে হেটে গেলাম মল রোড বা এমজি মার্গে। এই রোড হচ্ছে শরের সবচেয়ে আকর্ষণীয় এবং ব্যস্ততম জায়গা যেখানে বিকেল থেকে সব পর্যটকদের আনাগোনা শুরু হয়। তবে কোনরকমের যান চলাচল সম্পুর্ণ নিষিদ্ধ। রাস্তার মাঝখানের ফুলের বাগান ও বসার জন্য বেঞ্চ দিয়ে পার্টিশন করে রাখা আর রাস্তার দুপাশে আকর্ষণীয় সব স্থানীয় পণ্যসামগ্রী পসরা ও খাবারের দোকান, কিছু ট্রাভেল এজেন্সি, মানি এক্সচেঞ্জ আর হোটেল। পুরো রাস্তা টাইলস লাগানো। এখানে মনে হয় মার্বেল সস্তা৷ যত্রতত্র মার্বেলের ব্যবহার চোখে পড়ার মতো।


হেলিকপ্টার দিয়ে শহর ঘুরে দেখার জন্য আমরা একটা এজেন্সিতে গেলাম। কিন্তু আমাদের চাহিদামাফিক পরেরদিনের সব রাইড বুকড। দুইদিন পরের জন্য বুকিং দিতে পারব তবে আবহাওয়া খারাপ হলে আকাশে উড়া নিষেধ। একদিন পরে আমাদের ফেরার টিকেট থাকায় সেটা আর হলো না। বেশ ভালো কিছু সময় কাটিয়ে আমরা হোটেলে ফিরলাম।

বউ-বাচ্চাদের হোটেলে রেখে আমি আর টিটু ভাই গেলাম ট্রাভেল এজেন্সিতে, পরের দিন ট্রাভেল প্লান ছিলো লাচুং অথবা লাচেন অথবা টিসগমো লেক, এগুলো কোন একটার পারমিশন নিতে। লাচুং এবং লাচেনের রাস্তা অতিরিক্ত বরফ পড়ায় বন্ধ ছিলো। আর ওখানে গিয়ে দিনে দিনে ফিরে আসা যাবে না, হোটেল নিতে হবে।


গ্যাংটক শহর থেকে ১২৫ কিমি দুরে, তিব্বতিয়ান সীমান্তের পাশাপাশি অবস্থিত লাচুং শহর। আর লাচেন লাচুংএর পাশাপাশি আরেকটা শহর। দুইটা নদীর নামে শহর দুটোর নাম। শহর না বলে গ্রাম বলাই শ্রেয়। হিমালয়ের পাদদেশে অবস্থিত সমুদ্র পৃষ্ঠ থেকে প্রায় ৯ হাজার ৬০০ ফিট উঁচুতে অবস্থিত লাচুং এবং লাচেন নদী থেকে তিস্তা নদীর উৎপত্তি।
সিকিম ভ্রমণের মুল আকর্ষণই হচ্ছে লাচুং এবং লাচেন ভ্রমণ। কিন্তু আমরা সেটা মিস করলাম। আমরা টিসমগো লেক ভ্রমণের জন্য সব ডকুমেন্টেরর ফটোকপি দিয়ে গাড়ি আর গাইড ঠিক করে আসলাম। চালক থাকার পরও গাইড আপনাকে নিতেই হবে। এজেন্সি নিজ দায়িত্বে রাতের মধ্যেই পারমিশন নিয়ে নিবে।


রাতে খাওয়া দাওয়া শেষে রাজ্যের সকল ক্লান্তি নিয়ে ঘুমিয়ে পড়লাম। সকাল সাড়ে ৭ টায় গাড়ি এসে হাজির। ৮ সিটের মাহেন্দ্র জিপ। সকাল ৮টার ভেতরে শহর থেকে বেরোতে হবে কারণ ৮ সিটের জিপ ৮ টার পরে শহরে চলাচল করলে জরিমানা গুনতে হবে। আমরাও এর ভেতরেই হোটেলের বুফে ব্রেকফাস্ট সেরে নিলাম দ্রুত। ঠিক ৮টায় আমাদের গাড়ি রওয়ানা দিলো টিসমগো লেকের দিকে।

টিসমগো লেকের আরেক নাম সাংগু লেক। লেকটি ভুটান আর চায়না সীমান্তের কাছাকাছি। গ্যাংটক শহর থেকে ৪০ কিমি দুরে নাথুলা রোডে পূর্ব সিকিমে এই লেকের অবস্থান।
শহর থেকে বের হয়ে খুব সুন্দর পাহাড়ি রাস্তা বেয়ে গাড়ি শুধু উপরে উঠতে থাকলো। পাহাড়ি রাস্তার পাশে পাইন গাছ আর গর্জন জাতীয় লম্বা গাছ চোখে পড়ে বেশি। আস্তে আস্তে রাস্তার পাশের খাদগুলো গভীর হতে লাগলো। স্থানীয় বৌদ্ধ এবং হিন্দুদের জন্য লেকটি একটা পবিত্র স্থান মনে করা হয়। এর কাছাকাছি ওদের বিখ্যাত বাবা মন্দির অবস্থিত। ১২ হাজার ৩০০ ফিট উপরে এই লেকের অবস্থান। এত উঁচুতে বাতাসে অক্সিজেনের পরিমাণ কমে যায়। যাদের হার্টের সমস্যা বা শ্বাস কষ্টের সমস্যা তাদের ওখানে ভ্রমণ করতে নিরুৎসাহিত করা হয়। সিজনের সাথে সাথে এই লেকের বিভিন্ন রং রিফ্লেকশন হয়। লেকের চারিদিকে পর্বত ঘেরা গ্রীষ্মে একদম নীল আর শীতে পুরো পানিই বরফ হয়ে যায়।
রাস্তাটা একদম পাহাড়ি খাদের কিনারা ঘেঁষে অর্থাৎ একপাশে উঁচু পাহাড় আর অন্য পাশে ভয়ংকর খাদ। কোথাও গহীন জংগল আবার কোথায় ছোট ছোট জনপদ। কিছু কিছু জায়গায় আর্মি ক্যাম্প। এই রাস্তাটা প্রায় সময় বন্ধ হয়ে যায় একটু বৃষ্টি হলে পাহাড় থেকে বড় বড় পাথর খসে পড়ে। তখন এই আর্মির তত্বাবধানে পাথর কেটে সরানো হয় আর রাস্তা মেরামত করা হয়।

মেঘের সাথে রাস্তার মিতালী দেখতে দেখতে আমাদের গাড়ি ওপরে উঠতে থাকলো। চারিদিকে মেঘাচ্ছন্ন ভাব। আমাদের চেয়ে নীচে মেঘমালা ভেসে বেড়াচ্ছিলো। সে এক অদ্ভুত অনুভূতি। মাঝে দূরে কোথাও সূর্য উঁকি মারে তখন ঐ দূরের পাহাড়ের চূড়ায় রোদের ঝিলিক পড়ছিলো আবার মেঘের আড়াল হতেই মিলিয়ে যাচ্ছিল।


আরো কিছু উপরে উঠার পরে আমরা পাহাড়ের ঢাল বেয়ে দুধ সাদা স্রোত বেয়ে নামতে দেখলাম। কাছাকাছি যেতে ব্যাপারটা স্পষ্ট হলো। পাহাড় বেয়ে নেমে আসা পানির স্রোত বরফ হয়ে গেছে। ধীরে ধীরে পুরো পাহাড়ই বরফে ঢেকে যাচ্ছে। লেকের কাছে গিয়ে আমরা গাড়ি থেকে নেমে গেলাম। গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে। এত শীত যে গরম কাপড় ভেদ করেও গায়ে ঠান্ডা লাগছিলো। আমরা একটা দোকান থেকে ওয়াটার প্রুফ ভারি জ্যাকেট, বুট, গ্লাভস ভাড়া নিলাম নিজেদের সাইজমত। আমার মেয়েকে কাধে তুলে নিলাম, আর টিটু ভাই উনার ছেলেকে। কারণ পাহাড় বেয়ে উঠা লাগবে আরো কিছু। গাইড আমাদের কে নিয়ে চলল লেকের কিনারে। অপুর্ব সুন্দর আর অদ্ভুত অনুভূতি। পুরো লেকটা বরফ হয়ে গেছে। মনে হচ্ছিল লেকের উপর দিয়ে হেটেই যাওয়া যাবে ওপারে। আমরা সবাই ইয়াকে চড়লাম। আমি মেয়েকে নিয়ে একটা ইয়াকে চড়লাম। ইয়াক হচ্ছে হিমালয়ান বৃহদাকার ষাঁড়। ইয়াকের মালিক রশি ধরে টেনে লেকের পাশে ছোট একটা ট্রেল ধরে পুরো একটা বরফের পাহাড়ের পাশে নিয়ে গেল। সেখানে আবার আমরা সবাই একসাথে হলাম। অনেক্ষণ বরফখেলী করে ওখানকার একমাত্র রেষ্টুরেন্টে ঢুকলাম। আমাদের নিঃশ্বাস ও যেন বের হওয়ার সাথে সাথে বরফ হয়ে যাবে। গরম ম্যাগি নুডুলস আর কফি খেলাম। বেশি বরফ পড়ায় স্কাই রোপওয়েটা বন্ধ হয়ে আছে। ঠান্ডায় আমাদের শরীর জমে যাচ্ছিলো। গাড়ির পার্কিং পর্যন্ত নামতে পা চলছিল না যেন। নীচের দোকানে জ্যাকেট, গ্লাভস, বুট ফেরত দিয়ে আমরা গাড়িতে উঠলাম। আবার ম্যাগী খেলাম। বেশ পরিশ্রম গিয়েছে। এখানে কোন শক্ত খাবার রাখা হয় না। স্যুপ জাতীয় বা তরল খাবারই ভরসা। না হয় শারীরিক সমস্যা দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা আছে।

টিসমগো লেকে শুধুু বরফ আর বরফ। ছবি: লেখক
টিসমগো লেকে শুধুু বরফ আর বরফ। ছবি: লেখক

ট্রেন রাত সাড়ে ১০ টায়, আমরা ভাবলাম সকাল সাড়ে ১০ টায়
ফেরার সময় ভাগ্যটা খারাপ হয়ে গেল। ভয়ংকর ট্রাফিক। শত শত গাড়ি রাস্তায় কিনারায় দাঁড়িয়ে৷ পাহাড়ি পাথর পড়ে বন্ধ হয়ে গেছে। প্রায় ৩ ঘন্টা এক জায়গায় বসে থাকতে হলো। শহরে ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল। হোটেলে না গিয়ে আমরা এমজে মার্গে চলে গেলাম। ওখানে গ্যাংটক শহরের সব ট্যুরিস্টদের মিলনমেলা বসে। সারাদিনের ক্লান্তি দুর করার এক অপূর্ব জায়গা। টুকটাক খাওয়া দাওয়া আর কেনাকাটা করে রাত ৮টার দিকে হোটেলে ফিরে আসলাম। এসে চেক করে দেখি যে আমাদের ট্রেন ছিলো রাত ১০.৩০ টায় শিলিগুড়ির এনজেপি স্টেশন থেকে গুয়াহাটি। কিন্তু আমরা মনে করেছিলাম পরেরদিন সকাল ১০.৩০ টায়। আর গ্যাংটক থেকে শিলিগুড়ি যেতে সময় লাগে ৪ ঘন্টা। এই ঠান্ডা শহরে আমরা ঘামতে থাকলাম। মারাত্মক টেনশনে পড়ে গেলাম। অনেক চিন্তা ভাবনা করে খুব ভোরের জন্য একটা সেভেন সিটার গাড়ি ঠিক করলাম গ্যাংটক থেকে শিলিগুড়ি পর্যন্ত। আর ঐদিক থেকে আমাদের গুয়াহাটির গাড়িকে রাতেই শিলিগুড়ির উদ্দেশ্যে রওয়ানা দিতে বললাম যাতে আমাদের শিলিগুড়ি থেকে নিয়ে যায়। পরের দিন যাওয়ার টেনশন নিয়েই রাতে ঘুমাতে গেলাম।
ভোরে নাসতা সেরেই রওনা দিলাম। ফেরার পথে রাস্তার সৌন্দর্য্য উপভোগ করলাম যেটা যাওয়ার সময় রাতের অন্ধকারে অদেখা ছিলো। তিস্তার পার ধরে শুধু ঢালু রাস্তা বেয়ে নিচে নামছিলাম। রাংপোতে এসে আইএলপি অফিসে পারমিশনের ডকুমেন্টস জমা দিলাম আর আমাদের শহর ছেড়ে যাওয়ার তথ্য দিলাম। সিকিম ছেড়ে পশ্চিম বঙ্গের রাস্তায় উঠলাম। তিস্তা ব্যারাজের পূর্ব পর্যন্ত সবুজাভ পানির স্রোতধারা নদীতে। আর ব্যারাজের পর থেকে নদী একদম মরা। শিলিগুড়ির কাছে কাছে নদীতে শুধু পাথর আর বালি ছিলো এপ্রিল মাসে।

গুয়াহাটি শহর 'রঙালি বিহু'তে বর্ণিল
শিলিগুড়ি এসে আমরা গাড়ি চেঞ্জ করে গুয়াহাটি থেকে আসা ফারুক ভাইয়ের গাড়িতে উঠলাম। থামলাম না একদম। কারণ ৪ ঘন্টার ভ্রমণ শেষে এখন আবার নতুন করে ৬/৭ ঘন্টার ভ্রমণ। পশ্চিম বঙ্গের শেষ আর আসামের শুরু অর্থাৎ আলিপুরদুয়ার আর বনগাইগাঁওয়ের মাঝামাঝি একটা স্থানে হাইওয়ের পাশে একটা ভাল হোটেল পেলাম। তখন প্রায় সাড়ে ৫ টা। নেমে দুপুরের খাবার খেয়ে আবার রাস্তায় নেমে পড়লাম। রাত ১০টার দিকে যখন গুয়াহাটি শহরে ঢুকলাম তখন দেখলাম পুরো শহর 'রঙালি বিহু'তে বর্ণিল। রঙালি বিহু হচ্ছে আসামের জাতীয় উৎসব; জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে সবাই এই অনুষ্ঠান পালন করে। শহরের একজায়গায় বিশাল বড় প্যান্ডেলের ভেতর সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান চলছিলো।

রাস্তার ট্রাফিক মাড়িয়ে আমরা যখন পাব সারণিয়ার ফ্ল্যাটে ঢুকি তখন ঘড়ির কাটা ১১টা পেরিয়ে গেছে। একটু পরেই শুরু হয় কাল বৈশাখী ঝড়। প্রায় ১৬ ঘন্টার ভ্রমণ শেষে বিছানায় শোয়ার সাথেই সাথেই ঘুমিয়ে পড়লাম।
পরদিন সকালে আবার আমরা গুয়াহাটি থেকে শিলং হয়ে ডাউকি সীমান্তের উদ্দেশ্য রওনা হলাম। রাত ৯টায় সিলেটে এসে পৌঁছার সাথে সাথে আমাদের এই স্মৃতিবহুল ভ্রমণের সমাপ্তি ঘটে।

লেখক : এবি ব্যাংকে কর্মরত। [email protected]